তোমাদের জন্য ভালোবাসা

হ‌ুমায়ূন আহমেদ
হ‌ুমায়ূন আহমেদ

জীবনের অনেকটা অংশ সিনেমার মতো চোখের সামনে ঘুরপাক খায়। ছোটবেলা থেকে আমি হ‌ুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে বড় হয়েছি। বিশেষত তাঁর ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ আমার জীবনে পড়া প্রথম বা দ্বিতীয় সায়েন্স ফিকশন। তাঁর লেখার জাদুতে কেমন একটা মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম।

সেই থেকে ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘নন্দিত নরকে’, ‘আমার আছে জল’, ‘বৃহন্নলা’—মধ্যবিত্ত একান্নবর্তী পরিবারের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, মনের খুব গভীরে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। কী অপূর্ব সেই দিনগুলো। ‘এলেবেলে’, ‘আমার ছেলেবেলা’ বইগুলো পড়ে অনেক হেসেছি। শৈল্পিক হিউমার কঠিন কিছু সময়ে সাময়িক ভুলিয়ে দিয়েছে সবকিছু।

‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘কোথাও কেউ নেই’-এর মতো টিভি নাটকগুলো গোগ্রাসে গিলতাম। বইগুলো হাতে এসেছে পরে। কিছু কিছু নাটকের শেষটুকু বদলে দিতে তাঁকে চিঠি লিখেছি। যেমন বাকের ভাইকে জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মিস মুনার সঙ্গে মিল করে দিতে। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের শেষ কয়েক পর্বে।

মেডিকেলের কোচিংয়ের জন্য ঢাকায় আপুর (বোন) হোস্টেলে ছিলাম প্রায় দেড় মাস। আমার আবদারে অতিষ্ঠ হয়ে আপু বেলা দুইটায় বইমেলায় নিয়ে গেল। যে স্টলে তিনি এসে অটোগ্রাফ দিতেন, সে স্টলের সামনে করুণ চোখে দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু আমি থাকা অবস্থায় তিনি আসেননি। ভিড় হওয়ার আগে আগে দুঃখভারাক্রান্ত মনে আপুর হোস্টেলে ফিরে গিয়েছিলাম।

পরে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তখন আমি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ি। আব্বু-আম্মির চাকরি তখনো খুলনায়। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এসে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে যশোর যাব। বিমানবন্দরে দেখি হ‌ুমায়ূন আহমেদ আর পরির মতো গুলতেকিন আহমেদকে।

আপু আমার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল, ‘খবরদার, ওনাদের বিরক্ত করবি না।’ আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় লেখক আর তাঁর পরি বউয়ের দিকে। আমার মনে তখন উথালপাতাল ভালোবাসা একজনের জন্য, মেডিকেলের, যে আমার পিছে পিছে ঘুরে চলেছে। কেউ তখনো জানে না সেটা।

যা হোক, হ‌ুমায়ূন আহমেদ চা খেতে গেলেন। পিছে পিছে আমি। পিছে আমার বোন। বুকস্টল থেকে আয়না ঘর কিনলাম। আপুর ভয়ে একটা অটোগ্রাফ চাওয়া হলো না। তাঁকে বলা হলো না আপনার বই পড়ে ভালোবাসার তীব্রতা আমি বুঝেছি। মায়াময় একটা সংসারের স্বপ্ন আমিও দেখি।

যশোরে নেমে গাড়িতে চোখ মুছতে মুছতে দেড় ঘণ্টায় বাসায় পৌঁছালাম। আব্বু-আম্মি হাসি হাসি চেহারা করে গেটে দাঁড়ানো। তাঁরা বললেন, কিরে, তুই নাকি তোর প্রিয় লেখককে দেখে অনেক ছোটাছুটি করেছিস এয়ারপোর্টে? আমি আপুর দিকে চোখ কটমট করে তাকালাম!

এরপর মেঘে মেঘে বেলা অনেক হয়েছে। মিসির আলীর সঙ্গে অনেক সমস্যা সমাধানে বা হিমু, দেবী বা নিশীথিনীর অতিমানবীয় ক্ষমতায় অনেক মুগ্ধ হয়েছি। হোস্টেলে বই কিনে খাবার আনতে গেলে প্রিয় বান্ধবী কলি এসে বই নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিত। সে আগে বই কিনলে একই কাজ আমিও করতাম। কী মধুর সেই দিনগুলো।

তাঁর অনুবাদ করা ‘অমানুষ’ বইটা অনেকবার পড়েছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা অসাধারণ বইগুলো—‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘আগুনের পরশমণি’, সমসাময়িক সময় নিয়ে লেখা ‘মাতাল হাওয়া’, ‘শ্যামল ছায়া’ মুগ্ধ করেছে বারবার আমাকে। ভালোবেসেছি আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে।

আমেরিকায় বসে শুনেছি তাঁর স্বপ্নসংসারের ভাঙন আর নতুন সংসারের সূচনা। তবু তীব্র জোছনাপ্রেম বা বৃষ্টিবিলাস থেকে নিজের মনকে ফেরাতে পারিনি। আজীবন শহরবাসী আমি ‘একটা ছিল সোনার কন্যা মেঘবরন কেশ’ শুনে ভাটি অঞ্চলের প্রেমে পড়েছি। বারবার।

তারপর শুনলাম তাঁর জীবনঘাতী অসুখের কথা। এরপর ২০১২ সালের ১৯ জুলাই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন চিরদিনের জন্য। ডাক্তার হয়েও মেনে নিতে পারিনি তাঁর চলে যাওয়া। আকাশের ঠিকানায় বহু চিঠি লিখেছি। আপনি বলেছিলেন ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়’ আপনি কথা রাখেননি। নুহাশপল্লীতে শাওন, নিশিত, নিনিত আছে আপনি নেই। বইমেলাতে আপনার নতুন বই আসেনি কত বছর।

বেহেশতের বাগানে ফুল হলে ভালো থাকুন আমার প্রিয় লেখক। এই দোয়া।