লিভিং ইন কন্সট্যান্ট টেরর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রায় বছর পাঁচেক পর একটা পরিচিত নম্বর থেকে কল। মাঝে দেখা, কথা নেই বহুকাল। কেমন আছেন, কেমন চলছে জীবন এমন আলাপচারিতায় কেটে গেল মিনিট বিশেক। কিছুক্ষণ পর মনে হতে লাগল একই সময়ে তিনি অন্য কারও সঙ্গে কথা বলছেন।

জিজ্ঞেস করলাম। অকপটে জবাব দিলেন বাসায় তিনি ছাড়া আর কেউ থাকেন না। পছন্দের মানুষটার পথ আলাদা হয়ে যাওয়ার পর একাকী কাটিয়ে দিয়েছেন বহু বছর। রান্না, চাকরি সব একাই করেন।

আলোচনার একপর্যায়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন নামাজ পড়ি কিনা। বুঝলাম, একাকিত্ব থেকে বেশ ধর্মকর্মে ঝুঁকেছেন তিনি। ভালো লাগল তাঁর ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে বেশ আগ্রহ দেখে। প্রবাস জীবনে কজনই বা পারে এতটা।

হঠাৎ একপর্যায়ে তিনি বলতে শুরু করলেন, আল্লাহর সঙ্গে প্রায়ই কথা হয় তাঁর। তীব্র অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলাম এবার। তিনি কিন্তু বেশ স্বাভাবিক গতিতেই বলে চলেছেন। খানিক পরেই কথা অন্য দিকে মোড় নিল। গলার কাছে অনেক কথা দলা পাকিয়ে উঠল। ভাবলাম বলে ফেলি। নাহ! অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও পেরে উঠলাম না। সেদিনের মতো সেখানেই সমাপ্তি।

সিদ্ধান্ত নিলাম পরের ফোন কলটা আমিই দেব।

বিপত্তি বাঁধল তাঁর নম্বরটা সেদিন সেভ করা হয়নি। মেসেঞ্জারে নক করলাম নম্বরের জন্য। প্রায় দিন দশেক পর উত্তর।

অনেক সাহস সঞ্চয় করে কলটা দিয়েই ফেললাম। কোনো ভণিতা না করেই জিজ্ঞেস করলাম, কিছু দেখেন আপনি? কিছু শোনেন?

ফোনের ওপাশে নীরবতা।

জিজ্ঞেস করলাম কত দিন?

সাত বছর...একটা দীর্ঘ নিশ্বাসের সঙ্গে মিলল কাঙ্ক্ষিত উত্তর।

কোথায় দেখেন?

সিলিংয়ে...।

এখনো দেখতে পাচ্ছেন?

হুঁ...।

মুহূর্তেই শিউরে উঠলাম। বুঝতে বাকি রইল না Visual & Auditory Hallucination তাঁর নিত্যসঙ্গী। আহারে, যে মানুষটাকে সেই ছোট্টবেলা থেকে চিনি, সে এত জীবন্ত দুঃস্বপ্নের মাঝে বেঁচে আছে!

আমার আর খুব বেশি কিছু করার ছিল না। তিনি ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিতে থাকেন। চিকিৎসা শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই। একা থাকার কারণে তাঁর মিসিং ডোজের কেউ হিসাব রাখে না। নতুন করে শুরু করতে হয় বারবার।

তাঁর কাছ থেকে ওনার মায়ের ফোন নম্বরটা চেয়ে নিয়েছিলাম সেদিন। আমার ফোন পেয়ে তিনি যারপরনাই অবাক। অনেক চেষ্টা করেও সিজোফ্রেনিয়া কী তাঁকে তা বোঝাতে পারলাম না। একাকিত্ব যে ট্রিগার ফ্যাক্টর তাও বোঝানো গেল না। তবে খুব করে বোঝালাম, তাঁর ছেলের একজন সঙ্গী প্রয়োজন। হোক সে বন্ধু, জীবনসঙ্গী কিংবা পরিবারের কেউ। যে মানুষটা এমন তীব্র দুর্যোগে সব জেনেবুঝে তাঁর পাশে থাকবে।

আনন্দের কথা, তিনি তেমন একজনকে পেয়ে গেছেন। সেরে উঠেছেন ও সংসার গুছিয়েছেন। এই দুর্যোগে শুধু সহযাত্রী না একেবারে কোস্টাল লাইফ গার্ড পেয়ে গেছেন।

আজ সকালটা শুরু হয়েছে তাঁদের হাস্যোজ্জ্বল যুগল ছবি দেখে। এখন আর তাঁর ওষুধ মিস হয় না। আবার নতুন করে শুরু করতেও হয় না। তিনি ভালো আছেন।❤

‘Living in constant terror
When life is a horror movie
Schizophrenia awareness.’