প্রাণের টানে একটা দিন

পুনর্মিলনীর সব সদস্য একই ফ্রেমে
পুনর্মিলনীর সব সদস্য একই ফ্রেমে

বাংলাদেশের পড়াশোনায় কলেজজীবনের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাত্র দুই বছরের জন্য ছাত্রছাত্রীরা কলেজে ভর্তি হয়। কিন্তু তার রেশ রয়ে যায় সারা জীবন। কারণ মাত্র দুই বছরের এই সময়টা তাদের জীবনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেয়। এ ছাড়া স্কুলজীবন শেষ করে কলেজজীবনে একটু বাড়তি স্বাধীনতার স্বাদও পাওয়া যায়। তাই মনের মধ্যে পাখনা মেলতে শুরু করে বিভিন্ন রকমের কোমল অনুভূতি। হঠাৎই কোনো সহপাঠী বা সহপাঠিনীর চলাফেরা বিশিষ্ট হয়ে চোখে ধরা দেয়। যদিও বিভিন্ন কারণে সেটা আর প্রকাশ করা হয়ে ওঠে না।

বাংলাদেশে আমাদের প্রজন্ম বোধ হয় সবচেয়ে সৌভাগ্যবান প্রজন্ম। কারণ আমরা একই সঙ্গে সেকেলে মূল্যবোধগুলোর পাশাপাশি প্রযুক্তির বিবর্তনটাও চোখের সামনে দেখে বেড়ে উঠেছি। অভিভাবকদের চোখরাঙানিকে পাশ কাটিয়ে মোবাইল, কম্পিউটার নামের অত্যাধুনিক সব যন্ত্রের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়ে যায় সেই কলেজজীবন থেকেই। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে আরও ডালপালা ছড়িয়ে পড়ে।

কলেজের গণ্ডি পার হয়ে আবার আমরা বিভিন্নজন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও একই ব্যাচের অনেক নতুন বন্ধুও তৈরি হয়। তখন আবার একটা নতুন পৃথিবীর সন্ধান পাই আমরা। এভাবে একটা প্রজন্ম একই রকমের প্রাণের টান অনুভব করতে শুরু করে।

বাচ্চাদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা
বাচ্চাদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা

আমাদের মাধ্যমিক পাসের সাল ছিল ১৯৯৬। আর কলেজ পাসের সাল ছিল ১৯৯৮। কিন্তু আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় পাস করেছি সেটা হয়েছে ২০০০ সালের পরের কোনো এক সময়ে। সেদিক দিয়ে হিসাব করলে আমরা আসলেই অনেক সৌভাগ্যবান, যে আমরা একটা শতাব্দীর মিলনের সময়ে আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় কাটিয়েছি ও উপভোগ করেছি প্রাণভরে। অতঃপর কর্মজীবনে প্রবেশ ও আবারও ছুটে চলা। দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে রয়েছে আমাদের সফল পদচারণ।

অস্ট্রেলিয়াতেও আমাদের যাদের একই ব্যাচে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস হয়েছিল, তাদের একটা অনলাইন সংগঠন আছে। তার নাম ৯৬৯৮ অস্ট্রেলিয়া। বছরজুড়েই আমরা বিভিন্ন রকমের কর্মকাণ্ড পালন করে থাকি। তারই ধারাবাহিকতায় এবার একটু বড় পরিসরে ঈদ পুনর্মিলনীর আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আমাদের এই গ্রুপের মূল সংগঠক বন্ধু আরিফ যখন একটা ঈদ পুনর্মিলনীর প্রস্তাব করল, তখন সবাই সেটা একবারেই লুফে নিল।

প্রথমেই সবাই মিলে সুবিধা অনুযায়ী একটা তারিখ নির্ধারণ করা হলো। কারণ অস্ট্রেলিয়ার রুটিন জীবনে অনেক আগে থেকেই সবকিছুর পরিকল্পনা করে রাখতে হয়। অবশেষে ঠিক হলো, ৩০ জুন রোববার আমাদের হবে পুনর্মিলনী। এরপর কোথায় আয়োজন করা হবে সেই প্রসঙ্গ আসতেই বন্ধু মামুন প্রস্তাব করল, তার বাসাতেই আমরা জড়ো হতে পারি। মামুন আর তার স্ত্রী সাথী দুজনই আমাদের ব্যাচমেট। সবাই একবাক্যে রাজি হয়ে গেল তাদের বাসাতেই সমবেত হওয়ার ব্যাপারে।

বড়দের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
বড়দের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

এরপর এল খাবারের প্রসঙ্গ। অস্ট্রেলিয়ার জমায়েতগুলোতে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যবস্থা হচ্ছে ‘ওয়ান ডিশ পার্টি’। সেখানে সবাই একটা করে পদ রান্না করে নিয়ে আসেন। তারপর সেটাই সবাই ভাগাভাগি করে খান। এবারও সেই প্রস্তাব রাখার পাশাপাশি ক্যাটারিংয়ের মাধ্যমে খাবার অর্ডারের বিকল্প রাখা হলো। সবাই ভোট দিয়ে ক্যাটারিংটাকেই বেছে নিল। তবে কেক তৈরির দায়িত্ব নিল আমাদের ব্যাচের হানী। ইতিমধ্যেই সে কেক তৈরি করে সিডনিতে সুনাম কুড়িয়েছে।

খাবারের বন্দোবস্ত হয়ে যাওয়ার পর সবার জন্য পোশাক নির্ধারণ করে দেওয়া হলো। বড়দের পাঞ্জাবি, শাড়ি বা ট্র্যাডিশনাল আর ছোটদের ঈদের পোশাক। অনুষ্ঠানের দিন যাতে ছোটরা বিরক্ত না হয়, তার জন্যও ব্যবস্থা রাখা হলো। এ ছাড়া আমাদের ব্যাচের বিশিষ্ট দোতারাবাদক তারিক কথা দিল সে লাইভ দোতারা বাজিয়ে সবাইকে গান গেয়ে শোনাবে। হাসিব আর রকিও গান গেয়ে শোনাবে আমাদের। শব্দযন্ত্র নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব মামুন নিজ কাঁধে নিল। আর বাংলা কারাওকের ব্যবস্থাও রাখা হলো বিকল্প হিসেবে।

৩০ জুন সকাল থেকেই সবাই মামুনের ম্যাকুয়ারি লিংকের বাড়িতে সমবেত হতে শুরু করল। বেলা ১১টায় শীতের পিঠাপুলি দিয়ে সবাইকে স্বাগত জানানো হলো। এরপর দুপুরের খাবার। দুপুরের খাবারের পর ছিল বাচ্চাদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। বাচ্চারা সবাই সেটা খুবই উপভোগ করল। সেটা শেষ হওয়ার পর গান বাজনার আয়োজন করা হলো। গান যেমনই হোক না কেন, সবাই সেটার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গেয়ে উঠল। শুনে মনে হচ্ছিল যেন একদল কিশোর-কিশোরী কলেজ থেকে বনভোজনে গিয়ে যেমন খুশি তেমন গাও প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আর সঙ্গে সঙ্গে চলল যেমন খুশি তেমন নাচো প্রতিযোগিতা। সবাই যার যার মতো করে হাত পা নেড়ে নাচ করে গেল অনবরত।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল ঘনিয়ে এসেছে। তখন সবাই মিলে ছবি তুলতে শুরু করল। আর ছবি তোলার দায়িত্বে ছিল আমাদেরই ব্যাচের ইয়াসীর। ইয়াসীর সিডনির অত্যন্ত পরিচিত ফটোগ্রাফার। ব্যাচের ব্যানারের সামনে দাঁড়িয়ে দলবদ্ধ ছবি ছাড়াও অনেক যুগল ছবি ও পারিবারিক ছবি তোলা হলো।

দলের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম
দলের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম

ব্যাচের সুন্দর ব্যানারটার মূল কনসেপ্টটা ডিজাইন করে দিয়েছিল আমাদেরই আরেক বন্ধু শারমিন। সে যদিও যোগ দিতে পারেনি কিন্তু ফেসবুকের কল্যাণে যুক্ত ছিল সারাক্ষণই। এ ছাড়া এই অনুষ্ঠানের জন্য বিশাল এক কেক তৈরি করে আনে আমাদের বন্ধু হানী। বাচ্চাসহ বড়দের জন্য কিছু বিশেষ খাবার আর মিষ্টি নিয়ে হাজির হয় আমাদের বন্ধু লোরা, নাজ, শাম্মী আর নীলা। বিকেলের চায়ের দায়িত্ব নেয় ইম্মি।

দিনভর অনুষ্ঠান সঞ্চালকের দায়িত্বে ছিল বন্ধু পারভেজ আর যেকোনো কাজে বাকি বন্ধুদের সঙ্গে আমাদের ভাবি আর দুলাভাইরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এই পরিবারের অংশ হিসেবেই। বাচ্চাদের পুরো প্রোগ্রামের দায়িত্বে ছিল বন্ধু মিতু আর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল বন্ধু আকাশ, মামুন, হিমেল আর আরিফ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পরপরই সবাই মিলে মামুন আর সাথীর বাড়ি পরিষ্কার করতে লেগে পড়ল, অনেকটা স্কুলের সব বাচ্চা মিলে স্কুলের আঙিনা পরিষ্কার করার মতো করে।

সব আয়োজনেরই শেষ থাকে। এই আয়োজনও শেষ মুহূর্ত এসে উপস্থিত হলো। সবাই নিজেদের বাসার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার সময় একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে কোলাকুলি করছিল, যেন কত দিন পর হারানো বন্ধুর সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। সবাই সবাইকে তাদের নিজ নিজ বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় নিয়ে যাওয়ার পর পুরোনো দিনের একটা গান আমাদের মনের কোনো বেজে উঠছিল।

‘আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখো
আমায় পড়বে মনে কাছে দূরে যেখানেই থাকো।’
---

মো. ইয়াকুব আলী। ইমেইল: <[email protected]>