মুখরা পুত্রবধূর কাণ্ড

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আরও দুইটা কাঁচা মরিচ দ্যাও দেহি! মতি মিয়া মিনমিনিয়ে বলে।

সোনাই বিবি গরম তেলে বেগুন ভাজার মতো ছ্যাঁৎ করে ওঠে। মরিচের দোকানডা কই কও দেহি! আগুন জ্বালাইয়া দিমু। সারা রাত বুকের জ্বলনে ঘুমাইতে পারে না আর অহন মরিচ লাগে মিনসের!

মতি মিয়া চুপ করে যায়। এই বুড়ো বয়সে ঝগড়া করার শক্তি সে পায় না। আর এ কথাও সত্যি, ঝাল একদম হজম হয় না ইদানীং। সোনাই বিবি তার মেজ পুত্রের বউ। মুখের ভাষা খারাপ হলেও অন্তরে দয়ামায়া খানিকটা আছে মেয়ের। এত টানাটানির সংসারেও অন্তত শ্বশুরকে পয়সাকড়ির খোঁচাটা দেয় না। গালাগালি তার মুখে সর্বক্ষণই থাকে। সে যে লোকই হোক। সোনাই বিবির সামনে গেলে সবাই সতর্ক থাকে। মতি মিয়া বেশ পছন্দ করে সোনাইকে। সোনাই তা ভালো করেই জানে। তবু সে এসবের ধার ধারে না। শ্বশুর আদর করবে বলে শ্বশুরকে আরও দুটো কাঁচা মরিচ এনে খাওয়াবে এতটা জনদরদি না সে।

মতি মিয়া নিঃশব্দে বাকি ভাতটুকু শেষ করে। যদিও কাঁচা মরিচ ছাড়া গলা দিয়ে খাবার নামে না তার। তবু সোনাই বিবির ভয়ে চুপচাপ খেয়ে নেয়। খাওয়ার পরে পুকুরে হাত ধুতে গিয়ে চোখ পড়ে পুকুরপাড়ের মরিচ গাছটার দিকে। জংলার ধারে এই গাছটি আগে চোখেই পড়েনি। এখন মরিচ পেকে লাল হয়ে আছে বলে চোখে পড়ল। পুকুরের আবার আট ভাগ। মরিচ গাছের ভাগ কার কে জানে। মতি মিয়ার খুব ইচ্ছা করল একটা মরিচ ছিঁড়ে শুধু শুধুই খায়। অন্তত মুখটা তো ঝাল ঝাল থাকবে। কিন্তু জংলা পেরিয়ে গাছ পর্যন্ত হাত যায় না তার। হতাশ হয়ে উঠানে চলে আসতেই চোখ গেল সোনাই বিবির দিকে। তার বড় পুত্রের বউ হাজেরার সঙ্গে কী নিয়ে যেন তুমুল ঝগড়া করছে। হাজেরা চুপচাপ ধরনের মেয়ে। কারও সঙ্গে কথায় পারে না। কথাও বেশি বলে না। তার স্বভাব এর কথা ওকে লাগানো। একটু কিছু লাগিয়ে দিয়ে আপন মনে নিজের কাজ করতে থাকে সে। যেন কিছুই জানে না। সোনাই বিবিকে নিয়েও নিশ্চয়ই কিছু বলেছে। সোনাইয়ের চিৎকার শুনে তো এ রকমই মনে হচ্ছে। বাড়িসুদ্ধ লোক তুলে সমানে গালাগাল করছে সে। এই মেয়ে পারেও! কোনো ভয়ডর, লজ্জা শরম কিচ্ছু নেই তার।

মতি মিয়া চেয়েছিল নিঃশব্দে কেটে পড়বে। ছেলের বউদের ঝগড়ায় থাকার কোনো সাধ নেই তার। কিন্তু সে আর হলো কই? সোনাই বিবির চোখ পড়ল তার দিকে।

: আব্বা, বড় বুজি মাইনসের কাছে বইলা বেড়ায় খাইতে দিই না তোমারে আমি! কও দেহি, তোমারে খাইতে না দিয়া খাইসি কুনুদিন?

সোনাই বিবির আরও একটা সমস্যা, সে কাউকে আপনি করে বলতে পারে না। মুরব্বি হোক আর যেই হোক। যার মুখে কোনো সুন্দর ভাষা নেই, তার আবার আপনি তুমি কী? সে যে তুই–তাই করে কিছু বলে না এটাই সৌভাগ্য।

মতি মিয়া সত্যিই বিপদে পড়ে গেল। তার মনে আছে গত পরশু দিন সোনাই বিবি কোনো এক বাড়িতে ঝগড়া করে রাগারাগি করে আর রান্নাই করেনি। দুপুরবেলা ভাত জোটেনি কপালে। সেই দুঃখের কথা হাজেরার কাছে মতি মিয়া নিজেই বলেছে। এখন যদি হাজেরা এটা বলে দেয় সোনাইকে, মতি মিয়ার কপালে শনি আছে।

সোনাই প্রবল আগ্রহে তাকিয়ে আছে শ্বশুরের দিকে। কও দেহি মিয়া! মুই কনে খাইতে দেইনাই তোমারে?

মতি মিয়া আস্তে করে হাজেরার দিকে তাকিয়ে বলল, নাগো বউমা! দেও, দেও, খাইতে দেও মোরে। তোমার দয়া।

চুপচাপ থাকা হাজেরা এবার তেলে–বেগুনে জ্বলে উঠল। আইচ্ছা মানুষ আপনি আব্বা! কিচ্ছু কমুনা অহন। ওই মুখরা বেটি খাইতি না দিলে আইসুন আমার বাড়ি। কথা কমু সেই দিন!

হনহন করে চলে গেল হাজেরা। সোনাই তাকিয়ে রইল মতি মিয়ার দিকে। বুইড়ার ভীমরতি হইসে তাইলে? আমার বাড়ি আর ভাত হইবে না বইলে দিলাম!

লেখিকা
লেখিকা

রেগেমেগে চলে গেল সোনাই। মতি মিয়া যেন নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারল। বুড়ো বয়সে বুঝে উঠতে পারে না কার কাছে কী বলবে। পেটের ক্ষুধায় কী যে বলে ফেলেছিল। বিপদ এদিক থেকে আসবে ভাবতেও পারেনি। কে তাকে খেতে দিল না দিল, তা নিয়ে দুঃখ নেই তার। মুখ দিয়েছেন আল্লাহ, খাবার দেবেন আল্লাহ। তার খারাপ লাগছে সোনাইয়ের কথা ভেবে। মেয়েটা কী ভাবল তাকে। মুখরা মেয়ে, রাগের চোটে হেঁটে হেঁটে লোকের কাছে যা তা বলে বেড়াবে বুড়ো শ্বশুরের নামে। লজ্জায় আর অপমানে মতি মিয়া পুকুর পাড়ে গিয়ে বসল।

তার তিন ছেলেকে ভিটামাটি ভাগ করে দেওয়ার পর বড় ছেলে বউ নিয়ে এমন আলাদা হলো, চোখের সামনে বাপকে দেখেও জিজ্ঞেস করে না বাপটা কেমন আছে। ছোট ছেলে নিজের ভাগ বিক্রি করে শহরে চলে গেল। সেই যে গেল, আর কোনো খোঁজ নেই। মতি মিয়া নিশ্চিত, তার মেজ ছেলেও তার খোঁজখবর করত না কোনো দিন। মুখরা বউয়ের ওপর কিছু বলতে পারে না, তাই বাপকে বাধ্য হয়ে তিনবেলা খেতে দেয়। সোনাইয়ের মুখের ভাষা যত খারাপই হোক না কেন, বুড়ো শ্বশুরের দেখভালে কেন যেন কোনো কমতি রাখে না সে। অকালে স্ত্রী হারানো মতি মিয়া ছেলের বউয়ের কাছে এতটা আশাও করেনি, যতটা সে সোনাইয়ের থেকে পেয়েছে। বুড়োর অসুস্থ শরীরটা টিকে আছে সোনাইয়ের যত্নের কারণেই। মেয়েটা এত মুখরা, কাশতে কাশতে যেদিন মতি মিয়ার লুঙ্গি রক্তে ভেসে যায়, সেদিন লুঙ্গি ধুতে ধুতে চেঁচায়, বুইড়া মরে না ক্যান?

কিন্তু তবু কোনো দিন বলেনি, আমার ঘরে ভাত হবে না আর।

মতি মিয়া জানে এ কথার অর্থ। সোনাই খুব রেগে গিয়েছে আজ। মতি মিয়া নিজের ভুল বুঝলেও সোনাইয়ের কাছে ভুল স্বীকার করতে যাবে এত বড় দুঃসাহস তার নেই। এর থেকে না খেয়ে মরাও ভালো। যক্ষ্মার কারণে ধোঁয়ার কাছে যেতে পারে না সে। তাই রান্না আর হবে না তাকে দিয়ে। এত সব ভাবতে ভাবতে মাগরিবের আজান পড়ে যায়। মতি মিয়া অজু করে ঘরে যায়। মেজ ছেলে নিজের ভাগের ভিটার পাশেই দোচালা ঘর তুলে দিয়েছে। রাতের বেলা যেন শ্বশুরের খোঁজখবর করতে পারে, তার জন্যই নিজের ঘর ছোট করে শ্বশুরের জন্য ঘর তুলে দিতে বলেছে সোনাই। সেখানেই থাকে মতি মিয়া। নামাজ পড়ে সোনাইয়ের ঘরে একটু উঁকি মারে। কোনো সাড়াশব্দ পায় না। মুখরা মেয়েটা কি রাগের চোটে ঘরেও ফেরেনি এখনো? মতি মিয়ার খুব চিন্তা হয়। মশার শব্দে হঠাৎ পেটের ক্ষুধা জানান দেয়। ঘরে রাখা ডেকচি বাটি খুঁজে দেখে মুড়িটুড়ি আছে কিনা। কিছুই পায় না সে। এই বয়সে ক্ষুধা সহ্য করাও কষ্টের। মতি মিয়া জানে হাজেরার কাছে গেলে ভাত তো জুটবেই না, উল্টো হাজেরা সোনাইকে ডেকে চার কথা শোনাবে। এর চেয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়াই ভালো। ছটফট করতে করতে মতি মিয়া এশার নামাজের জন্য অজু করতে গেল। আজকের রাতটা আল্লাহ আল্লাহ করে পার করতে পারলেই হয়। কাল সকালে এক ব্যবস্থা করবে সে।

অজু করে ঘরে আসতেই চোখ গেল বিছানার ওপর। ঢাকা দেওয়া একটা থালা। ঢাকনা তুলে মতি মিয়া দেখে ভাত, ডাল, বড় মাছের মাথা আর চারটা কাঁচা মরিচ। সোনাই ছাড়া এই কাজ আর কে করবে? খাবার দেখে যতটা না খুশি সে, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি খুশি এই ভেবে যে সোনাই বিবির রাগ পড়ে গেছে। ওই রাগী বদমেজাজি মেয়েটাকে যে সে কী প্রচণ্ড ভালোবাসে। মতি মিয়া দুই হাত তুলে দোয়া করল। তার মুখরা বউমাটা মুখরাই থাক!

কাজী সাবরিনা তাবাসসুম: মিলান, ইতালি।