সিডনিতে মেজবান উৎসবের স্মরণীয় সন্ধ্যায়

চট্টগ্রাম ক্লাব অস্ট্রেলিয়ার মেজবানের একটি দৃশ্য
চট্টগ্রাম ক্লাব অস্ট্রেলিয়ার মেজবানের একটি দৃশ্য

সিডনির মিন্টো ইনডোর স্পোর্টস সেন্টারে কিছুদিন আগে আয়োজন করা হয়েছিল চট্টগ্রাম ক্লাব অস্ট্রেলিয়ার মেজবান। চট্টগ্রাম ক্লাব অস্ট্রেলিয়া পুরোপুরি চট্টগ্রামের ঐতিহ্য বজায় রেখে গত বছর থেকে মেজবান আয়োজন করে আসছে। মেজবানের জন্য ফেসবুকে ইভেন্ট তৈরি করে সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এ ছাড়া অনলাইনে নিবন্ধনের জন্য খোলা হয় ওয়েবসাইট। যাঁরা মেজবানে যোগ দিতে ইচ্ছুক তাঁদের অনলাইনে নিবন্ধনের অনুরোধ করা হয়। তবে নিবন্ধন ছাড়াও যাঁরা এসেছিলেন তাঁরাও মেজবানের খানা খেয়েই ফেরত গেছেন।

আমি ব্যক্তিগতভাবে চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে খুবই নিবিড়ভাবে পরিচিত। সেই গল্পটা আগে বলে নেওয়া দরকার। বুয়েটে আমাদের রুমমেট ছিল এস এম তৌহিদুল ইসলাম। আমরা ডাকতাম তৌহিদ বলে। তার উচ্চারণে চট্টগ্রামের আঞ্চলিকতার টান ছিল স্পষ্ট। আমরা সেটা খুবই উপভোগ করতাম। শুরুতে তার কথা ঠিকমতো বুঝতে না পারলেও ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তৌহিদ বলত, আমি তো অনেক সহজ করে বলি। আমার বাবা–মায়েরা যেটা বলেন সেটা আমি নিজেও অনেক সময় বুঝতে পারি না।

বুয়েটে পড়াকালে তৌহিদ একবার আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত চট্টগ্রামের মেজবান অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়েছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম ওখানে খেতে গেলে টাকা দিতে হবে না। তৌহিদ বলল, সেখানেই তো মজা। মেজবানে কাউকে টাকা দিতে হয় না। সবাই আসবে, বসবে, পেটভরে খাওয়া–দাওয়া করবে, আবার চলে যাবে। আমি তবু ভরসা পাচ্ছিলাম না।

নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দেখি বিশাল জায়গায় কাপড়ের চাঁদোয়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। সেখানে দলে দলে মানুষ আসছেন ও খাওয়া–দাওয়া করে ফিরে যাচ্ছেন। আমরা একটা টেবিলে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন খাবার প্লেট দিয়ে গেলেন। আমরা টেবিলে রাখা পাত্র থেকে ভাত তুলে নিলাম। আমি আশপাশে তাকিয়ে দেখি সবারই প্লেট ভর্তি কালো রঙের গরুর মাংস। চানখাঁরপুলের হোটেলগুলোর কল্যাণে তত দিনে জেনে গেছি গরুর মাংসের কালো রঙের এই রান্নাকে বলে কালা ভুনা। মাংসের পাশে সামান্য একটু ভাত। সবাই গোগ্রাসে গরুর মাংস খাচ্ছেন। আমরাও আমাদের খিদে মিটিয়ে খাওয়া–দাওয়া করলাম। সঙ্গে আরও ছিল গরুর পায়ের হাড়ের ঝোল ও বুটের ডাল।

চট্টগ্রাম ক্লাব অস্ট্রেলিয়ার মেজবানের একটি দৃশ্য
চট্টগ্রাম ক্লাব অস্ট্রেলিয়ার মেজবানের একটি দৃশ্য

