লেসভস দ্বীপের শরণার্থী শিবিরে

মরিয়া ক্যাম্প। ছবি: লেখক
মরিয়া ক্যাম্প। ছবি: লেখক

এ বছরের এপ্রিল মাসে আমার গ্রিসের লেসভস (Lesbos) দ্বীপে শরণার্থী নিয়ে একটা গবেষণাকাজে যাওয়ার সুযোগ হয়। দ্বীপটার অবস্থান গ্রিসের অ্যাজিয়ান সাগরে। সমুদ্রপথে তুরস্ক থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৬ কিলোমিটার। দ্বীপটা তুরস্কের এত কাছে যে, ম্যাপে দেখলে তুরস্কেরই একটা দ্বীপ বলে ভ্রম হয়। লেসভসসহ গ্রিসের অ্যাজিয়ান সাগরে অবস্থিত বেশ কয়েকটি দ্বীপে তুরস্কে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীরা ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাবারের নৌকায় পাড়ি দিয়ে আসা শুরু করে। নৌকা ডুবে মৃত্যুবরণের ঘটনাও সে সময়ে বেশ কয়েকবার ঘটেছে। এর মধ্যে নৌকা ডুবে চার বছরের শিশু আয়লান কুর্দির মৃত্যুর ঘটনা সে সময়ে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল।

লেসভস দ্বীপ সে সময়ে ছিল তুরস্ক থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আসা শরণার্থীদের প্রধান গন্তব্য। লেসভস থেকে তারা গ্রিসের মূল ভূখণ্ডে পৌঁছে ইউরোপের অন্য দেশে পাড়ি জমানো শুরু করে। ২০১৫ সালের মতো না হলেও দ্বীপটাতে এখনো শরণার্থী আসা বন্ধ হয়নি। বর্তমানে সেখানে মরিয়া (Moria) ও কারা টেপে (Kara Tepe) নামে দুটো শরণার্থী ক্যাম্প আছে। আমার সুযোগ হয়েছিল ক্যাম্প দুটি দেখার এবং এ নিয়ে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে মতবিনিময়ের।

উল্লেখ্য, গবেষণার জন্য এর আগে আমার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে যাওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া সুযোগ হয়েছিল জার্মানিতে একজন শরণার্থী ক্যাম্প পরিচালকের কর্মস্থল পরিদর্শনের। মরিয়া ও কারা টেপে ক্যাম্প পরিদর্শন আমার শরণার্থী ক্যাম্পবিষয়ক অভিজ্ঞতাকে অনেক বাড়িয়েছে সন্দেহ নেই।

মরিয়া ক্যাম্প। ছবি: লেখক
মরিয়া ক্যাম্প। ছবি: লেখক

বলে রাখা ভালো, জনসংখ্যার দিক থেকে কুতুপালং ক্যাম্প পৃথিবীর বৃহত্তম ক্যাম্প, যেখানে এখন প্রায় আট লাখের মতো শরণার্থী বসবাস করছে। মরিয়া ও কারা টেপে সে তুলনায় অনেক ছোট। শরণার্থীর সংখ্যা সেখানে যথাক্রমে মাত্র ৫ হাজার ও ২ হাজার। এই দুটো ক্যাম্প হলো, যাকে বলা যায় ট্রানজিট ক্যাম্প। এই ক্যাম্পগুলো থেকে শরণার্থীদের যাচাই–বাছাইয়ের কাজ করা হয়। সন্তোষজনক হলে তাদের অনুমতি দেওয়া হয় গ্রিসে মূল ভূখণ্ডে প্রবেশের। না হলে তাদের মাসের পর মাস ক্যাম্পে পড়ে থাকতে হয় অথবা ফিরে যেতে হয় নিজ দেশে।

আকারে ছোট হলেও মরিয়া ক্যাম্পের দুর্নাম আছে ইউরোপের নিকৃষ্টতম শরণার্থী শিবির হিসেবে। এর কারণ ক্যাম্পে বসবাসরত শরণার্থীদের নিজেদের মধ্যে প্রায়ই মারামারির ঘটনা। এ ছাড়া অব্যবস্থাপনা তো আছেই। বর্তমানে ৫ হাজারের মতো শরণার্থী থাকলেও এর প্রকৃত ধারণক্ষমতা ৩ হাজারের মতো। ক্যাম্পের মূল অংশ উঁচু দেয়াল ও কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। তাই বাইরে থেকে অনেকখানি বন্দিশিবিরের মতো মনে হয়।

