নামি ও আমি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

নামি (ন্যাশনাল অ্যাওয়ারনেস অব মেন্টাল ইলনেস—NAMI) প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে কিছুদিন আগে অবধি পরিচিত ছিলাম না। কয়েক মাস আগে এই সেমিস্টারের শুরুতে কলেজের ক্লাব সপ্তাহে জানতে পারলাম নামি ক্লাব সম্পর্কে। প্রতি চার মাস পরপর একবার হয় এই বিশাল আয়োজন। ক্লাব সপ্তাহ। মূলত ছাত্রছাত্রীদের কলেজের বিভিন্ন ক্লাব সম্পর্কে জানাতেই এই মেলার আয়োজন করা হয়। তবে আমি যতটা ক্লাবের জন্য যাই, তার থেকে বেশি যাই নতুন মানুষ চিনতে আর ফ্রি চকলেট খেতে!

সে যাক। সেদিন ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম, কোনো ক্লাবে যোগ দেওয়া যায় কিনা? যেদিকে যাই, সব ক্লাবের কর্মকাণ্ড, সভা, সবকিছুই ক্যাম্পাসের বাইরে। আর বাইরে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। তখনই পেলাম NAMI-অ্যাট পিসিসি। সম্পূর্ণ ক্যাম্পাসভিত্তিক এই ক্লাবটি টানল আমায়।

ছোটবেলা থেকেই বিশ্বাস আমার, শারীরিক শক্তি বা পারিপার্শ্বিক সামর্থ্য না থাকলেও শুধু মনের জোর আর সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস থেকেই অনেক বাধার পাহাড় পার হওয়া যায়। আমি হয়েছি আগে। আলহামদুলিল্লাহ। তবে বেশ কয়েক বছর আগে, বেশ কিছু কারণ থেকেই এক অদ্ভুতুড়ে ভূত ভর করেছিল আমার ওপর।

না, না, মামদো বা শাঁকচুন্নি নয় এই ভূতের নাম? বিষণ্নতা! আর এই ভূতকে ঘাড় মটকে সময়মতো তাড়াতে না পারবেন তো সে আপনার জীবনের ঘাড়টি কখন মটকে দেবে টেরও পাবেন না। (আজও মাঝে মাঝে জ্বালায় বিষণ্নতা)। বিষণ্নতা কী, কেন হতে পারে, এসব জানার পর, আর কয়েক বছর নিজেই এই ভূতের সঙ্গে লড়াই করার পর থেকেই আমার কাছে মানসিক স্বাস্থ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্যই, নামির সঙ্গে আমি।

নামির কাছ থেকেই জেনেছি, একজন মানুষের সম্পূর্ণ সুস্থতার জন্য চার ধরনের স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দিতে হয়। শারীরিক (physical health), মানসিক (mental health), আবেগীয় (emotional health) ও ধর্মীয় (spiritual health)।

নামি ক্লাবে বেশ কিছু বন্ধু আছে আমার। এরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ব্যাপারে দক্ষ। কায়লা ভীষণ ভালো আঁকে। মিশেল ভালো নেতৃত্ব দিতে জানে। রালফ খুব ভালো কবিতা লিখতে জানে। প্রতি মঙ্গলবার দুপুর ১২টা ১৫ মিনিট থেকে ১টা পর্যন্ত সভা বসাই আমরা। আমাদের দুজন উপদেষ্টার নামই এক। রোজ মেরি।

এই দুই রোজ মেরি আমাদের শেখান, দিনে ২০ মিনিটের হাঁটা আমাদের কী কী শারীরিক সমস্যা থেকে দূরে রাখতে পারে। তাঁদের কথার মাঝে রালফ আমার দিকে আঙুল তোলে: কাজীকে বলতে বল, ও গোটা ক্যাম্পাস হেঁটে বেড়ায় সময় পেলে, আমি ওকে লিফটে না চড়ে সিঁড়ি বাইতেও দেখেছি...।

আমি চোখ পাকিয়ে তাকাই। তবে বন্ধুর মুখে হাসি দেখে নিমেষে গলে জল হয়ে যাই। বলি, রালফ, আমি একাই এসব করি বুঝি? তুমি তো সবকিছুতেই পারদর্শী। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সবকিছুতেই আছ। তবে!

কাজের ফাঁকে রালফ মাঝে মাঝে সবাইকে শোনায় ওর নানা রকম শারীরিক যুদ্ধজয়ের গল্প। সবাই অনুপ্রাণিত হই ওকে দেখে। রোজ মেরি প্রশ্ন করেন: কাজী, তোমার কষ্ট হয় না? পিঠে এই এত বড় ব্যাগ, তোমার হাতেও তো ধরে আছ কিছু। নিজেকে সামলাও কী করে?

জবাবে আমি হেসে তাকাই পাশে বসা বন্ধু বেইলির দিকে। ওর হাতে চামড়ার হাতমোজা, ফোসকা থেকে বাঁচতে। শরীরের সামনে বাঁধা বিশাল ব্যাগ। হাত হুইলচেয়ারের চাকায়। আমি বলি, ওকে কেউ প্রশ্ন কর তো, ওর কি কষ্ট হয়?

বেইলির চোখে আত্মবিশ্বাস, কষ্ট! কাকে বলে কষ্ট?

এবার আমার সোজা জবাব, আমাদের অভিধানে শারীরিক কষ্ট ব্যাপারটা নাইরে ভাই! ও হবে, আর ওকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে পথ চলতে হবে!

রোজ মেরির মুখে হাসি। একেই বলে মানসিক শক্তি! এবার চলো দেখি তোমরা কে কতটা মানসিক চাপে আছ, মাপতে চাও? কম্পিউটারের সঙ্গে লাগানো কী একটা যন্ত্র বসানো হয় আমাদের মাথায়। পর্দার পারদ ওঠানামা করে। রোজ মেরি সাবধান করেন আমায়, এত মানসিক চাপ ভালো নয় কাজী, তোমার যন্ত্রের পারদ এত উঁচু, এত চাপ কিসের? ফাইনাল পরীক্ষা সামনে, তাই?

সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? দাঁড়াও, দুই মিনিট দাও।

আরে আরে রোজ মেরি হাঁক ছাড়েন। দু মিনিটে পারদ লাল থেকে সবুজ? কী করলে তুমি মেয়ে?

শুনিয়েই দিলাম একটু, Drink to me only with thine eyes, and I’ll pledge with mine/Or leave a kiss, but in the cup, and I will not ask for wine… কতবার ভেবেছিনু, আপনা ভুলিয়া, তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া...।

কায়লার কণ্ঠে প্রশংসা: তুমি গান দিয়েই চাপ নিয়ন্ত্রণ করলে কাজী?

আমি হাসি। বলি, তোমার যেমন রংতুলি, আমারও তেমনি গান, আমার প্রাণ!

এবার রোজ মেরির তৃতীয় প্রশ্ন: আর আবেগ? তার বেলা কী করো তোমরা? সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু! বিশেষ করে ছেলেরা এর গুরুত্ব বুঝতেই চায় না।

রালফের চোখে প্রশ্ন: মানে কী? আমি অনেক আবেগপ্রবণ কিন্তু!

ঠিক এই মুহূর্তে আলেক্সা ক্লাসে ঢুকেই গভীর আলিঙ্গনে বাঁধল মিশেলকে। আমাদের সবার চোখ তখন ওদের দিকে। রোজ মেরি বললেন, ওই যে আবেগীয় স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্পর্শের গুরুত্বকেও বুঝবে তোমরা। পাশ থেকে কায়লা তখন আমার কাঁধে আর আলেক্সা কোন ফাঁকে কোলে পড়েছে বুঝিনি। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ছোট্ট শুভেচ্ছা জানাই, শুভ জন্মদিন আলেক্সা!

দুই রোজ মেরি এক সঙ্গে হেসে উঠলেন আমাদের কাণ্ড দেখে। এই কাজী মানেই একের ভেতর দুই তিন হয়ে বসে থাকে। তুমি বিরক্ত হও না কাজী। এরা সব তোমার কোলে কাঁখে বাদুড়ঝোলা হয়ে থাকে যে?

মিশেল চেঁচায়: আমরা সবাই কাজীর ছোট, তাই আমরা আদর চাইতে পারি, হুম!

পাশ থেকে আমার সঙ্গে হাত মেলায় রালফ, আমিও কাঁধ চাপড়ে দিলাম ওর।

আচ্ছা কাজী, তুমি তো লেখো, তাই না? ডায়েরি লেখো? মানে, কাগজ–কলম?

হ্যাঁ, আমি কাগজেই লিখি তো। মাঝেমধ্যে ডায়েরির পাতাকে একটু সাজিয়ে–গুছিয়ে পত্রিকায় পাঠিয়ে দিই। রালফ সুর মেলায়, এ কাজটা সেও করে।

দুই রোজ মেরি বলেন, ডায়েরি লেখাটা নিজের সঙ্গে কথা বলার মতো, এটা করবে তোমরা। আর যখন কারও বিপদে সাহায্য করতে পারো, কারও কান্না বন্ধের কারণ হতে পারো, হয়ে যাবে, কোনো বিনিময় প্রত্যাশা ছাড়া। তাতে আবেগীয় স্বাস্থ্য ভালো বই খারাপ হবে না।

বয়স্ক রোজ মেরি এবার বলেন ধর্মীয় স্বাস্থ্য নিয়ে। কী করে সৃষ্টিকর্তার প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস আমাদের সম্পূর্ণ সত্তাকে ভালো রাখতে পারে, যত নেতিবাচক সময়কে ইতিবাচকে পরিণত করতে পারে। আমি যখন বললাম যে, আমার কাছে গান ও প্রার্থনা, দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ, সবাই বললেন এটা আমাকে অন্য দশজনের থেকে বেশি সুস্থ রাখতে পারে। আমার বন্ধুরা অনেকেই গির্জায় যায়, নিয়মিত বাইবেল পড়ে।

নামি এখন আমার জীবনের বেশ দামি অধ্যায়ের নাম। আমার বন্ধুরা এবং দুই রোজ মেরি মিলে আমাকে এমন অনেক কিছু শিখিয়েছেন, যার জন্য বিষণ্নতা নামের অদ্ভুতুড়ে ভূত আজ কাছে এলেও বেশিক্ষণ থাকতে পারে না।