আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে

রবীন্দ্র–নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
রবীন্দ্র–নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

আলো–আঁধারি পরিবেশ। গানের সুরে সত্য ও সুন্দরের উপস্থিতি ঘোষণা করছেন একদল তরুণী। মহাকাশে উদ্ভাসিত যে সত্তা, বিশ্বজগৎ তারই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। নারীরা নৈবেদ্য ঢেলে দিচ্ছেন। মহিমা প্রচার করছেন সৃষ্টিকর্তার।

একটুখানি সময় পর জ্বলে ওঠে পরিবেশ। পদধ্বনি মঞ্চে। সেই সঙ্গে যৌথ কণ্ঠের উচ্চারণ। ‘এই শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল। এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবরে বিকল।’ একদল শিক্ষার্থী নৃত্য কাঁপিয়ে দিল মঞ্চ।

রবীন্দ্র–নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
রবীন্দ্র–নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

গল্প শোনাচ্ছি না। সত্য ঘটনা। অডিটরিয়াম সে সময় দাঁড়িয়েছিল। ঝোড়ো হাওয়া বুঝি একপর্যায়ে সবকিছু ভেঙে খান খান করে দিতে চেয়েছিল। স্থান: বাংলাদেশ স্কুল। আয়োজন: রবীন্দ্র–নজরুল জন্মজয়ন্তী। তারিখ: ২০ জুন বৃহস্পতিবার। সময়: সন্ধ্যা সাতটা। উদ্যোগ: বাংলাদেশ দূতাবাস।

বাঙালির যাপিত জীবনে সর্বক্ষণই বিরাজমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। চেতনে বা অবচেতনে। রবীন্দ্রনাথের রচনা সম্ভার বিপুল, বৈচিত্র্যময়। সাহিত্যের প্রায় সব শাখায়ই তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। বিস্ময়কর সৃজনী প্রতিভা দিয়ে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। তাঁর কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, সংগীত, শিশুতোষ রচনা বাংলা সাহিত্যে অমর সংযোজন।

সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর আরেক মাইলফলক কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা আর বাঙালির ভুবনে সম্মানের আসন তাঁর। কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিক ও সৈনিক হিসেবে তিনি তাঁর ভূমিকা রেখেছেন। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে বরাবরই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনি জীবনও। সময়ের সাহসী সন্তান নজরুল।

রবীন্দ্র–নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
রবীন্দ্র–নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

দুজনই একাত্তরে ছিলেন বাঙালি জাতির অনুপ্রেরণা। এই দুই পুরুষই বাঙালির সঙ্গে থেকেছেন প্রতিটি সংকট ও সংগ্রামে। সহচর হয়েছেন আনন্দ ও ভালোবাসায়। সেই কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আজ রবীন্দ্র–নজরুলজয়ন্তী।

বক্তব্যের অণু পর্বে কথা বললেন দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল। দুজনের মধ্যে ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত পাবনা কুঠিবাড়ি। সে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ময়মনসিংহে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। ত্রিশালের বটতলা। কবির স্মৃতিচিহ্ন। বাঙালির নিখুঁত পরিচয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুই দিকপালকে সম্মান দিতে ভুল করেননি। কবিগুরুর জাতীয় সংগীত আর জাতীয় কবির গণসংগীত নিয়ে আজ আমাদের ছন্দময় চলা।

স্বাগত বক্তব্য দেন অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসান। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য নিয়ে শুরু তাঁর। কবিগুরু অসাধারণ ঈশ্বর প্রেম আর উচ্চমার্গীয় ভাবনার আশ্রয় নিয়েছেন অনায়াসে। নিজের ভাবকে অন্যের অন্তরে ঠাঁই দিয়ে সত্যকে স্থাপন করেছেন। বলেছেন, ভাবকে নিজের করিয়া সকলের করা, ইহাই সাহিত্য, ইহাই শিল্পকলা। অমর সৃষ্টি, অনন্য এক ঝাঁপি! ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতা খানি, কৌতূহলভরে আজি হতে শতবর্ষ পরে।’ দুচোখ তাঁর সুদূরপ্রসারী।

অন্যদিকে বিদ্রোহী কবি ক্ষোভে-দুঃখে-অপমানে গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে বলেন তরুণকে। ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির! শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!’ কিংবা মানুষের ভেতরকার আসল সত্তার মর্যাদা দিয়ে উচ্চারণ করেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’