মরিয়া ক্যাম্প। ছবি: লেখক
মরিয়া ক্যাম্প। ছবি: লেখক

একসময় মরিয়ার জনসংখ্যা ১০ হাজারের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত হওয়ার কারণে অনেকেই ক্যাম্পের বাউন্ডারির বাইরে তাঁবু টানিয়ে থাকা শুরু করেন। সে তাঁবুগুলো এখনো আছে এবং অনেকে সেখানেই থাকা পছন্দ করেন। ২০১৫ সালের দিকে আসা শরণার্থীদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল সিরিয়ান। বর্তমানে বেশির ভাগ শরণার্থী আফগান। আফগান মানে এই না, তারা সবাই আফগানিস্তান থেকে এসেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলা যুদ্ধের কারণে আফগানরা আগে পাকিস্তান, ইরানসহ মধ্য এশিয়ার অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছিল। আমি ক্যাম্পে কর্মরত একজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, এই আফগানরা আসছে মূলত ইরান থেকে। আফগান ছাড়াও ক্যাম্পে আছে আফ্রিকা থেকে আসা শরণার্থীরা। ক্যাম্পে দু-একজন বাংলাদেশিও আছে শুনেছি, তবে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি। শরণার্থীদের অনেকেই যুবক বয়সের। তবে আমি ক্যাম্পে অনেক শিশুকেও খেলা করতে দেখেছি।

মরিয়ার তুলনায় কারা টেপে বেশ চমৎকার ও পরিচ্ছন্ন। কারা টেপেকে শিশু ও পরিবার নিয়ে বসবাসের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। সেখানে আছে শিক্ষা, খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ। আমার স্বচক্ষে সেখানে একটা বাদ্যযন্ত্র প্রশিক্ষণের ক্লাস দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।

মরিয়া ও কারা টেপে থেকে শরণার্থীরা অনুমতি নিয়ে বাইরে যেতে পারে। তবে তাদের দ্বীপ ত্যাগের অনুমতি নেই। লেসভসের রাজধানী মিটিলিনি থেকে মরিয়ার দূরত্ব গাড়িতে করে প্রায় ৪০ মিনিটের মতো। কারা টেপের দূরত্ব প্রায় ২০ মিনিট। দুটো ক্যাম্প থেকেই বাসে করে শরণার্থীরা রাজধানীতে আসতে ও ফিরে যেতে পারে। এই দুটো ক্যাম্প ছাড়াও লেসভসে আরও কয়েকটা ছোট ছোট শিবির আছে। এ ছাড়া অনেক শরণার্থী মিটিলিনিতেই থাকে। আমি পুরো মিটিলিনি শহরজুড়েই শরণার্থীদের পরিবার ও শিশু নিয়ে ঘুরতে দেখেছি।

লেসভস মন কেড়ে নেওয়ার মতো সুন্দর একটা দ্বীপ। দ্বীপের অর্থনীতি মূলত নির্ভর করে জলপাই তেলের বাণিজ্যের ওপর। এ ছাড়া আছে পর্যটন ও মাছ ধরা। জলপাই বাগানের দেখা মেলে পুরো দ্বীপজুড়ে। এ ছাড়া আছে লেবু আর কমলাগাছের সমাহার। প্রত্যেক বাসার বাগানে ফলগুলোকে থোকায় থোকায় ঝুলতে দেখা যায়। লেসভসের মানুষ উদার ও অতিথিবৎসল। আপন মনে করে কাউকে কিছু দিতে তাদের আপত্তি নেই। প্রথম প্রথম যখন শরণার্থীদের আগমন শুরু হয়েছিল তখন তাদের অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। শরণার্থীদের আগমনের মূল স্থান দ্বীপের উত্তরে, যেখানে থেকে সমুদ্রপথে তুরস্কের দূরত্ব সবচেয়ে কম। সেখানে পৌঁছে মরিয়া ক্যাম্প পর্যন্ত পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে প্রায় এক দিনের মতো লেগে যায়। সে যাত্রার সময় অনেক স্থানীয় লোকই খাবার ও পানি দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু এখন অনেকেই শরণার্থীদের নিয়ে শঙ্কিত। সম্প্রতি শরণার্থীদের বিপক্ষে মিটিলিনিতে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। পাশাপাশি বাড়ছে অসন্তোষ পুরো গ্রিসজুড়েই।

মরিয়া ক্যাম্প। ছবি: লেখক
মরিয়া ক্যাম্প। ছবি: লেখক

এই পরিবর্তনের সঙ্গে মিল আছে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বাংলাদেশিদের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গেও। রোহিঙ্গা সংকটের শুরুর দিকে বাংলাদেশিদের অনেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিশেষ করে অগ্রগণ্য ছিলেন কক্সবাজারের স্থানীয় লোকজন। কিন্তু এখন অনেকেই শঙ্কিত নিজেদের জীবন ও জীবিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে।

আসলে এ দুই ক্ষেত্রেই সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে শরণার্থী সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে। শরণার্থী শিবিরে থাকা মানুষদের কাজের কোনো সুযোগ নেই। কাজেই তাদের মধ্যে অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়। লেসভসে বেশ কয়েকজন আমাকে শরণার্থীরা চুরিসহ অন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়া শরণার্থীদের মধ্যে স্থানীয়দের চাওয়া–পাওয়া ও সংস্কৃতি বোধ উপেক্ষা করার অভিযোগ আছে।

