রূপকথার দিনরাত্রি-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ইন্টার্নশিপ শেষ হওয়ার পরপর পনেরো শ ডলার নিয়ে জার্মানিতে চলে গেল রূপকথা। কিছুদিন পর রবিনেরও পিএইচডি শেষ হলো। দুই মাস পর একসঙ্গে তারা আমেরিকায় গেল। রবিন আমেরিকায় এল পোস্টডক করতে। এ সময় রূপকথা টের পেল সে সন্তানসম্ভবা। আমেরিকায় তাদের সাত দিন রবিনের বোনের বাসায় থাকতে হলো। পাশের শহরে যাওয়ার আগে। তখন রূপকথার সব সময় বমি ভাব, মাথা ঘোরা আর সবকিছুতে গন্ধ। খুব শরীর খারাপ লাগে।

এর মধ্যে দেশে ফোন করে রূপকথা জানতে পারল, রবিনের বাবা আবার হাসপাতালে সার্জারির জন্য ভর্তি হয়েছেন। তাঁর সার্জারি সফল। কয়েক দিনের মধ্যে চলে যাবেন। হাসপাতালের টাকা হয় রূপকথার বাবা দেবেন বা তার দুলাভাই দেবেন। আগেরবারের দুলাভাইয়ের গম্ভীর চেহারা রূপকথার মনে আছে।

সৎবাবার রিটায়ারমেন্টের টাকা থেকে চাওয়ার মতো লজ্জা অপমান কষ্ট সব মেনে নিল রূপকথা। রবিনের বোনের বিশাল পাহাড়ের ওপর বাড়ির লিভিং রুমে বসে ফোনে রূপকথা বাবাকে বলল, ‘আপনি টাকাটা দিয়ে দেন। এ টাকা আমি শোধ করে দেব।’ তখন রূপকথার কাজ করার লিগ্যাল স্ট্যাটাস বা শরীরের শক্তি কোনোটাই নেই।

পাশের শহরে নিজেদের অ্যাপার্টমেন্টে আসার দিন ১০ পট চাল আর কয়েকটা আলু দিয়ে রবিনের বোন বাইরে চলে গেলেন। রবিনের এক বন্ধু একটা পাঁচমিশালি মসলা কিনে ওদের পাশের শহরে এক রুমের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে দিয়ে গেল। ওরা হেঁটে, বাসে করে চায়নিজ দোকানে গিয়ে যা কিছু পেল কিনে নিল। পরদিন থেকে রবিনের রিসার্চের কাজ। রূপকথা একটা নুডলস রান্না করে সারা দিন একটু একটু করে খেতে চেষ্টা করত আর রবিনের জন্য রান্না করে রেখে দিত। সন্ধ্যার পর শুরু হতো বমি। চোখে অন্ধকার দেখত শুধু।

ডাক্তার ঠিক হলো ইনস্যুরেন্স পাওয়ার পর। প্রতি ভিজিটেই ডাক্তার বলতেন ওজন এত কমে যাচ্ছে কেন। এ সময় বোনের কাছ থেকে ধার নিয়ে বাবার টাকাটা রূপকথা দিয়ে দিল। জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মনে হয়েছিল যদি সুযোগ না আসে? বোনকে বলে দিয়েছিল এ টাকা কাজ করে আমি শোধ করে দেব।

এর মাঝে রবিনের বোন দেশে ওর বাবার ওষুধ এখান থেকে পাঠানো থেকে শুরু করে ওই স্বল্প সামর্থ্যের মধ্য থেকে যা পারল নিতে থাকল। ওরা পুরোনো একটা গাড়ি কিনল। কারণ, এ শহরে বাস বা ট্রেন ব্যবস্থা খুব খারাপ। এত কিছুর মাঝে রূপকথা বেঁচে থাকল। ওর ছেলে হলো। রাতদিন কীভাবে ছোট্ট বাবাকে সে দেখল জানে না। কাপড় পরিষ্কার করতে যেতে হয় অন্য ব্লকে। সামান্য সামর্থ্যে কোনো কিছুই বেশি কেনা সম্ভব হয় না। বাড়িভাড়া দিয়ে অল্প কিছু হাতে থাকে। এর মাঝে রূপকথার খালা অন্য শহর থেকে তার বাচ্চার না ব্যবহার করা অনেক কাপড় পাঠিয়ে দিলেন। রূপকথার এ দেশে বড় হওয়া বাংলাদেশি মা-বাবার এক মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো। সে এসে নার্সিং বালিশ, টুকটাক খাওয়া–দাওয়া আর তার কাজের ফাঁকে যতটুকু সম্ভব সময় দিল।

