আদিমতম জনগোষ্ঠী বোঁদা সম্প্রদায়

আদিমতম জনগোষ্ঠী বোঁদা সম্প্রদায়
আদিমতম জনগোষ্ঠী বোঁদা সম্প্রদায়

সুরেশের কথামতো ভোররাতেই প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে এল বহ্নিরা। আকাশের সহস্র নক্ষত্র তখনো আলোয়-আলোয় দীপ্তিমান। ওরা আজ কোরাপুট জেলায় যাচ্ছে বিভিন্ন আদিবাসীদের গ্রাম ও জীবনযাত্রা ঘুরে দেখতে। সেখানে রয়েছে রানি দুদুমা জলপ্রপাত এবং অমরনাথের মতো চির রহস্যময় গুপ্তেশ্বর গুহা। পুরি থেকে কোরাপুট অনেক লম্বা পথ। এখানকার সমাজ–সংস্কৃতি বর্তমান শতাব্দীতেও কৃষিনির্ভর। কারণ, অধিকাংশ আদিবাসী তাদের পুরোনো সংস্কৃতির বাইরে বেরিয়ে আসতে রাজি নয়। কিন্তু তারপরও নগরায়ণ ও শিল্পোন্নয়ন থেমে নেই। ছোট ও মাঝারি ধরনের নানা ফ্যাক্টরি গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথাও শোনাল সুরেশ। যা হোক, জলপ্রপাত আর গুপ্তেশ্বর গুহা ছাড়া সুচরিতদের উপভোগের ক্ষেত্রে আরও একটি আকর্ষণীয় বিষয় যোগ হয়েছে আজ। সুরেশ জানিয়েছে, গাদাবা সমাজে সেদিন এক বিশেষ পরবের দিন। তাই গাদাবা মেয়েরা কেরেঙ্গ (একধরনের শাড়ি) পরে ধেমেসা নাচের উৎসব করবে সারা দিন। গাদাবারা মুন্ডা জনগোষ্ঠীর একটি শাখা। কিন্তু তারপরও গাদাবা সম্প্রদায়ের নিজেদের মধ্যেও রয়েছে নানা শ্রেণিবিভাগ। এই পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় উৎসব উদ্‌যাপন থেকে সমাজ–সংস্কৃতির ছোট ছোট আলাদা বৈশিষ্ট্যে।

সে সম্পর্কে কথা বলতে বলতে প্রায় সারাক্ষণই উৎসাহে ফেটে পড়ছে সুরেশ। কোরাপুটের দক্ষিণ দিকটায় সবই প্রায় আদিবাসীদের গ্রাম দাদা। সাঁওতাল, সৌন্তি, মাহালি, মাতিয়া, সোদিয়া, পোঙ্গা, সানো ছাড়াও আছে অনেক রকমের গাদাবা সম্প্রদায়। বোদো, গুতোব, সনো, পারেঙ্গা, কাপু, ওলারা আরও কত কী সেসব নাম। এ ছাড়া অন্য আদিবাসীরাও রয়েছে। যেমন: ভুঞ্জিয়া, নাঙ্গুইল, কোন্দ, সাওরা। বাব্বা! তুমি এত সব জানলে কী করে সুরেশ? ওদিকটায় ট্যুরিজমের সে রকম ব্যবস্থা না থাকলেও আমার আসা–যাওয়া রয়েছে দাদা। কাল চিলিকায় যে রেস্টুরেন্টে খেলেন, ওর মালিক কিষণ শিশা আমার বন্ধু। ওর বাড়ি ওদিকেই। শিশার সঙ্গে তোমার পরিচয় হলো কী করে? ওই যে, চিলিকায় কেউ এলেই তাদের নিয়ে ওর রেস্টুরেন্টে যাওয়া হয়, সেই থেকেই। কিষণ এখানে পাঁচ বছর ধরে আছে। ওদের সমাজ থেকে বেরিয়ে ছেলেটা মূল জনস্রোতের সঙ্গে মিশতে চাইছে। তা ছাড়া আমার নিজেরও জানার আগ্রহ আছে দাদা। আমিও তো বাঞ্জারা সম্প্রদায়ের।

