আমেরিকার স্কুল

ব্রুস্টার হাইস্কুলের হল অব অনার
ব্রুস্টার হাইস্কুলের হল অব অনার

আমার এক ফেসবুক বন্ধু অনুরোধ করেছিলেন, আমার বর্তমান কর্মসূত্রে আমি যেখানেই যাই, যেন তাঁর জন্য ছবি তুলি। কিছুদিন আগে আমি একটি স্কুলে গিয়েছিলাম। হাইস্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে–কলমে নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের কৌশল শেখাতে।

শেখানোর এক ফাঁকে ঘণ্টাখানেকের বিরতি ছিল। এই বিরতিতে ভাবলাম আমার বন্ধুর অনুরোধ রক্ষা করি। অনুরোধ রক্ষার সময় আমি লক্ষ করলাম, নিজের অজান্তে আমি বাংলাদেশের দৃষ্টি দিয়ে স্কুলের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় দেখতে শুরু করেছি। আর বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও আয়োজনের সঙ্গে আমেরিকার শিক্ষা কার্যক্রমের পার্থক্য বিবেচনা করছি।

যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলো কীভাবে পরিচালিত হয়, এ নিয়ে লেখার ইচ্ছা ছিল বহু আগে। কিন্তু লিখতে পারিনি। নিজের বাচ্চাকে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ছিলাম একজন অভিভাবকের ভূমিকায়।

ব্রুস্টার হাইস্কুল
ব্রুস্টার হাইস্কুল

কিছুদিন থেকে হাইস্কুল ড্রাইভিং এডুকেশন প্রোগ্রামে যুক্ত হয়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিশেছি ও কথা বলেছি। অনুভব করেছি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষায় প্রণোদনার বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে আমাদের স্কুল-কলেজগুলোতে এই প্রণোদনার বিষয়টি কতটা উপেক্ষিত থাকে।

প্রণোদনা ছাড়াই আমরা আমাদের সন্তানদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ফল আশা করি। বিদ্যালয়ে শিক্ষক থেকে বাড়িতে অভিভাবক পর্যন্ত সবাই সন্তানকে কেবল ডাক্তার-প্রকৌশলী-উকিল-আমলা বানাতে চাই। কেবল মানুষ বানানোর আয়োজন ছাড়া। ‘মানুষ’ বানাতে চাইলে প্রণোদনা দিতে হয়। আমরা কাউকে, এমনকি নিজের সন্তানকেও প্রণোদনা দিতে অভ্যস্ত নই।

সেদিন আমি যে স্কুলে গেলাম, এটির নাম ব্রুস্টার হাইস্কুল। আমার বাসা থেকে ৪০ মিনিটের পথ। ৫০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। আগের দিন ডজনখানেক একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। সেদিন দিতে হবে অন্তত ছয়জনকে।

কানেকটিকাটের স্যান্ডিহুক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুটিংয়ে নিহত ২৮ জনের স্মরণে স্মৃতিপাথর
কানেকটিকাটের স্যান্ডিহুক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুটিংয়ে নিহত ২৮ জনের স্মরণে স্মৃতিপাথর

আমি স্কুলের মূল দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছি। একজন অভ্যর্থনাকর্মী আমাকে স্বাগত জানালেন। এরপর আমার বন্ধুর অনুরোধ রক্ষার্থে আমি মুঠোফোনে কিছু ছবি তুলছি।

প্রথম যে ছবিটা তোলার জন্য স্কুলের এক শিক্ষিকাকে অনুরোধ জানালাম, সেটি নিজের। সাধারণত আমি শার্টের সবগুলো বোতাম লাগিয়ে চলাফেরা করি। সেদিন বসন্তের বিকেলে চনমনে বাতাসে ওপরের বোতামটা কখন যে খুলে ফেলেছি, তা নিজেই খেয়াল করিনি! ছবি তোলার পর ঠাওর হলো।

যাক গে, নিজের মুঠোফোনে প্রথম যে ছবিটা তুললাম, সেটি স্কুলের পারফর্মিং আর্ট অর্থাৎ ললিতকলায় এতকাল যারা ভালো করেছে তাদের কাজের স্বীকৃতি। সেগুলো যেমন ড্রামা, বেহালা বাদন, গিটার বাদন, ব্যান্ড-ড্রাম, গান, মিউজিক ইত্যাদি।

স্কুলের পারফর্মিং আর্ট অর্থাৎ ললিতকলায় যারা ভালো করেছে তাদের কাজের স্বীকৃতি
স্কুলের পারফর্মিং আর্ট অর্থাৎ ললিতকলায় যারা ভালো করেছে তাদের কাজের স্বীকৃতি

এরপরের ছবিটি এতকাল যারা খেলাধুলা, ফিল্ড ট্র্যাক ইত্যাদিতে পুরস্কার পেয়েছে তাদের স্বীকৃতি। বলে রাখা ভালো, স্কুলে প্রবেশের এই মেইন লবিটির নাম রাখা হয়েছে ‘হল অব অনার’। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব স্কুল, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, হাইস্কুল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়, সবার প্রবেশমুখেই দেখা যাবে হল অব অনার। সঙ্গে দেখা যাবে দেশটির জাতীয় পতাকা হয় সিলিং থেকে ঝোলানো, নয়তো ঢাউস সাইজের কোনো ফলকে।

এবার আমি লবি থেকে দরজা ঠেলে বাইরে এলাম। একটি মজার জিনিস লক্ষ করলাম, কয়েকটি টাইম ক্যাপসুল। এসব ক্যাপসুলের ভেতর নিশ্চয় মজার কিছু লুকিয়ে আছে। এগুলো স্থাপন করেছে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন ব্যাচ।

একটি টাইম ক্যাপসুল খোলা হবে ২০৪৩ সালে। আরেকটি ২০৫৪ সালে। হয়তো দেখা যাবে ক্যাপসুলের ভেতর লুকিয়ে আছে এক হাজার ডলারের একটি রাষ্ট্রীয় বন্ড। ৫০ বছর পর এর মূল্যমান দাঁড়াবে ১ লাখ ডলারে। যে অর্থে সে সময় হয়তো আরও দশজন ছাত্রকে উচ্চতর শিক্ষার জন্য বৃত্তি দেওয়া যাবে।

এটি একটি গ্রামের হাইস্কুল। কিন্তু এখানকার ছাত্রছাত্রীরাও ২০০১-এর নাইন ইলেভেনকে স্মরণ করে স্মৃতিচিহ্ন রেখেছে। পাশাপাশি দুটি তক্তাপোষ। এই আসনগুলো স্মৃতিচিহ্ন হয়ে আছে নাইন ইলেভেন স্মরণে। এর পাশেই মার্বেল পাথরের আসন। দান করেছে ১৯৫৬ সালের স্কুল ব্যাচ। তাঁদের অনেকের বয়স নিশ্চয় এখন ৮০ বছরের বেশি।

পাশাপাশি আরেকটি স্মৃতিপাথর। ২০১২ সালে কানেকটিকাটের স্যান্ডিহুক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুটিংয়ে নিহত ২৮ জনের স্মরণে।

আমেরিকার স্কুলছাত্রদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ যায় পাবলিক স্কুলে। ২৫ শতাংশ প্রাইভেটে। পাবলিক স্কুল পরিচালনা তহবিলের ৮ শতাংশ জোগায় ফেডারেল সরকার। বাকি ৯২ শতাংশের মধ্যে ৪৭ শতাংশ আসে রাজ্য ও ৪৫ শতাংশ স্থানীয় সরকারের বাজেট থেকে। স্থানীয় সরকার এই অর্থ জোগান দেয় প্রোপার্টি ট্যাক্স থেকে। যেমন আমার ২ লাখ ডলারের বাড়ির জন্য প্রতিবছর আমাকে প্রোপার্টি ট্যাক্স দিতে হয় প্রায় ৬ হাজার ডলার।

একটি ছবিতে দেখতে পাবেন, স্কুলের প্রবেশমুখে বিছানো পাথুরে ইটে মানুষের নাম লেখা। তার মানে স্কুলে ছাত্রদের বৃত্তি প্রদান ও অন্যান্য কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিতে এরা দান করেছে। যদিও এটি একটি পাবলিক স্কুল। এর দায় কেন্দ্রীয় কিংবা রাজ্য সরকারের। কিন্তু স্থানীয় কমিউনিটিকেও যুক্ত করা হয়েছে স্কুল পরিচালনায়। বেশির ভাগ ইটে কোনো নাম লেখা নেই। তার মানে ভবিষ্যৎ ডোনারদের নাম লেখা হবে তাতে।

লেখক
লেখক

যুক্তরাষ্ট্রে প্রাইভেট স্কুলের সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার। এদের ৭৮ শতাংশ আবার মাদ্রাসা অর্থাৎ ক্যাথলিক ধর্মীয় স্কুল। পরিসংখ্যানে জানা যায়, প্রাইভেট স্কুলের লেখাপড়ার মান পাবলিক স্কুলের চেয়ে ভালো। এমনকি শিক্ষকের যোগ্যতার ব্যাপারেও।

আবার প্রাইভেট স্কুলগুলো ছাত্রদের কাছ থেকে কী পরিমাণ টিউশন ফি আদায় করবে তা–ও সিলিং করে দেওয়া আছে। এটি যেমন বছরে ৫ হাজার ডলার থেকে ২৫ হাজার ডলার পর্যন্ত। তবে গড়ে এর পরিমাণ ১০ হাজার ৭৪০ ডলার।

লেখাপড়ার মান যদি এভাবে দেখা হয়, তাহলে বলতে হবে পাবলিক স্কুল থেকে ৪০ শতাংশ ছাত্র উচ্চতর লেখাপড়ার জন্য কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। প্রাইভেট স্কুল থেকে যায় ৬৪ শতাংশ। ক্যাথলিক স্কুল থেকে এর পরিমাণ আরও বেশি অর্থাৎ ৭৮ শতাংশ। প্রাইভেট স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন রেট ৯৫ শতাংশ হলে পাবলিক স্কুলে সেটি প্রায় ৮০ শতাংশ।

এ লেখার ইতি টানছি একটি পরামর্শ রেখে। পরামর্শটি হলো, আমাদের বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে স্থানীয় কমিউনিটিকে জড়িত করা খুব প্রয়োজন। অভিভাবকেরা স্কুল কার্যক্রমে অংশ না নিলে পুরো কার্যক্রমই অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

আমি মনে করতে পারি, আমাদের হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়টি অনেক বনেদি। অর্থাৎ ১৮৮৩ সালে স্থাপিত। কিন্তু কোনো একটি দিনের জন্য আমার বড় ভাই কিংবা অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ। পরামর্শ শোনা তো অনেক দূরের পথ।
আর ছাত্রছাত্রীদের প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি শিক্ষকেরা কখনো আমলে নেন বলে মনে হয় না। তাঁরা সব সময় তাকিয়ে থাকেন সরকারের দিকে কিছু পাওয়ার আশায়। অথচ কমিউনিটিকে যুক্ত করলে স্কুল পরিচালনা আরও সহজ ও প্রাণবন্ত হয়। এই স্কুলগুলো থেকেই বেরিয়ে আসতে পারে আমাদের ভবিষ্যৎ–নেতৃত্ব।