তৌহিদের কাছ থেকেই জেনেছিলাম মেজবানকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘মেজ্জান’। সাধারণত কারও মৃত্যুর পর কুলখানি, চেহলাম, মৃত্যুবার্ষিকী, শিশুর জন্মের পর আকিকা উপলক্ষে বা কোনো ব্যক্তির মৃত্যুবার্ষিকীতে মেজবানের আয়োজন করা হয়। এসব নির্দিষ্ট উপলক্ষ ছাড়াও কোনো শুভ ঘটনার জন্যও মেজবান করা হয়। আর মেজবানের গরুর মাংসের স্বাদ এর খ্যাতির কারণ। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে মাছ ও মুরগির মাংসও পরিবেশন করতে দেখা যায়। এরপর থেকে কয়েক বছর আমি আর তৌহিদ নিয়ম করে মেজবানে যেতাম। একসঙ্গে এত মানুষের জমায়েত দেখতে আমার খুবই ভালো লাগত। আর মানুষগুলো এসে কোনো প্রকার টাকাপয়সা ছাড়ায় তৃপ্তি নিয়ে গরুর মাংস দিয়ে সাদা ভাত মেখে খেয়ে চলে যাচ্ছেন, এটা আমার চোখে ভাসত সব সময়ই।

অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে এসে ঠিক সেই একই রকমের মেজবান অনুষ্ঠান দেখতে পাব এটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। যদিও চট্টগ্রামের বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। আমি আমার কর্মজীবনেও অনেক দিন চট্টগ্রামে থেকেছি। সেই সূত্রে জানি চট্টগ্রামের মানুষ একে অপরকে ‘বদ্দা’ বলে সম্বোধন করেন। তাই আমিও বাপ্পী ভাই ও সাগর ভাইকে বদ্দা বলে সম্বোধন করি। বাপ্পী ভাই ও সাগর ভাই জন্মসূত্রে চট্টগ্রামের মানুষ হলেও যৌবনের শুরুতেই চট্টগ্রামের বাইরে চলে এসেছিলেন। তাই তাঁদের কথায় তেমন একটা আঞ্চলিকতার টান টের পাওয়া যায় না। তবে আমরা মাঝেমধ্যে আবদার করলে বলেন। তখন সেটা শুনে হাসতে হাসতে আমাদের পেটে খিল ধরে যাওয়ার জোগাড় হয়। সাগর ভাই, রোমানা ভাবি তাঁদের সন্তান অর্নভ ও ঋষি আর বাপ্পী ভাই, হাসি ভাবি, তাঁদের সন্তান রাবাব ও নাওয়া আমাদের পারিবারিক বন্ধু হয়ে গেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।

গত বছর যখন চট্টগ্রাম ক্লাব অস্ট্রেলিয়া প্রথমবারের মতো মেজবান আয়োজন করেছিল তখন সাগর ভাই আমাকে দাওয়াত করেছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে আর যাওয়া হয়নি। এবার মেজবানকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম ক্লাব একটা স্মরণিকা বের করবে তাই একদিন বাপ্পী ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, ‘ইয়াকুব ভাই আপনি থাকতে আমাদের স্মরণিকাতে লেখা পাচ্ছি না, তাড়াতাড়ি একটা লেখা দেন।’ আমি সেই সপ্তাহান্তেই রাত জেগে একটা লেখা লিখে বাপ্পী ভাইকে ই–মেইল করে দিলাম। বাপ্পী ভাই সেটা পেয়েছেন জানিয়ে আমাকে উত্তর দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে আর সেটা দেখা হয়ে ওঠেনি। তাই নিশ্চিত ছিলাম না, আমার লেখা প্রকাশিত হচ্ছে কিনা।

চট্টগ্রাম ক্লাব অস্ট্রেলিয়ার মেজবানের একটি দৃশ্য
চট্টগ্রাম ক্লাব অস্ট্রেলিয়ার মেজবানের একটি দৃশ্য

গত ২২ জুন সন্ধ্যায় সপরিবারে মিন্টোর ইনডোর স্পোর্টস সেন্টারে গিয়ে আমরা উপস্থিত হলাম। এটার পাশেই মিন্টো স্টেশনের বিশাল কার পার্ক। তাই গাড়ি পার্ক করতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি। ভেতরে ঢুকে দেখি বিশাল জায়গা মানুষের ভিড়ে গমগম করছে। একদিকে মঞ্চ সাজানো হয়েছে। তার সামনে সারি সারি চেয়ার–টেবিল সাজানো। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। শত শত মানুষ সেখানে বসে খাওয়াদাওয়া করছেন। তারপর একেবারে শেষ দিকের কোনায় স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে সবাই ভাত তরকারি পানির বোতল এগিয়ে দিচ্ছেন। আর একদল হাঁড়ি থেকে ভাত তরকারি গামলাতে উঠিয়ে দিচ্ছেন। টেবিলের ওপর পলিথিন বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর খাবার জন্য দেওয়া হচ্ছে ওয়ান টাইম প্লেট। প্রত্যেকটা টেবিলের ওপর হাত পরিষ্কার করার জন্য রাখা হয়েছে ওয়াইপস। এ ছাড়া খাবার শেষে প্লেট ফেলার জন্য রাখা হয়েছে বিনের ব্যবস্থা।

শত শত মানুষ খাওয়াদাওয়া করছেন। কিন্তু কোথাও কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা চোখে পড়ল না। মেজবানের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখে খাবার হিসেবে রাখা হয়েছে সাদা ভাত, গরুর মাংস, বুটের ডালের একটা তরকারি আর সবজি। বাচ্চাদের জন্য ছিল কম ঝাল দিয়ে রান্না করা চিকেন রোস্ট। আমরা খুবই তৃপ্তি নিয়ে খাওয়াদাওয়া করলাম। খাওয়া শেষে আমার মেয়ে তাহিয়া বসে গেল হাতে মেহেদি নিতে। আমি আর আমার ছেলে রায়ান একটা রিয়েল এস্টেট এজেন্সির স্টলে গিয়ে একটা বেলুন নিয়ে নিলাম। তার ফাঁকে ফাঁকেই কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম। সেখানেই দেখা হয়ে গেল বাকের ভাই, আকরাম ভাই, আরমান ভাইসহ আরও অনেকের সঙ্গেই। তাঁরা সবাই স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে যাচ্ছেন অনুষ্ঠানটাকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য। অবশেষে এক কপি স্মরণিকা নিয়ে বের হয়ে এলাম। মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছিল। ভাবছিলাম তাঁদের এত সুন্দর আয়োজন নিয়ে একটা কিছু লিখব কিন্তু ব্যস্ততার কারণে আর হয়ে উঠছিল না।

চট্টগ্রাম ক্লাব অস্ট্রেলিয়ার মেজবানের একটি দৃশ্য
চট্টগ্রাম ক্লাব অস্ট্রেলিয়ার মেজবানের একটি দৃশ্য

এরপর হঠাৎ ৩ জুলাই একটা ই–মেইল পেলাম। ই–মেইলটা পাঠিয়েছে চট্টগ্রাম ক্লাব অস্ট্রেলিয়া। সেই ই–মেইল থেকেই জানতে পারলাম এবারের মেজবানে দুই হাজার সাত শর ওপরে অতিথিকে তারা আপ্যায়ন করেছে। যেখানে একসঙ্গে চার শ আশিজন করে বসার ব্যবস্থা ছিল। ই–মেইলে তারা তাদের এবারের মেজবান উৎসবের আয়োজনের আদ্যোপান্ত হিসাব ছাড়াও দিয়েছে আর্থিক লেনদেনের হিসাব। এই বিষয়টা আমাকে খুবই অভিভূত করেছে। বাংলাদেশিদের নিয়ে বিশ্বব্যাপী একটা ধারণা প্রচলিত আছে, সেটা হচ্ছে তারা আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে স্বচ্ছ না। কিন্তু চট্টগ্রাম ক্লাব অস্ট্রেলিয়া সেটাকে ভুল প্রমাণিত করে সবাইকে ই–মেইল করে তাদের দায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়েছে। আশা করি, তারা ভবিষ্যতেও এই আয়োজন অব্যাহত রাখবে আর বিদেশের বুকে বাংলাদেশের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবে যুগ যুগ ধরে। আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে চট্টগ্রাম ক্লাব অস্ট্রেলিয়ার জন্য বাহ্‌বা ও শুভকামনা রইল।