সুরেশের শেষ কথাটি শুনে সুচরিত ও বহ্নি দুজনেই বিস্মিত হলো। কারণ, আদিবাসীদের সম্পর্কে সেভাবে জ্ঞান না থাকার কারণে ওদের দুজনেরই তাদের দৈহিক বিশেষত্ব সম্বন্ধে যে ধারণা রয়েছে, সুরেশ বাঞ্জারা তার সম্পূর্ণ বাইরে। তার চেহারায় রয়েছে সম্ভ্রান্ত পরিবারের রাজসিক ছাপ। খেতে বসেও সুরেশ জানিয়েছিল, পারিবারিকভাবে তারা নিরামিষভোজী। মাছ, মাংস, ডিম এসব কখনো ছোঁয় না। কিন্তু আদিবাসী সম্প্রদায় কখনো কি নিরামিষভোজী হয়? বহ্নি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি যদি আদিবাসী, তাহলে মাছ, মাংস কেন খাও না সুরেশ? না না দিদি, আমরা তো আদিবাসী নই, আমরা হচ্ছি ট্রাইব। উত্তর শুনে সব গুলিয়ে গেল বহ্নির। সপ্রশ্ন দৃষ্টি ছুড়ে তাকাল সে—আদিবাসী আর টাইবদের মধ্যে পার্থক্য কী? অত সব তো জানি না দিদি। শুধু জানি, আমাদের পূর্বপুরুষেরা ওসব কখনো খেত না। আমরাও কখনো খাই না। আর আমরা আদিবাসী নই, ট্রাইব।

আদিবাসী ও উপজাতিদের নিয়ে পণ্ডিত সমাজে ছোটখাটো মতান্তর অনেককাল ধরেই রয়েছে। আদিবাসীরা একদিকে যেমন উপজাতি হতে পারে, তেমনি উপজাতিরাও হতে পারে আদিবাসী, এই তাদের অভিমত। যা হোক, বর্তমান সেন্সাস রিপোর্ট অনুযায়ী সারা বিশ্বের ৯০টি দেশে, পাঁচ হাজার ধরনের আদিবাসী সম্প্রদায় রয়েছে। সব মিলিয়ে এই সংখ্যা ৩৭০ মিলিয়ন। ৭০ শতাংশ বাস করে এশিয়া মহাদেশে। ভারতে সিংহভাগ আদিবাসীর বসবাস ওডিশা আর অন্ধ্র প্রদেশের সীমান্ত অঞ্চলজুড়ে। এদের ভাষা-সংস্কৃতির মতো চেহারাতেও রয়েছে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য। রয়েছে পোশাক–পরিচ্ছদে আলাদা আলাদা বিশেষত্ব।

শহর ছাড়িয়ে মাত্র দেড় ঘণ্টার মধ্যে নিরালা প্রকৃতির কোলে ওদের নিয়ে এল সুরেশ। চোখে পড়ল বিস্তীর্ণ পাহাড়ের পাদদেশ জুড়ে ছোট বড় অজস্র পাথরের টিলা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। আরও নিচে ফসলের মাঠ। উলঙ্গ বাতাসের ছোঁয়ায় বিরতিহীন ঢেউ ছুটছে সেখানে। চারপাশে সকালের লাল সোনা রোদ্দুর। নিসর্গের দেহ উপচে মুখরিত হচ্ছে প্রকৃতির ভাষা। আরণ্যক প্রকৃতির পবিত্র সুষমা অনুভবে মেখে নিয়ে বহ্নি মনে মনে উচ্চারণ করল—পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি/ আমরা সবাই চলতি হাওয়ার পন্থী।

