আমি সাহায্য করি, আপনিও করুন

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমি অস্ট্রেলিয়ায় আসি ২০০৯ সালের ৪ অক্টোবর। সিডনি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পা রাখতেই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্যারের কথা মনে পড়ল। তিনি বলতেন, যেদিন বিদেশের মাটিতে পা রাখবে, সেদিন থেকে তোমার সবকিছু নিজে নিজেই করতে হবে।

রাশেদ ভাই যিনি আমাকে পিক করলেন এয়ারপোর্ট থেকে, খুব অল্প পরিচিত ছিলেন আমার। অনেক কষ্ট করলেন আমার জন্য। শীতের মধ্যে তিনি নিজে ফ্লোরে ঘুমাতেন আর আমাকে থাকতে দিতেন বেডে। প্রথম কিছুদিন তাঁর অবদান অনেক।

তারপর থাকতে শুরু করলাম শেয়ার অ্যাকোমোডেশনে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টসদের সঙ্গে। সেখানে শুরু হলো আমাকে নিয়ে জেলাসি আর নানা রকম দুর্ব্যবহার। থাক এ সম্পর্কে আর বলব না। বেচারীরা পড়াশোনা আর পার্টটাইম কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। পিআর হয় না। তাই তাদের হিংসা থাকাটা স্বাভাবিক ছিল।

অল্প কিছুদিন পরে পরিচয় হয় সায়েম ভাইয়ের সঙ্গে। পার্কে ঘুরতাম। সময় পেলে সিটিতে একা ঘুরতাম। সায়েম ভাই বেশ ভালো মেন্টাল সাপোর্ট দিতেন। ভালো লাগত। আমার বন্ধু জুনাইদ মাঝেমধ্যে ফোন করত। তার সঙ্গে সিটিতে দেখা করতাম।

আমার বন্ধু রনি কয়েক মাস পর মিথিলার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। আমি আর মিথিলা কথা বলি। পরে সিডনি থেকে গোল্ডকোস্টে ওকে দেখতে আসি। মাত্র ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে আমাদের বিয়ে হয়। এ ব্যাপারে সায়েম ভাই আর রনির অবদান অনেক। সায়েম ভাই নিজে ফ্যামিলিসহ ড্রাইভ করে সিডনি থেকে ব্রিসবেনে এসেছিলেন।

মজার ব্যাপার হলো মিথিলাদের গোল্ডকোস্টের বাসা থেকে সিডনি যাওয়ার সময় ফ্লাইট মিস করেছিলাম। আমি আর সায়েম ভাই হোটেল ম্যানেজ করে রাতে ছিলাম। সেখানে আবারও সায়েম ভাইয়ের ভূমিকা। ইতিমধ্যে নিজের চেষ্টায় পার্টটাইম কাজ পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার পিআর ছিল। তাই পার্টটাইম কাজের জন্য কেউ হেল্প করতে চাইত না।

বিয়ের পরে আমি সিডনি থেকে ব্রিসবেনে চলে আসি। মিথিলা গোল্ডকোস্ট থেকে ব্রিসবেনে। শুরু হয় আমাদের নতুন সংসার। একটা এক বেড রুমের ইউনিট, টয়লেট ও বাথ। আমি পার্টটাইম কাজ করতাম। আর মিথিলা তার আর্লি ক্যারিয়ার লেভেলের ফুল টাইম কাজ করত। কিন্তু সময় যতই যেতে লাগল, ব্রিসবেনের প্রফেশনাল জব মার্কেট ততই নিচে নামতে থাকল।

যেহেতু আমি সিডনিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অ্যাপ্লাই করে চলে এসেছি, সেগুলো থেকে কল আসতে শুরু করল। বারবার সিডনি যাওয়া আমি ভালো মনে করলাম না। ব্রিসবেনে অনেককেই আমি সিভি দিলাম ও অ্যাপ্লাই করলাম। আবার কাউকে তাদের সিভির কপি কিংবা আমার সিভি দেখে দিতে বলতাম। দুর্ভাগ্যবশত কেউ কোনো ফিডব্যাক দিতে চাইতেন না। তাঁদের নিজেদের কোনো কপি আমাকে কেউ দিতেন না। শুধু বলতেন, ফরওয়ার্ড করে দিয়েছি।

ইউনিভার্সিটিতে আমার স্কলারশিপ তখনো হয়নি। আমার বাবা-মা আর আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন টেনশনে পড়ে গেলেন। যে এখনো ফুল টাইম জব হলো না?