শরণার্থী শিবিরে যাঁরা মানবিক সহায়তা দেওয়ার কাজ করেন তাঁরা প্রাধান্য দিয়ে থাকেন শরণার্থীদেরই। স্থানীয়দের মতামতকে উপেক্ষা করা হয়। মাঝেমধ্যে স্থানীয়দের ওপর বর্ণবাদী ও অহেতুক বিদেশি আতঙ্কে ভুগছে জাতীয় তকমা লাগিয়ে দেয়। এতে যাঁরা সত্যিকার অর্থেই উদার মনোভাবাপন্ন তাঁরা দূরে সরে যান। এ জন্য আমি মনে করি যে শরণার্থী শিবিরের কর্ম পরিচালনার কেন্দ্রে থাকতে হবে স্থানীয় লোকজনের মতামত প্রকাশ ও অংশগ্রহণের সুযোগ। শরণার্থীদের মধ্যে সৃষ্টি করা দরকার আশ্রয়দানকারী দেশের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রকাশের মনোবৃত্তি।

মরিয়া ক্যাম্প। ছবি: লেখক
মরিয়া ক্যাম্প। ছবি: লেখক

ইউরোপে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত আছে, এই শরণার্থীরা মূলত অর্থনৈতিক অভিবাসী মানে তারা সত্যিকার অর্থে শরণার্থী নয়। এ কথা যারা বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছে তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে লেসভসে আমি যাদের দেখেছি তাদের বেশির ভাগকেই এই দলে ফেলব না, কারণ শরণার্থীদের মধ্যে অনেকেই যুবক বয়সের হলেও শিশুসহ পরিবারের সংখ্যাও কম নয়।

ভেবে দেখুন, আফগানিস্তান, ইরান, পাকিস্তান হয়ে লেসভসে আসতে তাদের কতটা দূরত্ব পাড়ি দিতে হয়েছে? বাধ্য না হলে কি কেউ পরিবার–পরিজন নিয়ে এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ দূরত্ব পাড়ি দেয়? একই কথা প্রযোজ্য যারা যুবক বয়সী তাদের ক্ষেত্রেও। যুবকদের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিবার নিয়ে থাকে। পুরো পরিবার শরণার্থী হওয়ার আগে প্রথমে সবচেয়ে সমর্থ যুবকদের পাঠানো হয় আশ্রয়স্থল খুঁজে পাওয়ার জন্য। এরপর পাড়ি জমায় পরিবারের বাকিরা। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে অবশ্য এর বিপরীত ঘটেছে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে দলে দলে এসেছে নারী-শিশু মিলে, শুধু প্রাণটা বাঁচানোর তাগিদে। পরিকল্পনা করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের শরণ গ্রহণ ঘটেনি।

লেসভসে আমার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্যও প্রযোজ্য হতে পারে। শরণার্থী সংকটের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য মিটিলিনিতে ইউনিভার্সিটি অব অ্যাজিয়ানের অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রিফুজি অবজারভেটরি। এই অবজারভেটরি গবেষণার পাশাপাশি আজিয়ান সাগরে শরণার্থীদের গতিবিধি, গবেষণা ও সংবাদের তথ্যকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। এই অবজারভেটরি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকায় একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে থাকে। গ্রিসসহ ইউরোপের অন্য দেশগুলো ও মানবিক সাহায্য প্রদানকারী সংস্থাগুলো প্রয়োজন মতো এদের কাছ থেকে পরামর্শ ও তথ্য নিতে পারে।

আমি যত দূর জানি রোহিঙ্গা সংকট পর্যবেক্ষণে এ রকম কোনো স্বাধীন প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত নয়। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে পরামর্শ ও তথ্য যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না। তাই বঙ্গোপসাগরে শরণার্থী সংকট পর্যবেক্ষণে একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োজিত করা প্রয়োজন, যার কাছ থেকে বাংলাদেশ সরকার প্রয়োজনে তথ্য ও পরামর্শ নিতে পারবে।

সব মিলিয়ে লেসভস দ্বীপের ক্যাম্প পরিদর্শন বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকটকে গ্রিসের শরণার্থী সংকটের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের যাঁরা রোহিঙ্গা সংকটের ওপরে কাজ করছেন তাঁদের বাংলাদেশের সংকটকে বৈশ্বিক শরণার্থী সংকটের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার প্রচেষ্টা করতে হবে। শরণার্থী সংকট বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রধান সংকট। এই সংকটকে জানা ও বোঝার চেষ্টা জরুরি। জরুরি শরণার্থীরা যেখানে আশ্রয় নিচ্ছে সেখানকার মানুষের চাহিদাকে জানার ও বোঝার চেষ্টার। এতে যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তা নয়, কিন্তু কিছুটা হলেও শরণার্থী সংকটকে ঘিরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে রাজনৈতিক সংকট দেখে দিচ্ছে আশা করি তার কিছুটা নিরসন ঘটবে।
...

ড. মেহেদী মাহমুদ চৌধুরী: যুক্তরাজ্যের বোর্নমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যাপনা করেন।