হঠাৎ বহুদূর থেকে অনেকগুলো নারী কণ্ঠের একত্রিত সংগীত ধ্বনি অস্পষ্টভাবে ভেসে এল কানে। শুনেই মুখ খুলল সুরেশ, শুনতে পাচ্ছেন দিদি? বোঁদা মেয়েরা গান গাইছে? ওদের গ্রামও আছে নাকি এখানে? একটু দূরে আছে। কিন্তু সেখানে কারোর যাওয়া চলে না! ওদের পুরুষগুলো খুবই হিংস্র স্বভাবের। দেখলেই তীর মেরে দেয়। সাংঘাতিক নিশানা। ছেলেরা ওদের সঙ্গে আছে এখন? জানি না। সাধারণত থাকে না। ওদের সমাজে মেয়েরাই চাষবাস করে খায়। সব কাজ মেয়েরাই করে। হাটে গেলেও দেখতে পাবেন, মেয়েরাই পসরা সাজিয়ে বসেছে। ছেলেরা খুব অলস। ঘরে বসে ধানি মদ খায় আর একটু আধটু কাজ করে। খুব মারামারিও করে নিজেদের মধ্যে। সুচরিতের গলায় কৌতুক ফুটল সঙ্গে সঙ্গে—তাহলে মেয়েরাই ঘরে-বাইরের সর্বময় কর্ত্রী? ঠিক দাদা। টাকাপয়সা মেয়েদের হাতেই থাকে। ওদের সমাজে মেয়েরা খুব গয়না পরে। তবে বুড়ো বয়সে অনেকে খুব কষ্ট পায়। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে ঘর ভাঙে। ঘর ভাঙে, কেন? কারণটা অদ্ভুত! বোঁদাদের বউয়েরা স্বামীদের থেকে বয়সে দশ থেকে পনেরো বছরের বড় হয়। মেয়েদের বিশ্বাস, বুড়ো বয়সে অল্প বয়সের স্বামীরা ওদের পরিশ্রম করে খাওয়াবে। কিন্তু বাস্তবে এর উল্টোটাই অনেক সময় ঘটে। পুরোনো বউ ছেড়ে ছেলেরা নতুন বিয়ে করে। বুড়িগুলো কষ্ট পায়। আগে এসব কম হতো। কিন্তু এখন ওদের সমাজও তো পাল্টাচ্ছে!

কংক্রিটের মসৃণ পথ ছেড়ে সুরেশের গাড়ি কখন লালচে মাটির এবড়োখেবড়ো পথে তার যান্ত্রিক চারটি পা রেখেছে কে জানে। টালমাটাল পায়ে প্রথম হাঁটতে শেখা শিশুর মতো বারবার হোঁচট খেয়ে বেসামাল হচ্ছে সে। আদিম প্রকৃতির অকৃত্রিম গন্ধ নিশ্বাসে টেনে নিতে নিতে তার রোমান্স মদিরা দুই চোখের পেয়ালা ভরে পান করছিল সুচরিতরা। হঠাৎ সুরেশের কথায় ধ্যান ভাঙল—ওই দেখুন একটা বোঁদা মেয়ে ওর ছেলেকে স্নান করাচ্ছে ঝরনার জলে। সুচরিত ক্ষণকালের দৃষ্টি ছুড়েই বিস্ময়ে তাকাল—এ তো দেখছি হাফ ন্যাংটা! হ্যাঁ দাদা, ওরা রঙিন পুঁতির মালা পরে ওপরের দিকটা ঢেকে রাখে। কিন্তু নিচের দিকটা খোলাই থাকে। ওরা নিজেদের ঐতিহ্য ভাঙতে চায় না।

এদের কি আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলের ‘মাসাই ট্রাইবদের’ মতো দেখতে নাকি? বলতে পারব না! আমি মাসাইদের কখনো দেখিনি। তবে এদের দেখতে অনেকটা মুন্ডাদের মতো। থ্যাবড়া নাক। কালো পুরু ঠোঁট। কালো রং। মাথার চুল খুব কুঁকড়ে থাকায় বড় হয় না। মেয়েরা সব সময় মাথা কামিয়ে খড়ের রঙিন টুপি পরে।

