রূপকথার দিনরাত্রি-তিন

মাসুক হেলাল
মাসুক হেলাল

চরম সংকটে ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে রূপকথা কোনোভাবে একটা বছর নিউইয়র্কে কাটাল। পরের বছর স্যানহোসে এসে রেসিডেন্সি কনটিনিউ করে চলল ওরা। সেখানে কিছুদিন পর থেকে স্থানীয় কিছু নারী অভিবাসী রূপকথার কাছে অভিযোগ করতে লাগল, সব সময় তোমার স্বামী আমাদের নিয়ে খেতে যায় বা কফি খায় কেন? তোমাকে নিয়ে যেতে পারে না?

এদিকে বাসায় রূপকথার ওপর রবিনের অত্যাচার আরও বাড়ল। কেন তার বোন বা মার খোঁজ ঠিকমতো নেওয়া হয় না। অথচ টাকা থাকে একই অ্যাকাউন্টে। রবিনের বোন ধার নেয়, বেড়াতে আসে রূপকথার পয়সায়। একবার এসে সাত দিন থাকল। তার বাচ্চা অরগানিক ছাড়া খায় না বলে রবিন কাজ ফেলে অরগানিক খাবার আনতে লাগল। রবিনের বোন নিজের ছেলের জন্য আনা সিরিয়াল লুকিয়ে রাখল। বাসায় নুডলস রান্না করে নিজের ছেলেকে খাওয়াল। রূপকথার তিন-চার বছরের ছোট বাচ্চাগুলোকে বলে দিল তোমার মা যখন পারবে বানাতে, তখন খাবে।

রবিন এগুলো জেনেও রূপকথার সঙ্গে আরও বিশ্রী ব্যবহার করল। বলল, সব রূপকথার দোষ। রবিন জোর করে রেসিডেন্সির টাকা বাঁচিয়ে দেশে অ্যাপার্টমেন্ট কিনল। যেটাতে বহু মাস খালি থাকার পর ভাড়াটে এল। অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়ার সব টাকা রবিনের মায়ের পেছনে খরচ হতে থাকল। রবিন তার মাকে হাজার হাজার ডলার খরচ করে স্যানডিয়াগোতে গ্রিন কার্ড করে নিয়ে এল। চাকরির পাশাপাশি রূপকথা রান্নাবাড়া, বাচ্চা দেখা নিয়ে হাঁপিয়ে উঠল। এর ওপর আছে শাশুড়ির অত্যাচার। স্যান্ডেল ঠিক করে দেওয়া, যত ধরনের ফুটফরমাশ খাটা ইত্যাদি সব চালাতে লাগল।

রবিনকে অনেক কসরত করে চাকরিতে ঢুকিয়েছে রূপকথা। কাজে দুর্বল, ফাঁকিবাজ ও নারীঘেঁষা স্বভাবের কারণে ওকে কোনো ভালো রিকমন্ডেশন লেটার দেয়নি কেউ রেসিডেন্সিতে। চাকরি এখন স্যানডিয়াগো শহরে। রবিনের বোন নিজের বাড়ির জন্য সে সময় ১০ হাজার ডলার নিয়ে চলে গেল। তারপর যোগাযোগ বন্ধ। রূপকথা নতুন বাড়ির মর্টগেজের কিস্তির টাকা, রবিনের শৌখিন পোর্শ গাড়ির খরচ দিয়ে নিজের বা বাচ্চাদের জন্য ভালো দোকান থেকে ফল কিনলেও রবিন তাকে গালাগাল করত।

ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে কোথায় যাবে রূপকথা? বাইরের মেহমান দাওয়াত দিলে রবিনের রাগ, সস্তা দোকান ছাড়া খেতে যাওয়া যাবে না। তা–ও কয়েক মাসে একবার। রূপকথা রান্না করে, থালাবাসন পরিষ্কার করে, কাজ করে সংসার টিকাতে চাইল বাচ্চাদের জন্য। একটা ন্যানি বাচ্চা আনা–নেওয়া আর রান্না করা খাবার পরিবেশন করত বাচ্চাদের। রবিন তাকে দিয়ে রূপকথা ও বাচ্চাদের অনুপস্থিতিতে কাজ করাত আর খুব করে চাইত রূপকথা বাচ্চা আনা–নেওয়া করুক যাতে ন্যানির পয়সা বাঁচে।

এর মধ্যে শারীরিক সমস্যার কারণে রবিনের মা পড়ে যাওয়া শুরু করলে রবিন বাধ্য হলো তাঁকে দেশে রেখে আসতে। আর সব সময় রূপকথাকে দোষ দিল সে দেখে রাখলে মাকে দেশে যেতে হতো না। ওদিকে রবিনের বোনের স্বামী দেশে আরেক নারীকে বিয়ে করে ফেলল। রবিন বোনকে এনে গাড়ি, ফোন ও বাড়ির ব্যবস্থা করে দিল। আর রূপকথার ওপর অত্যাচার আরও বাড়ল। কেন সে ভালো আছে এ জন্য।

রবিন ছোট বাচ্চা রূপকথার কাঁধে ফেলে ১৫০ মাইল দূরে বোনের বাড়ি চলে যেত কিংবা ইংল্যান্ডে ক্রিকেট খেলা দেখতে চলে যেত। রবিন নিজের ফোন কখনোই কোথাও রাখত না। তার ফোনের এক্সেস রূপকথার কখনোই ছিল না। মা দেশে যাওয়ার পর মাকে দেখার নাম করে রূপকথাদের ফেলে ঘন ঘন দেশে যাওয়া শুরু করল রবিন। সামান্য কিছু খাবার বাটিতে আনত রবিন। রূপকথা এগুলো ধরলে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করত। এর মাঝে ২৪টা বছর চলে গেছে। এত বছর রান্না করে খাইয়ে ওই সামান্য খাবার নিয়ে এত নোংরা ব্যবহার কেন বুঝল না রূপকথা।


শুধু নিজের প্রয়োজন ছাড়া রূপকথার সঙ্গে শোয়া, বাজে ব্যবহার ছাড়া কথা বলা বন্ধ করে দিল রবিন। খুব সকালে উঠে বাইরে চলে যেত হাঁটার নাম করে। ছুটির দিনে তিন ঘণ্টা ধরে হেঁটে বাসায় এসে ঘুম। সারা সময় হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইভারে ব্যস্ত থাকে। রূপকথা ওর বেতন ২৪ বছর পরে আলাদা অ্যাকাউন্টে রাখতে বাধ্য হলো কারণ রবিন নিজের ও পরিবারের জন্য যথেচ্ছভাবে খরচ করলেও দেশে গিয়ে রূপকথার বাবার পরিবারকে বাধ্য করত তার খরচ দিতে।

অনেকবার খারাপ ব্যবহার করে কয়েক মাস আলাদা থেকে রূপকথার ব্যবহার খারাপ, দয়া করে সংসার করছে বলে বেড়াতে লাগল। বিভিন্ন নারীর যথেচ্ছ ছবি তুলে, একা একা পুরো শহর ঘুরে দারুণ দিনকাল কাটাতে লাগল রবিন।

তারপর একদিন নামাজ পড়তে গিয়ে হঠাৎ রূপকথা দেখল রবিনের ফোনে টিয়ারস নামে এক নারীর টেক্সট হোয়াটসঅ্যাপে। কেমন আছ জান? হাগ কিস। গানটা যা সুন্দর। দুই ঘণ্টা বসে থেকেও ফোন খুলে মেসেজ দেখতে পারল না। রাগ করে ফোন নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় হাতাহাতিতে একটু কালো হলো হাত। রবিন পুলিশ কল করে জেল খাটাল রূপকথাকে এক রাত।

এত বছর আল্লাহ অনেক হিন্ট দিয়েছেন। কিন্তু রূপকথা বোঝেনি। এত দিনে পায়ের তলার মাটি আসলেই সরে গেছে। রূপকথাকে টাকা উপার্জন, ঘরের কাজ আর যখন-তখন শারীরিক প্রয়োজন মেটানো ছাড়া আর কোনো কারণেই তাকে রাখেনি রবিন। মাত্র ১৭ বছরের ছেলে যখন বেল দিয়ে রূপকথাকে বাসায় এনেছে তখনই সে ডিভোর্সের ডিসিশন নিয়েছে। ভালোবাসা বলে পৃথিবীতে আসলে কিছু নেই। একটা নীচু মনের মানুষের পাত্র হয়ে ২৪টা বছর কাটিয়েছে রূপকথা। বিধাতার বিচারের আশায়। (শেষ)

ধারাবাহিক এ রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন