ভাই ও মনিরের ঈদ
ও সুমনের মা, শুনছনি?
: কী?
: ওই রহমানের বউয়ের নাকি আবার বাচ্চা হইব!
: ছি ছি ছি, কী কন আফা!
: হু, বেডার আক্কেল আছে, কও তো দেহি কেমনে পারল বউয়ের ওপর এমন অত্যাচার করতে, এই বউ আর বাঁচব? অভাবের সংসারে নিজে খাইতে পায় না তারপর আবার পাঁচ পাঁচটা বাচ্চা। বছর বছর বাচ্চা দিতে যাইয়া বউটার মরণের অবস্থা। বছরও তো ঘুরল না। বউটা যে ব্রেন স্ট্রোক কইরা বিছানায় পইড়া আছে, যেটুকু চিকিৎসা হইছে তা–ও তো সেই বাপের বাড়ি থেইক্কা করছে।
: কী আর কমু আফা, বউ চলতে পারে না, কাম করতে পারে না, এর মধ্যেই অহন আবার বাচ্চা হইব।
: যাক মরুক বাঁচুক, জামাই যে আবার বিয়া করব না এইটুকুই অহন বউটার সান্ত্বনা!
: আহা, কী রূপসী বউ আছিল আর অহন কী কঙ্কাল হইছে, দেখলেই মায়া লাগে।
দুই
: ও সুমনের মা, শুনছনি, পোলা হইছে গো পোলা, আল্লাহ কী সুন্দর বাচ্চাটা! গরিবের ঘরে আল্লাহ রাজপুত দিছে গো, রাজপুত। একদম পুতলার মতো দেখতে।
: কার কথা কন।
: অই যে রহমানের বউয়ের কথা কই।
: অহ, তা কহন হইল, বউটা আছেনি?
: আছে ভালোই, গরিবের প্রাণ অত সহজে মরে না। আহা, কী সুন্দর বাচ্চা, দেখলেই পরান জুড়াই যায়।
তিন.
মনিরের মন আজ খুব খুশি। বাড়ি থেকে খবর আসছে তার আরেকটা ভাই হইছে। লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে বারবার হাতের ব্যাগটা স্পর্শ করে আর পানির দিকে তাকিয়ে ভাবে আজকে লঞ্চটা একটু বেশি ধীরে ধীরে চলতাছে। বিয়ে বাড়ির গেট সাজানোর কাজ করে মনির। ভাই হওয়ার কথা শুনেই মালিকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে রওনা দিয়েছে।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই নাকে ধূপের গন্ধে মনিরের মনটা দারুণ খুশি হয়ে যায়। মা মা করে ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরের গরম চুলায় হাত–পা আগুনে ছেঁকে সোজা মায়ের রুমে চলে যায়। স্যাঁতসেঁতে আর অন্ধকার রুমে মনির জড়সড় একটা অবয়ব দেখতে পায়। তাকে দেখতে পেয়ে উঠে বসার চেষ্টা করছে।
: ও মা, ও মা আমার ভাই কই। দেখ আমি আমার ভাইয়ের জন্য কী আনছি।
: বাজান তুই, এই সময় কহন আসলি?
: হু, ভাইয়ের কথা শুইন্না মালিকেরে কইয়া চইলা আইছি। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েই মনির অস্থির কণ্ঠে বলে, ভাইয়েরে দেও কোলে।
আধো আলোয় মনির দেখতে পায় তার মায়ের মুখে বেদনা মিশ্রিত লজ্জিত হাসি।
মা বলে, তুই হাত, মুখ ধুইয়া আয়, আমি খাওন দিই।
: পরে খামুনে, ভাইয়েরে আগে দেও।
: বাজান, তোর ভাইয়েরে তো পালক দিয়া দিছি!
: মা কী কস! না, না, কেন দিলি, কারে দিলি, কই দিলি!
: দেখস না, তোর মায়ে অসুস্থ, কিছু করতে পারি না, আর তোর বাপেরও তো কামকাজ নাই, কে খাওয়াইব, কেমনে বাঁচামু, তাই দিয়া দিছি। এরা অনেক বড়লোক, ওইখানে তোর ভাই ভালো থাকব।
: আমার ভাইয়েরে আমি খাওয়াইতাম, আমি পালতাম। আমি কিছু জানি না আমারে আমার ভাই আইন্না দে। মা এই দেখ, আমি আমার ভাইয়ের জন্য জামাকাপড় কিনছি, কোলবালিশ কিনছি, একটা ঝুনঝুনিও কিনছি।
মনির মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে আর বলছে আমারে আমার ভাই আইনা দে।
মনিরের কান্নায় আশপাশের লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। সবাই ছেলেটাকে বোঝাচ্ছে। কিন্তু মনির কারও কথা শুনছে না।
মনিরের বাবা এলে সবাই বলে মনিরকে নিয়ে একবার ওই বাড়ি গিয়ে ভাইকে দেখিয়ে নিয়ে আসতে। কিন্তু মনিরের বাবা কী করবে বুঝতে পারে না। কারণ, যারা পালক নিয়েছে তারা রহমানের ছেলেকে নেওয়ার সময় শর্ত দিয়েছিল ছেলেকে দেখতে কখনো আসতে পারবে না।
মনিরকে সামলাতে না পেরে সন্ধ্যার দিকে রহমান মনিরকে নিয়ে সেই বাড়ি যায়। ছেলেকে এভাবে কাঁদতে দেখে রহমানের প্রথমবারের মতো নিজেকে অপরাধী মনে হয়। কয়টা টাকার লোভে ছেলেটারে অন্যের হাতে তুলে দিলাম। আবার নিজেকে বোঝায় না দিলে কে পালত। বউ তো নিজেই চলতে পারে না। আর অভাবের সংসার, এখানে তো পোলা অনেক ভালো থাকব।
বেশ রাত হয়ে যায় পৌঁছাতে।
মনিরের বাবা তাদের খুব করে বুঝিয়ে বলেছে এই–ই শেষ, আর আসবে না। আর তারাও ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে।
মনির বাইরের রুমে অস্থির হয়ে ভেজা চোখে ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। ছোট্ট বাচ্চার কান্না আর টুকটাক শব্দ এই ঘর থেকেই সে শুনতে পাচ্ছে।
একটু পর একজন মহিলা মনিরের কোলে তার ভাইকে দিয়ে বলল শক্ত করে ধর, যেন পড়ে না যায়!
মনির ভাইকে কোলে নিয়ে সহজ স্বরে বলল, ‘দেখ ভাই তোর জন্য কী আনছি, এই যে জামা, কোলবালিশ, ঝুনঝুনি।’ বাচ্চাটা একটু কেঁদে উঠল অমনি মহিলাটি মনিরের ভাইকে নিয়ে চলে গেল।
আসার সময় পুরো রাস্তা মনির কাঁদতে কাঁদতে এল। মনিরের বাবার কষ্ট হলেও চোখ ভেজেনি। অভাবী সংসারের পুরুষদের আবেগ, চোখের পানি এসব আসে না।
চার.
প্রায় ১৩–১৪ বছর আগের ঘটনা। মনির নিজেও তখন মাত্র ১০–১১ বছরের ছেলে ছিল। মনিরের বাবা বেঁচে নেই। রোগশোকে কঙ্কালসার মা আজও বেঁচে আছেন।
প্রতি ঈদে পরিবারের অন্যদের জন্য ঈদের জামা কেনার সময় মনির আজও তার সেই ছোট ভাইয়ের বয়স হিসাব করে। তার জন্যও অনেক সময় ধরে জামা দেখে। দোকানদার জিজ্ঞেস করে বয়স কত। মোটা না চিকন, গায়ের রং কেমন?
মনির হিসাব করে একটা বয়স বলে। কিন্তু আর কিছু বলতে পারে না।
কোনটা ভাইকে মানাবে ঠিক বুঝতে পারে না। সেই রাতে ঝাপসা চোখের জন্য সে তো ভালো করে ভাইকে দেখেইনি। দোকানদারের বিরক্ত মুখ দেখে সে হাঁটতে থাকে আর আনমনে ভাবে, ইস্ সেদিন ভাইয়ের নামটাও সে জিজ্ঞেস করে নাই।
...
শারমিন আকতার: শিক্ষার্থী: ইউনিভার্সিটি অব গিজেন, জার্মানি।