অতিথিদের একাংশ
অতিথিদের একাংশ

শান্তির বারিবর্ষণের জন্য আকুতি মঞ্চের। শুষ্ক হৃদয় নিয়ে তাঁরা দাঁড়িয়ে। অন্ধকার, মোহ পাপ, শোক পরিতাপ না থাকার প্রার্থনা স্রষ্টার কাছে। বিঘ্ন বাধা অপসারণ করে হৃদয় পরিচ্ছন্ন ও প্রাণকে সবল করার আকাঙ্ক্ষা তাঁদের। হিংসা, দ্বেষ থেকে পরিত্রাণ চান। পাষাণ হৃদয়ে প্রেম বিতরণের আর্তি ব্যক্ত সে গানে।

জনতা ব্যাংকের স্থানীয় শাখার প্রধান নির্বাহী আমিরুল হাসান। তিনি বক্তব্য রেখেছেন। এখন উপভোগ করছেন মঞ্চের নিবেদন। বলেন, রবীন্দ্রনাথকে জানার মধ্য দিয়ে তাঁর গানের সঠিক চর্চা সম্ভব। রুচি গঠনে ও দেশপ্রেমের ভাবাদর্শে গড়ে উঠতে বিষয়টির গুরুত্ব বহুল। মুগ্ধতার চিহ্ন মুখে। স্কুলের একদল কিশোরীর দরাজ ভরাট কণ্ঠ তাক লাগিয়ে দেয়। দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার হে! লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার।। দেখি, ‘মরোদেরা’ তৈরি হয়ে নেয়। বুক বেঁধে দাঁড়ায়।

নজরুল তারুণ্যের প্রতীক। তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি ও বিদ্রোহ। লেখেন ভাঙার গানের মতো কবিতা। ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। উপহার দেন বিদ্রোহী কবিতা। প্রকাশ করেন ধূমকেতু। এক নতুন ধারার জন্ম দেন। গজলের পাশাপাশি উৎকৃষ্ট শ্যামা সংগীত রচনা করেছেন। জেলে বন্দী অবস্থায় লেখেন রাজবন্দীর জবানবন্দি।

অতিথিদের একাংশ
অতিথিদের একাংশ

ত্রিরত্ন বসা পাশাপাশি। মহিলা সমিতির নেতৃত্ব।

সংগঠনের সভাপতি জাকিয়া হাসনাত ইমরান। হাসিমুখ তাঁর। বলেন, এমন আয়োজন না হলে প্রবাসে সাহিত্য বা সংগীতচর্চার অনেকটাই অসম্পূর্ণ থেকে যেত। সাধারণ সম্পাদক পপি রহমান বলেন, রবীন্দ্র-নজরুলের বসবাস আমাদের মনের গভীরে। আমরা চলি তাঁদের নিয়ে। সংগঠনের আরেক সম্পাদক জাকিয়া হাসান এলি যোগ করেন, তাঁরা দুই রাজপুরুষ। আলোকময় চরিত্র। প্রজন্ম আলোকিত হোক তাঁদের দীপ্তিতে, প্রার্থনা তাঁর।

প্রেম ছড়ানো কবি রবীন্দ্রনাথ। প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ আনেন লেখায়। সেদিন মহালগনে বনে দেখা হয় দুই কপোত-কপোতীর। জোছনা ধোয়া রজনী। একজনের মনে প্রলেপ জড়ানো আর অন্যের মুখে ছিল হাসির রেশ। সেই মাহেন্দ্রক্ষণকে না ভোলার আকুতি সে গানে।

নজরুল তো আরেক কাঠি সরেস। বিরহ চেপে বসে।

দুটি ডাগর চোখকে এখনো মাপে প্রেমিকা। চাপা ফুলে ফেলে ছুটে যাওয়া লাজ। মনে পড়ে। আহা মরি মরি! সেই দিনের বাঁশরি বাজে বুকের মাঝে। গোমতির তীর ভেসে ওঠে মনে। সাঁঝের বেলায় পাতার কুটিরে আজও চেয়ে থাকে যেন! মানুষ মুগ্ধতা নিয়ে শোনে।

বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার ও দূতালয় প্রধান শহীদুজ্জামান ফারুকী বসা। পাশে প্রথম সচিব রিয়াজুল হক। দুজনের সহধর্মিণী গানের সঙ্গে আছেন মঞ্চে। এ সময়ে সন্তানদেরও থাকতে হয়। তারা দেখবে, উপভোগ করবে। গৌরববোধ করবে এই বলে, এ আমার মা! স্বর্গের শিশুদের কেউ একজন এই মুহূর্তে নেই। দুজনের বন্ধু কথনের মাঝে আমাকে স্বাগত জানানো হয়। সে জন্যই এমন কথার অবতারণা। কথা সই। ফোনে ডাক পড়ে নতুন প্রজন্মের। আলোচনা পর্বের সঞ্চালনা করেন শ্রমবিষয়ক কাউন্সেলর আবদুল আলিম মিয়া আর সাংস্কৃতিক ভাগে ছিলেন প্রথম সচিব জোবায়েদ হোসেন।

অতিথিদের একাংশ
অতিথিদের একাংশ

দুই সহকর্মী। তাঁরা গল্প করছিলেন। উপাধ্যক্ষ কাজী আবদুর রহিম ও অধ্যাপক আবু তাহের। হাত মেলাই। শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। মুগ্ধতা ঢেলে দিই তাঁদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে।

মঞ্চে বিরহের নিবেদন। ‘দেওয়া’ নামা চরাচর। কদম কেয়া মন। শাপলা, পদ্ম বেষ্টনে জীবন। বিদ্যুৎ চমকায়। বৃষ্টি নামে নামে। পারাপার বন্ধ। কিছুক্ষণ পর, বারিধারা চারিধার। ঘরে সবাই। কিন্তু আলেয়ার মন আনচান। সে মন তেপান্তরে নাচে। চখাচখি কেকা কাঁদে। কাঁদে বিরহী। তার মন পড়ে সেই দিন। মন দেওয়া–নেওয়ার শুভক্ষণ। কী মুশকিল। শ্রোতারা উপায় খোঁজে।

গীতাঞ্জলি রচনা করে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আসেন নোবেল পুরস্কার। চিত্রকলাকে আধুনিকতার ধারণা দেন। শাহজাদপুরে দরিদ্র কৃষকদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন কৃষি ব্যাংক। গড়ে তোলেন শান্তিনিকেতন। পাঞ্জাবের জালিয়ান ওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেন। ব্রিটিশ সরকারের নাইটহুড উপাধি ত্যাগ করেন। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসেন। বাংলার প্রতি ভালোবাসা থেকে 'আমার সোনার বাংলা' গান। যে গান আজ বাংলার জাতীয় সংগীত। ভারতের জাতীয় সংগীত ‘জনগণ মন অধিনায়ক জয় হো’ও তাঁর রচনা।

নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে এ সত্য। দেশের প্রতি ভালোবাসা জাগায় এমন তথ্য। বঙ্গবন্ধু পরিষদ আবুধাবির সহসভাপতি ইমরাদ হোসেন ইমু। বলেন, নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে এমন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন।

শুভেচ্ছা জানান ফারজানা করিম। বলেন, আলাদা রকমের একটি সময়। ভালো লাগে এমন মঞ্চে গান গেয়ে। নূপুর সরকার তাঁরই পাশে। রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যার আরেক গায়ক। অভিনন্দন জানাই।

নজরুল আসেন শিশু প্রসঙ্গে। অনিবার্য তাঁর উপস্থিতি। ছোটদের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত তাঁর কবিতায়। স্বাগত বক্তব্যে অধ্যক্ষ হাসান বড় জোর দিয়েই বলেছেন সে কথা। আমি হব সকাল বেলার পাখি। শিশুদের পক্ষে তাঁর ক্ষোভ। প্রকৃতির দুর্দশা আজ। নেই সেই আনন্দ। পাখিদের কিচিরমিচির, প্রজাপতির নরম পাখা কোথায়? কচিদের হাতে বইয়ের বদলে স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ, ইলেকট্রনিক ডিভাইস। খেলার মাঠ নেই। নেই যেন তার নিজস্ব আকাশ।

রাষ্ট্রদূত বরাবরই ছোটদের পক্ষে বলেন। এবারও তার ব্যতিক্রম লক্ষ করা যায়নি। শিশুদের হাতে তুলে দিতে হবে বই। একজন নিসর্গ প্রেমিক হয়ে গড়ে উঠতে হলে চাই সঠিক নির্দেশনা। বই সে জন্যই প্রয়োজন। সুন্দরকে কবিতা-শিল্প সাহিত্যকে ধরে রাখতে বই। তবে প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে নয়। বই-পরিবেশ থাকলে পৃথিবী টিকে থাকবে।
হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, এই ব্যাকুলতা ভিন্নধর্মী। এর সঙ্গে যুক্ত জীবজগতের প্রতি অসাধারণ ভালোবাসা। দেহ-মন শুদ্ধির মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু। শেষও হয় একই অনুভূতিতে। স্রষ্টার প্রতি সমর্পিত সবাই। ‘জগতে তব কী মহোৎসব, বন্ধন করে বিশ্ব...।’