কিছুদিন পর একটা ইন্টারভিউ দিলাম। অনেক ভালো ইন্টারভিউ হলো। অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশে রেফারেন্স চেকের পড়েও চাকরি হলো না। কারণ, কোম্পানিটি প্রজেক্ট পায়নি। আবারও আপসেট হয়ে পড়লাম। আরও কিছুদিন পর এমএসের স্কলারশিপ পেলাম। প্রথম বলল দুই বছর, পরে বলল এক বছর। চার মাস স্কলারশিপ পাইনি ২৪ মাসের মধ্যে। বেশ কষ্ট করেছি।

রিটেলে রাতের বেলায় কাজ, দিনে রিসার্চ আর নতুন বউকে সময় দেওয়া, আমার জন্য বেশ চ্যালেঞ্জ ছিল। তা ছাড়া প্রায় ছয় বছর স্টাডির বাইরে থাকায় রিসার্চ স্টাডি করার ছন্দ খুঁজে পেতে বেশ সময় লেগেছিল।

যাহোক, এমএস ঠিক দুই বছরে শেষ করে চাকরি পেলাম। এই চাকরির সোর্স দিয়েছিলেন এক বড় ভাই। তাঁর অবদানের কথা কখনো ভুলব না। শুরু হলো আমার নতুন যাত্রা। যদিও প্রথম ছয় মাস সুখকর স্মৃতি নেই এই চাকরির।

কয়েক বছর পর ভাবতে শুরু করলাম প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্টের জন্য। বেশ কয়েকজনের কাছে হেল্প চেয়েছিলাম, পাইনি। আর যে কথাগুলো তাদের কাছে থেকে শুনেছিলাম, তাতে ডিমোটিভেটেড হইনি। মাঝে দু-তিনটি ইন্টারভিউ দিয়েছি। অপমানিতও হয়েছি। পরে বুঝেছিলাম, এসব কোম্পানিতে চাকরি না হয়ে আমার জন্য ভালোই হয়েছিল। তা ছাড়া ইন্টারভিউর প্রস্তুতির জন্য ভালো লেসন পেয়েছিলাম।

অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আরেকটু ভালো জায়গায় চাকরি পেলাম। আরও কষ্ট করেছি। করে ফেললাম চার্টার্ড প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং (সি পেং)। যুক্ত হলাম বিভিন্ন প্রফেশনাল বডির সঙ্গে। আমার বাচ্চা মেয়ে মৃণ্ময়ীকে নিয়ে আমার স্ত্রী মিথিলার ফ্যামিলি সাপোর্ট ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমাকে অনেক সিপিডি ইভেন্টে যেতে হয়েছে অফিসের পরে।

২০১৬ সালে প্রথম আমার চিন্তা আসে, কীভাবে বাংলাদেশিদের প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্টে সাহায্য করা যায়। ভাবলাম আমি যদি পারি, অন্যরাও পারবে। তাই আমি ভাবলাম, সিভি, কভার লেটার, সিলেকশন ক্রাইটেরিয়া, নেটওয়ার্কিং, ক্যারিয়ার মেন্টোরিং—এগুলো নিয়ে বাংলাদেশিদের সাহায্য করব।

নিউটন ভাই শুরু থেকেই সাপোর্ট আর উৎসাহ দিয়ে এসেছেন। জেডি ভাই বিভিন্নভাবে সাহায্য–সহযোগিতা করেছেন এবং সঙ্গে আছেন। ব্রিসবেনে আমার বুয়েটিয়ান বড় ও ছোট ভাইসহ বাংলাদেশিদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আজ পর্যন্ত চারটি ওয়ার্কশপ আয়োজনে বুয়েটিয়ানদের ভূমিকা অনেক।

গত ওয়ার্কশপ প্রথমবারের মতো ব্যাব (BAB) যৌথভাবে বুয়েটিয়ানদের সঙ্গে ওয়ার্কশপ আয়োজন করেছিল। তা ছাড়া আগের ওয়ার্কশপগুলোতে GUBA, UQBDA, Brisbane e Bangladeshi Group, BCA-Brisbane, BEAPQA ভেন্যু থেকে শুরু করে নানাভাবে সাহায্য–সহযোগিতা করে এসেছে।

ওয়ার্কশপ বিভিন্ন সময় স্পিকার ও নানাভাবে–সহযোগিতা করেছিলেন ড. তপন সাহা, রন ভাই, চন্দন, আলামিন, নাজনীন, বাসার ভাই, আহমদ হোসাইন ভাই, নুরে আলম ভাই, জুবায়ের ভাই, জেডি ভাই, উপল ও চাঁদনি। প্রতিটি ওয়ার্কশপের পরে ব্রিসবেন বাংলা রেডিওতে ওয়ার্কশপ নিয়ে কিছু কথাবার্তা ছিল আমার। ব্রিসবেন বাংলা রেডিওর সুজন ভাই, শাদীদ, সুমিত ও শিল্পী আন্টির অনেক অবদান এই ক্যারিয়ার টক শোর জন্য।

ভবিষ্যতে আরও ক্যারিয়ারবিষয়ক ওয়ার্কশপ ও রেডিও প্রোগ্রাম হবে ব্রিসবেনে। আপনাদের সহযোগিতা বিশেষভাবে কামনা করছি। এই যে আমি বাংলাদেশিদের সহযোগিতা পেয়েছি তা যেমন ভালো ছিল আমার জন্য; যাদের কাছে থেকে পাইনি, তা আমাকে আরও বেশি পরিশ্রম করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এসব থেকেই আমি আহ্বান জানাই, আমরা বাংলাদেশি, আমরা সাহায্য করি। আমি করি, অন্যরাও করেন।