তিন মাস কেটে গেল কীভাবে জানে না। কিন্তু রূপকথা টের পেল সে আবার সন্তানসম্ভবা। রূপকথা কাঁদল অনেক আর রবিনের বোনের বাজে কথা শুনল। যে এত কাছে থেকে একটা দিন কিছু করল না। দ্বিতীয় বাচ্চা হওয়ার সময় রবিনের বাবা-মা চিকিৎসা করাতে আমেরিকায় এলেন। প্রায় এক বছরের একটা বাচ্চা আর ৯ মাসের প্রেগন্যান্ট রূপকথা তাঁদের রান্না করে খাওয়ায়। তত দিনে রবিনের কাছে গাড়ি চালানো শিখে নিয়ে রূপকথা যাবতীয় বাজার করে। তাঁদের কাপড় ধুয়ে আনে আর রবিনের বাবার আজেবাজে কথা শোনে। কেন তাঁদের সকালের নাশতা রেডি থাকে না। মূর্খ রূপকথা কেন চাকরি করে না।

রূপকথার মেয়ে হলো ১৫ দিন পর। হাসপাতালে যাওয়ার চার ঘণ্টার মধ্যে। লেবার রুমে রূপকথাকে রেখে বাবা-মা আর এক বছরের ছেলে নিয়ে চলে গেল রবিন। তাঁদের খাবারের সময় চলে যাচ্ছে। আমেরিকান নার্স জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার হাজব্যান্ড আসবে না?’ রূপকথা বলল, ‘না। আমাকে বল কোথায় যেতে হবে, আমি পারব।’ ভয়ানক লজ্জা পেয়ে নার্স বলল, ‘না, পায়ের সাড়া ফিরে এলে বস হুইলচেয়ারে। আমরা নিয়ে যাব।’ রবিন এল এক দিন পর অনেক রাতে। হাসপাতালে তিন দিন থেকে বাসায় গিয়ে রূপকথা দেখল তার রান্না করা মাংসের অল্প অংশ আছে।

মোট পাঁচ মাস থাকলেন রবিনের বাবা–মা। রূপকথা এক রুমে বন্দী। ছোট বাচ্চার নার্সিং করে। বড় বাচ্চাটা খেতে চায় না একদম। তবু খাবার রান্না তার করতে হয়। রূপকথার শ্বশুর-শাশুড়ি প্রায়ই শুধু শুধু ওর বাবা সম্পর্কে বাজে কথা বলতেন। একদিন রূপকথা তাঁদের বলেছিল, আমার বাবার টাকায় তাহলে চিকিৎসা কেন করেছেন? তখন রবিন বলে বসল, ‘তোমাকে আমি এক তালাক দিলাম।’

রূপকথা দেশে চলে যেতে চেয়েছিল বান্ধবী ডেকে। কিন্তু রবিন যেতে দেয়নি। মানে পয়সা নেই। বাবার কাছে হাত পাততে লজ্জা করল রূপকথার। এর মধ্যে রবিনের বোন এসে চিৎকার করে বলে গেল, তাঁদের বাবার সম্পত্তির সবটুকু যেন বড় ভাইয়ের নামে এক্ষুনি লিখে দেওয়া হয়। এদিকে রবিনের প্রতিষ্ঠানে নোটিশ দিয়ে দিয়েছে অন্য চাকরি খুঁজে নিতে।

রূপকথা অবাক হয়ে চিন্তা করল বাংলাদেশে রবিনের এই বোনকেই যখন কুকুর কামড়িয়েছিল তখন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সে কেন ডাক্তার দেখাতে ছুটেছিল পরীক্ষার আগের দিন? রবিনের মাকে চট্টগ্রামে ডাক্তাররা যখন ক্যানসার বলে দিয়েছিলেন। রূপকথা ঢাকায় এন্ডোসকপি করিয়ে কেন তাদের চিন্তা দূর করতে গিয়েছিল?

একসময় রবিনের বাবা-মা বুঝে গেলেন এত এক্সপেনসিভ চিকিৎসা আমেরিকায় করা সম্ভব না। তখন রাগ করে রবিনের করা টিকিট দিয়ে তাঁরা চলে গেলেন দেশে। রূপকথার খালা অনেক কাপড় পাঠিয়েছিলেন তার বাচ্চাদের জন্য। খুব খুশি হয়ে রূপকথা সেগুলো তার শাশুড়িকে দেখিয়েছিল। শাশুড়ি যাওয়ার সময় সদ্য হওয়া শিশুকে দেওয়া সব নতুন কাপড় নিয়ে চলে গেলেন। এ কথা রূপকথা রবিনকে বলাতে সে তাকে মিথ্যুক বলে দিল।

রবিনের চাকরি চলে যাওয়ার আগেই পাশের শহরে চাকরি পেয়ে চলে গেল সে। বেতন সামান্য বাড়ল রবিনের। রূপকথার বাবা-মা, আত্মীয় যত টাকা দিল সব রবিনের হাতে তুলে দিলেও মনে মনে হিসাব রাখল সে। এর মধ্য রূপকথা ফ্রি বই পেয়ে গেল ইউএস এমএলইর। রূপকথা ঠিকমতো ঘুমাতেই পারে না বাচ্চা দেখে আর ঘরের যাবতীয় কাজ একা করে। পড়বে কখন? বাংলাদেশি পাড়া ওটা। অনেক পড়াশোনা জানা এক খালাকে বলল একদিন, আমার খুব পড়ার শখ। তিনি বললেন ঠিক আছে, আমি রাখব বাচ্চা। রূপকথার চেয়ে প্রায় ১০ বছরের বড় তিনি। রূপকথা বুঝল না কেন তিনি পড়াশোনা করে চাকরি করেন না।

তারপর শুরু হলো আবার পড়াশোনা। চার ঘণ্টার পড়া দিয়ে শুরু। ও এত ভালোবেসে পড়তে পারে জানা ছিল না। এর মাঝে রবিনের বোনকে অনেকবার দেখতে যেতে হলো। কারণ, পান থেকে চুন খসলেই তাঁর অভিযোগ আর যে রবিন বাসায় এক গ্লাস পানি ঢেলে খায় না, প্রায় সেই যাবতীয় উপদেশ দিত ।

এর মাঝে একদিন মাঝরাতে রবিন গিয়ে তার বোনকে নিয়ে এল। তার বাচ্চা হয়েছে তখন। কয়েক মাস বয়স। এক রুমের ছোট্ট বাসায় ১০-১২ দিন প্রতিদিন রবিনের বোনের বান্ধবী তাঁর স্বামীসহ, বোনের স্বামী আর শাশুড়ি ননদ এসে খেতে লাগল আর বিচার–সভা বসাল। এই ছোট দুই বাচ্চা নিয়ে রাঁধতে রাঁধতে আর প্লেট ধুয়ে গোছাতে ওর জীবন চলে গেল। রবিনের বোনের বান্ধবী চাপ দিতে লাগল রবিনকে ওর বোনের দায়িত্ব নিতে। কিন্তু পাহাড়ের মাথায় বাড়ি আর দামি গাড়ি ফেলে ওর বোনের এদিকে ভালো লাগল না।

তারা চলে গেল। আর চলে গেল সাত মাস। পরীক্ষা দিল প্রথম পার্ট রূপকথা। পাস করল ৮৫ পার্সেন্ট নিয়ে। জীবনে যে সোনার হরিণ পাবে বলে মনে করেনি। এর মাঝে রবিনের বোনের খবর নিয়মিত নেওয়া হচ্ছে না ইত্যাদি বলে অনেক খারাপ ব্যবহার করত রবিন। মাঝে মাঝে এসে বলত, ঘরে কেন সেজে থাকে না রূপকথা। এত অর্ডিনারি লুক ওর ভালো লাগে না।

সামান্য দুই–এক শ ডলার যা দেওয়া হতো খালাকে তা রবিনের জন্য বেশি মনে হতে লাগল। লোকের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে লোকাল কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র হিসেবে কাগজ নিয়ে বাচ্চাদের সপ্তাহে পাঁচ দিন ডে কেয়ারে দিল ওরা। ছয় মাস পর ইউএস এমএলই দ্বিতীয় পার্ট-এ দিল রূপকথা। এরপর দিতে হবে পার্ট টু বি। বাসায় বসে পরীক্ষা দিল। মানুষ কত কোচিং করে। রবিন নিজেও কোচিং করে পরীক্ষা দিয়েছে বলে মনে ভয় ছিল। ভালো নম্বর না পেলে কী হবে রূপকথার? রেজাল্ট বের হলে দেখল ৯২ পারসেন্ট নম্বর। এত বছরে এত খুশি বহুদিন হয়নি রূপকথা। পার্ট টু সি কে পাস করে গেল নিমেষে। এখন রেসিডেন্সি খোঁজার পালা। একই সময় রবিনের গ্রিনকার্ড হয়ে গেল।

রেসিডেন্সি পাওয়ার পর ছয় মাস পর ওরা দেশে যাবে ঠিক করল। চলে যেতে হলো নিউইয়র্ক। এক আত্মীয়র বাসায় ন্যানিসহ মাস দেড়েক থাকতে হলো। মানবেতর জীবন। এর মধ্যে খবর এল রবিনের বাবা মারা গেছেন। রবিন দেশে চলে গেল। ছোট দুই বাচ্চা নিয়ে রেসিডেন্সি চালিয়ে গেল রূপকথা। ওর আর বাচ্চাদের জীবনে একটা সুযোগ এসেছে একটু ভালো থাকার। এত দিনে...। (চলবে)

ধারাবাহিক এ রচনার আগের পর্ব দেখতে ক্লিক করুন