মন্ট্রিয়েলে সৈয়দ আবু জাফর স্মরণে নাগরিক শোকসভা

বক্তব্য দিচ্ছেন কাবেরী গায়েন
বক্তব্য দিচ্ছেন কাবেরী গায়েন

বাংলাদেশে যাঁরা আদর্শবাদিতার ঝান্ডা সমুন্নত রেখে গণমানুষের মুক্তির আন্দোলনে আজীবন নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রয়াত কমরেড সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ ছিলেন অন্যতম। মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে ছোটবেলা থেকে সমাজতন্ত্রের যে দীক্ষায় তিনি উজ্জীবিত হয়েছিলেন, কোনো লোভ–লালসার কাছে সেই চেতনা তাঁর বিসর্জিত হয়নি। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও অসততার দাপটে সুস্থ ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার একেবারেই কঠিন হয়ে পড়া এই সময়টাতে এমন একজন রাজনীতিকের অকালমৃত্যু জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা সদ্যপ্রয়াত সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ স্মরণে মন্ট্রিয়েলে গত রোববার (২৩ জুন) অনুষ্ঠিত নাগরিক শোকসভায় বক্তারা এ মন্তব্য করেন। স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক ও গবেষক তাজুল মোহাম্মদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় বক্তারা বলেন, সহজ–সরল, সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই মানুষটির সমগ্র চিন্তাচেতনায় ছিল শোষণ বঞ্চনাহীন একটি সুষম সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক অবস্থা বিবেচনায় কাজটি সহজ নয় জেনেও তিনি তাঁর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি। তাঁরা এই সময়টায় তাঁর মতো সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনীতিকের খুব প্রয়োজন ছিল উল্লেখ করে বলেন, জাতির জন্য এটা দুর্ভাগ্যজনক যে একে একে আমরা এই ভালো মানুষগুলোকে হারিয়ে ফেলছি।

বক্তব্য দিচ্ছেন তাজুল মোহাম্মদ
বক্তব্য দিচ্ছেন তাজুল মোহাম্মদ

সভায় বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও লেখক ড. কাবেরী গায়েন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক এজিএস নাসিরুদ্দোজা, আওয়ামী লীগের কানাডা শাখার উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি শ্যামল দত্ত, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোহাম্মদ মহিবুর রহমান, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মৌলভীবাজার জেলা শাখার সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট ফণীন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য, প্রকৌশলী ড. সৈয়দ জাহিদ হোসেন, বিএনপির কানাডা শাখার সাবেক সভাপতি ফয়সল আহমদ চৌধুরী, অ্যাডভোকেট স্বপন কুমার দেব, ছাত্র মৈত্রীর সাবেক নেতা জিয়াউল হক জিয়া ও কমরেড সৈয়দ আবু জাফর আহমেদের ভাই সাবেক আমলা সৈয়দ আবু আজফার আহমদ।

সঞ্চালনা করেন উদীচীর মন্ট্রিয়েল শাখার সভাপতি ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মৌলভীবাজার জেলা শাখার সাবেক সভাপতি বাবলা দেব।

বক্তব্য দিচ্ছেন নাসিরুদ্দোজা
বক্তব্য দিচ্ছেন নাসিরুদ্দোজা

কাবেরী গায়েন বলেন, কমরেড আবু জাফর আহমেদ যে রাজনৈতিক আদর্শের মানুষ ছিলেন, আমিও মনেপ্রাণে সেই ধারাই লালন করি। সুন্দর সমাজ সাজানোর স্বপ্ন ছিল তাঁর মধ্যে। একটি মানবিক আদর্শের চেতনাকে আজীবন আঁকড়ে রেখেছিলেন তিনি। নানা প্রতিকূল-প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও জাফর ভাই বিশ্বাস করতেন, মেহনতি মানুষের মুক্তি কেবলই সমাজতন্ত্রের বিপ্লব দ্বারাই সম্ভব। তিনি বলেন, প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদাসমূহ পূরণ, সম–অধিকার, নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন সুদূরপরাহত রেখে শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন দিয়েই দেশ আর জাতির সমৃদ্ধি আসে না। তিনি বাংলাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ে দেশে–বিদেশে সব বিবেকবান ও প্রগতিশীল মানুষকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।

নাসিরুদ্দোজা বলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল যেভাবে কলুষিত হচ্ছে, প্রগতিশীলতার মুখোশ পরে প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকাণ্ড যেভাবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে, জাতি বিনাশী এই প্রক্রিয়া রোধ করতে হলে কমরেড জাফর ভাইয়ের মতো আদর্শিক মানুষের জাগরণ দরকার। কমরেড আবু জাফরকে আপাদমস্তক একজন নীতিনিষ্ঠ রাজনীতিক হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, সুষম সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাঁর অবদান জাতি চিরদিন মনে রাখবে।

শোকসংগীত পরিবেশনা
শোকসংগীত পরিবেশনা

ফণীন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য বলেন, কমরেড জাফর আহমেদ ও আমি একই শহরের মানুষ। বয়সে আমার ছোট হলেও একসময় একই সঙ্গে একই ধারার রাজনীতি করেছি। ফলে তাঁকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আদর্শে অবিচলতা, সততা, নিষ্ঠা ও ভদ্রতাবোধ ছিল অসাধারণ। শুধু রাজনীতি নয় মৌলভীবাজারের সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখতেও তাঁর ভূমিকার প্রশংসা করতে হয়।

শ্যামল দত্ত বলেন, বর্তমান কলুষিত রাজনীতির বৃত্ত থেকে দূরে থাকা পরিচ্ছন্ন এই মানুষটি ইচ্ছে করলেই ক্ষমতা আর অর্থবিত্তের রমরমা অবস্থানে যেতে পারতেন। কিন্তু সে পথে তিনি যাননি। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও কৃষক–শ্রমিক–মেহনতি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নই ছিল কমরেড জাফর আহমেদের লক্ষ্য। সে লক্ষ্যে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অবিচল ছিলেন তিনি।

সৈয়দ জাহিদ হোসেন বলেন, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এ যুগে জাফর আহমেদের মতো মানবিক লোকগুলোই আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। ঘন অমানিশার মধ্যেও তাঁরা মিটিমিটি আলো জ্বালানো তারকা। জাফর ভাইয়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা আবারও আশা জাগানিয়া আরেকটি তারা হারালাম।

ফয়সল আহমেদ চৌধুরী বলেন, জাফর ভাই রাজনীতির একজন শুদ্ধ মানুষ। শুধু রাজনীতি নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তিনি তাঁর আদর্শের সঙ্গে কখনো আপস করেননি। সাংগঠনিক দক্ষতায় তিনি তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের শীর্ষে পর্যন্ত গিয়েছিলেন। তাঁকে হারিয়ে মৌলভীবাজার তথা বাংলাদেশ একজন আলোকিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী জননেতাকে হারাল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

গোলাম মোহাম্মদ মহিবুর রহমান বলেন, সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের শুধু বীর সেনানীই ছিলেন না, স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধীসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল সক্রিয়। তাঁর অমায়িক ব্যবহারের কারণে দলমত–নির্বিশেষে মৌলভীবাজারের প্রতিটি মানুষ হৃদয় দিয়ে তাঁকে ভালোবেসেছে।

সৈয়দ আবু আজফার আহমেদ তাঁর ভাইকে একজন নির্লোভ ও জনকল্যাণকামী এক ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, মানুষটি তাঁর জীবনের পুরোটা সময়ই ব্যয় করেছেন জনগণের মঙ্গলের জন্য।

জিয়াউল হক জিয়া বলেন, সকল প্রকার শোষণ–বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখানো মানুষের বড় অভাব এখন পৃথিবীতে। এই অস্থির সময়ের মধ্যেও যে কজন মানুষ আলোকবর্তিকার মতো আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথ দেখান, তাঁদের মধ্যে কমরেড জাফর আহমেদ ছিলেন অন্যতম।

স্বপন কুমার দেব কমরেড জাফর আহমেদের কথা বলতে গিয়ে রাজনৈতিক কারণে ১৯৭৬ সালে একই সঙ্গে প্রায় ছয় মাস কারাবরণের স্মৃতিচারণা করেন।

দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন
দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন

সভাপতির বক্তব্যে তাজুল মোহাম্মদ বলেন, আমাদের সময়ের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জাফর ভাই ছিলেন আমাদের কাছে একটি স্বপ্নময় আদর্শের নায়ক। তাঁর একনিষ্ঠতা, দলীয় কর্মকাণ্ডের দক্ষতা তাঁকে জেলা থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দায়িত্বশীল মূল পদটিতে আসীন করে। নষ্ট রাজনীতির দুষ্ট খেলা তাঁর আদর্শ থেকে তাঁকে পরাস্ত করতে পারেনি। তিনি বলেন, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন লালনের মধ্য দিয়েই আমরা পারি তাঁকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে।

বাবলা দেব বলেন, জাফর ভাইয়ের হাত ধরেই আমার ছাত্ররাজনীতিতে আসা। আশির দশকে আমার মতো মৌলভীবাজারের অগণিত ছাত্র–যুবক তাঁর আদর্শের পথ ধরেই একটি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্নে রাজপথে নেমেছিলাম। দীর্ঘদিন স্বদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। তবু এই দূর পরবাসে থেকেও ভাবতাম আমাদের জাফর ভাই আছেন মাথার ওপর ছায়ার মতো অভিভাবক হয়ে। এখন জাফর ভাইহীন মৌলভীবাজার আমার কাছে মনে হয় শূন্য এক জনপদ।

সভায় আলেচনা ছাড়াও ছিল শোকাশ্রিত কবিতা আবৃত্তি ও সংগীত। কবিতা আবৃত্তি করেন আফাজ উদ্দিন তোতন ও শামসাদ রানা। সংগীত পরিবেশন করেন মুনমুন দেব, শেলি দেব, পুষ্পিতা ঘোষ চম্পা ও জয়ন্ত ভৌমিক জয়।

সভার শুরুতে কমরেড সৈয়দ আবু জাফর আহমেদের প্রতিকৃতির সামনে মোমবাতি প্রজ্বালন, পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। সবশেষে প্রদর্শন করা হয় তাঁর জীবন ও কর্মের ওপর নির্মিত একটি স্লাইড শো।

শোকসভায় দল–মত–অঞ্চলনির্বিশেষে প্রচুর লোক উপস্থিত ছিলেন।

উল্লেখ্য, কমরেড সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ গত ২৯ মে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকার একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।