এবার অরণ্যের পাশে গাড়ি বাঁক নিতে কেবল সংগীত লহরি নয় স্পষ্ট হয়ে চোখে পড়ল বোঝা মাথায় এক দঙ্গল বোঁদা নারীকে। অমার্জিত কর্কশ স্বরে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছে সামনের দিকে। গানের সুর তো বটেই এমনকি ওদের গায়কিকেও মনে হচ্ছে আফ্রিকার সাব সাহারান অঞ্চলের ‘মাসাই ট্রাইবদের’ লোকজ সংগীতের প্রতিধ্বনি। সব দেখে শুনে এখন হাজার জিজ্ঞাসার উতরোল জাগছে সুচরিতদের মনের তলায়। প্রশ্ন জাগছে—হাজার হাজার বছর আগে আফ্রিকা মহাদেশ থেকেই কি এদের আগমন ঘটেছিল ভারতবর্ষে? ভারতের প্রাচীন নৃতাত্ত্বিক সাহিত্য কোনো দিনও কি মুখরিত হয়েছিল এদের প্রসঙ্গ তুলে? যেমন হয়েছিল রামায়ণে সেই যুগের রাক্ষস সম্প্রদায় আর বাঁদর বংশীয় বীরদের গল্পগাথা? কিংবা কুরু–পাণ্ডবদের নিয়ে রচিত সাহিত্য মহাভারতে যেমন হয়েছিল, বনবাসী কোল, ভিল, শবর জনগোষ্ঠীর বিস্তারিত কাহিনি?

বহ্নি হঠাৎ ক্যামেরা ফ্লাশ করে ওদের ছবি তুলতে যেতেই চেঁচিয়ে উঠল সুরেশ—দিদি, এসব কাজ একদম করবেন না। ওদের দিকে একদমই তাকাবেন না। ওরা এখনো বহুত বহুত আদিম আছে। ছবি তোলার ব্যাপারটা বুঝবে না। ভাববে ওদের কোনোভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন। তা ছাড়া এমনিতেও এসব পথে কারোর আসা–যাওয়া নিষেধ। সুচরিত উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল—তাহলে এলে কেন? বুঝতে পারিনি দাদা। ওরা এদিকটায় হঠাৎ এভাবে এসে পড়বে, জানা ছিল না। ওদের গ্রাম তো আরও দুই–তিন মাইল ভেতরের দিকে! ভেবেছিলাম, শর্টকাট রাস্তা ধরে বেরিয়ে যাব। সে জন্যই...।

নারীরা অবশ্য রুক্ষ মূর্তি নিয়ে রুখে দাঁড়াল না ওদের সামনে এসে। প্রকৃতির কোলে অযত্নে লালিত বোঁদা নারীদের ক্ষীণ দেহসৌষ্ঠবে চোখ রাখল বহ্নি। তাদের মেদহীন শরীরে কঠিন পরিশ্রমের অসাধারণ ধার। দৃঢ় পদক্ষেপে পথ চলতে চলতে বাহুল্যহীন আনন্দে ওরা গান গাইছে চারদিকে ভ্রূক্ষেপহীন হয়ে। সুরেশ বুকভরে নিশ্বাস টেনে বলল, খুব জোর বেঁচে গিয়েছি দাদা। ওদিকে আর নয়! এবার আমরা ডান দিকের রাস্তা ধরে মাইল দুই এগিয়ে হাইওয়ে ধরব। গাড়ি এখনো পাহাড়ি পথে স্খলিত পায়ে হাঁটছে। সকালের নরম সূর্য ক্রমাগত নিচে নামছে আকাশের পথ ছেড়ে। তার আলো অরণ্যের মাথা ছুঁয়ে লুটিয়ে পড়ছে রাঙা মাটির পথের ধুলোয়। বোঁদা নারীরা খানিক পরেই অদৃশ্য হয়ে গেল পথের বাঁকে। কেবল বহ্নিদের চোখজুড়ে ভেসে রইল তাদের বাহুল্যবর্জিত উলঙ্গ প্রতিচ্ছবি। তাদের নিরাভরণ সংগীতের অলংকারহীন মূর্ছনা। (চলবে)