কিছু নিছক আক্ষেপের বর্ণালি

চীনে আমাদের সঙ্গে পড়েন মূলত ভারতের শিক্ষার্থীরা। সঙ্গে নেপালি আছেন বেশ কয়েকজন। আর হাতে গোনা দুই-চারজন মালদ্বীপের। গত মাসে নেপাল ও ভারতের লাইসেন্সিং পরীক্ষা হয়। এ পরীক্ষায় আমাদের ক্লাসের অধিকাংশ শেষের সারির শিক্ষার্থীরা পাস করেছেন, যাঁদের অনেকেই ১০-১২টা রিস্টাডি, রিটেক দিয়ে সাবজেক্ট ক্লিয়ার করে প্রভিশনাল সার্টিফিকেট নিয়ে দেশে গিয়ে লাইসেন্সিং পরীক্ষা ক্লিয়ার করছেন। তাঁরা প্রভিশনাল দিয়েই পরীক্ষায় বসতে পারেন। বছরে দুবার সে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পাস করলেই সোজা ইন্টার্ন শুরু। এক বছর ইন্টার্ন শেষে ডাক্তার।

নেপালে লাইসেন্সিং পরীক্ষা হয় চার মাস অন্তর অন্তর। মানে বছরে তিনবার। তারা চীনে ছয় মাস ইন্টার্ন করে সেই পরীক্ষায় বসতে পারেন। এবার পাসের হার ছিল ৭৮ শতাংশ। একবার পরীক্ষায় পাস করলেই ডাক্তার। তাঁদের জন্যও প্রভিশনাল কোনো বাধা নয়।

আমাদের সঙ্গে পড়া মালদ্বীপের শিক্ষার্থীদের সবাই এখন ইন্টার্ন করছেন বাংলাদেশের সরকারি মেডিকেল কলেজে। তারাও ইন্টার্ন শেষ করলে দেশে গিয়ে ডাক্তার হবেন। তাঁদের জন্যও প্রভিশনাল কোনো বাধা নয়।

এবার আসি আমরা হতভাগা কিছু বাংলাদেশির কথায়। মনে হয়, জন্মই যেন আজন্ম পাপ। চীনে ছয় বছর অর্থাৎ ইন্টার্ন শেষ করে তারপর আসল ডিগ্রি সার্টিফিকেট নিয়ে বসতে হয় সোনার হরিণ বিএমডিসি পরীক্ষায়। তাও বছরে দুবার। পাসের হার ৩০-এর আশপাশে ঘুরঘুর করে। পাস করার পর আবার ধরনা দিতে হয় নানান দুয়ারে। তথাকথিত আরও এক বছর ইন্টার্নশিপের জন্য। এখন সেই ইন্টার্নও নাকি দুই বছর করে দেওয়া হয়েছে। যেমন আজব দেশ তেমন আজব তার রীতিনীতি! তারপরই মিলবে সোনার হরিণ বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন। তত দিনে জীবন থেকে অনেকের নাই হয়ে যাবে ন্যূনতম আট বছর।

আমি খুব আশাবাদী মানুষ। দেশ নিয়ে, দেশের মানুষ নিয়ে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিন্তু এখন আর দেশে যাওয়ার সাহস পাই না। আমার ইন্টার্ন শেষ হলেও মেইন ডিগ্রি সার্টিফিকেট পেতে পেতে অক্টোবরের বিএমডিসি পরীক্ষা ধরতে পারব না। তার মানে আরও ছয় মাস অপেক্ষা। ধরতে পারলেও পাসের যা হার, কয়বারে পাস করি তা আল্লাহ জানেন।

আমার সহপাঠীদের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই যখন নিজ দেশে ডাক্তারি করা শুরু করে দিচ্ছেন, তখনো আমার এসব নিয়ে চিন্তা করতে করতে ঘুম হারাম। নিজের গুণ গাইছি না বা সহপাঠীদেরও ছোট করছি না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাঁদের অনেকেই পড়াশোনা কিছুই করত না, পুনঃপরীক্ষা, রিস্টাডি দিয়ে পাস করেছে।

সেকেলে বিএমডিসি এখনো তার পুরোনো রূপেই আছে। কোনো আধুনিকায়ন নেই। দুর্নীতির এক বিশাল আখড়া বানিয়ে রেখেছে আমলাতন্ত্র। দেশের অন্য সব সেক্টরের মতোই। বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষা এখনো চলছে ১৯ শতকের নিয়মে। পেটমোটা আমলাদের নতুনকে বরণ করে নিতে এতই সমস্যা।

একটা প্রশ্ন রেখে গেলাম আক্ষেপের শেষ প্যারায়। প্রতিবেশী দেশসমূহের মতো একটু শিক্ষার্থীবান্ধব নিয়ম-নীতি করলে বিএমডিসির কী এমন ক্ষতি হয়ে যাবে? আর সতিনের ছেলের মতো ব্যবহার করলে আমাদের চীনে এসে পড়ার অনুমতি দিলই বা কেন? কার কাছে পাব আমার এই প্রশ্নের উত্তর। উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ, আমরা যাচ্ছি কোথায়?