মায়া ঘর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বড় এক ডেকচি ছোলা ভাজা, পিঁয়াজি, মুড়ি আর সালাদ মাখিয়ে বাচ্চাদের বিতরণ করা হচ্ছে। প্লাস্টিকের প্লেটে করে খাচ্ছে সবাই। পুকুর পাড়ে তেঁতুলগাছের নিচে জমেছে এই আসর। দূর থেকে যে দেখছে, সে-ই এসে যোগ দিচ্ছে। তাই আসরের পরিধি ক্রমে বেড়েই চলেছে। সবাইকে দেওয়া হচ্ছে। তৃপ্তিসহ চলছে সবার খাওয়া।

এই আসরের মধ্যমণি রাকিব। ঢাকায় একটা পত্রিকা অফিসে চাকরির পাশাপাশি চলছে মাস্টার্সে পড়াশোনা। প্রতি মাসে একবার বাড়িতে আসে। যেদিন আসে, সেদিন বিকেলবেলায় এই তেঁতুলতলায় বসে তার ছোলা-মুড়ির আসর। অদূরে ঘাটলায় দাঁড়িয়ে রাকিবের মা-বাবা দুজনেই এই আসরের দিকে চেয়ে আছেন। চোখেমুখে শান্তির হাসি।

রাকিবের বাবা বলেন, ‘রাকিবের মা, তোমার পাগল ছেলের কাণ্ড দেখো।’

খুশির অশ্রু গোপন করে রাকিবের মা বলেন, ‘আমার ছেলে বাড়িতে এলে বাচ্চাদের যেন ঈদ শুরু হয়।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই মা-বাবা দুজন চলে এল রাকিবের আসরে। মায়ের হাতে একটা বাটি।

: ও মিয়া। দেও। তোমার ছোলা-মুড়ি আমরাও খাই।

রাকিব বাড়িতে দুই দিন থাকে। এ সময় রাকিবের এভাবেই কাটে। তার কোনো বন্ধুবান্ধব নেই। এই শিশুরাই তার বন্ধু। পরিণত বয়সের লোকজন তার সঙ্গে কথা বলে মজা পায় না। সংসারের নানান ঝামেলা আর লাভ-ক্ষতির কথা সে নিজেও পছন্দ করে না। কিছুক্ষণ পর ছোলামুড়ি খাওয়া শেষ হয়। আসর ভেঙে দিয়ে রাকিব ঘরে এসে দেখে, মা-বাবা দুজনই খুব মজা করে খাচ্ছেন।

খাওয়া শেষে রাকিবের বাবা বলেন, ‘রাকিবের মা, আমি একটু বাজারে যাব। ব্যাগটা দাও।’

রাকিব বলে, ‘বাবা, একা যাবেন? আমিও যাব। আপনার তো শরীর ভালো না।’

: হ। শরীরটা অহন ভালোই। তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে থাকো। কত দিন তোমারে দেখে না। তোমার মা খুব কান্নাকাটি করে।

বাবা বাজারের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হলে রাকিব মাকে বলে, ‘মা, বাবা খুব অসুস্থ। এটা জেনেই তো তাড়াহুড়া করে বাড়িতে এলাম। কই, অসুস্থতার তো কোনো লক্ষণই দেখি না।’

: ছেলেকে দেখলেই তোর বাপের শরীরটা ভালো হয়ে যায় রে বাবা। গতকাল সকালে অবস্থা এমন হইছে যে আর বুঝি বাঁচবই না। বাড়ির ফোনটা নষ্ট। শেষে নিজেই উঠে বাজারে গিয়ে তোরে ফোন করেছে।

রাকিব হেসে বলে, ‘আহা, বাবার যা কাণ্ড। এত ছেলেমানুষি করলে কী হয় মা। অফিসে এত ব্যস্ততা ফেলে আমাকে জরুরি ছুটি নিতে হলো।’

: তোর বাপ অহন বাচ্চাকাচ্চার মতো হয়ে গেছে রে বাবা।

: জি মা। আসার পথে ওই বাড়ির চাচি বলল, বাবা নাকি চোখ মুছতে মুছতে কাল দুপুরে বাজারে গেছেন আমাকে ফোন করতে।

: কী আর বলব রে বাবা, ভোরে আমাকে ডেকে তুলে বলে, রাকিবের মা, আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমার রাকিব জাঙ্গালের মাঠের মাঝখান দিয়া আসতাছে। আমার ছেলের গায়ে নীল রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা।

রাকিবের চোখ দুটি ভিজে এল। বলল, ‘মা, বাবা যদি এমন করে ঢাকায় গিয়ে আমার ভালো লাগে না। অফিসের কাজে মন দিতে পারি না যে।’

: বাবা রে, তোর বাপের বয়স হয়েছে। ছেলেকে না দেখলে যে শান্তি লাগে না। কী আর করার আছে রে বাবা। জীবন এমনই।

আজ ওই তেঁতুলগাছ, পুকুর ঘাটলা, বাড়ির আঙিনা সবই আছে। শুধু প্রাণহীন। সবুজ মরুর মতো আদরহীন শুয়ে আছে ওই মেঠো পথ। নীল পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পরে ছেলের বাড়িতে আসার স্বপ্ন আজ কেউ আর দেখে না। আট বছর গত হয়ে গেছে। মাস কয়েকের ব্যবধানে বাবাকে অনুসরণ করে মাও হারিয়ে গেলেন ওই অনন্ত পথে। মেঠো পথের বাঁকে ওই বাড়ির চাচি ফোন করতে বাজারে যাওয়ার কালে বাবার চোখ মোছার গল্প করেছিল। আজ আর কেউ নেই। এই বাঁকে দাঁড়িয়ে রাকিব একদৃষ্টে বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। তার গায়ে নীল রঙের পাঞ্জাবি, বাতাসে উড়ছে।
---

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: