লিডসে শেষ হলো রাধারমণ লোক উৎসব
রাতদিন গতি, বর্ণ ও তরঙ্গময় ধামাইল নাচ, হৃদয়স্পর্শী বাংলা লোকগান ও প্রাচীন ইউরোপীয় সংগীত, বিশিষ্টজনদের কথা আর নানাভাষী কবিদের কবিতা দিয়ে শেষ হলো তিন দিনব্যাপী নবম রাধারমণ লোক উৎসব। গত রোববার (২৮ জুলাই) এই উৎসব শেষ হয়।
রাতদিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা, বাঙালিদের বাইরে অবাঙালি শিল্পী ও দর্শকদের সমাগম এবং ইয়র্কশায়ারডেলসের নয়নাভিরাম নিসর্গে বিচিত্র সব পরিবেশনার জন্য এই উৎসব বিশ্বব্যাপী নানা বর্গের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ভারত উপমহাদেশের বাইরে বাংলা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি প্রচারে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ইয়র্কশায়ার ইভিনিং পোস্ট, বিবিসি লিডসসহ বিভিন্ন মূলধারার গণমাধ্যম উৎসব নিয়ে ফলাও করে সংবাদ ও ফিচার প্রচার করেছে। ব্রিটেনের নানা শহর, দেশ–বিদেশ থেকে কবি, শিল্পী, আলোচক ও দর্শকেরা মিলে এক সত্যিকার মিলনমেলা রচনা করেছেন পর পর তিন দিন দুই রাত। রোববার মিলনমেলা ভেঙে যাওয়ার পর শুরু হয় যাঁর যাঁর গন্তব্যের দিকে এক বিষাদঘন প্রস্থান আর পরবর্তী বছরের জন্য উদগ্র অপেক্ষার পালা।
প্রথম দিনের উৎসব শুরু হয় শুক্রবার (২৬ জুলাই) সেন্ট আগ্নেস চার্চে সন্ধ্যা পাঁচটায়। এতে ধামাইল গান পরিবেশন করে শিশুশিল্পী অনন্যা পোদ্দার। সংগীত ও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে কথা বলেন রেভারেন্ড আমোস কাসবান্তে, গাব্রিয়েল হামোম ও কাউন্সিলর আসগর খান। কবিতা পাঠ করেন কবি রোজ ড্রিউ, কবি জুনুমজ নাকভি, নিশাত আফজা, পূরবী কালচারাল অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল কুদ্দুস, আর্জেন্টাইন কবি গাবি সাম্বুসিটি প্রমুখ। লোকনৃত্য পরিবেশন করেন আমেরিকা থেকে আগত অতিথিশিল্পী রোজমেরি মিতু রিবেইরো ও তাঁর দল। শেষের দিকে দিগন্তিকার পরিবেশনায় বাংলা গান ও কবিতার ব্যতিক্রমধর্মী মঞ্চায়ন ছিল এককথায় অপূর্ব! অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ থেকে অংশ নেন সাংসদ মুহিবুর রহমান মানিক।
পরবর্তী সেশন শুরু হয় সাড়ে আটটায় মুরটাউন মেথডিস্ট চার্চে। এতে রবীন্দ্রনাথের লোকসংগীত প্রভাবিত গান পরিবেশন করেন ব্রিটেনের অন্যতম শীর্ষ রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। পিয়াস বড়ুয়ার তবলা সহযোগিতায় লোকসংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী অমিত দে ও লাবণি বড়ুয়া। প্রাচীন ইউরোপীয় সংগীত পরিবেশন করেন গ্রাহাম রাইট। পার্সিয়ান লোকসংগীত পরিবেশন করেন জামশেদ ফুলাদ। কবিতা পাঠ করেন বিবিসির তরুণ পুরস্কার বিজয়ী কবি লোরা পট, ইউরোপ স্লাম চ্যাম্পিয়ন কবি ডেভিড লি মরগ্যান, তাহিরা রেহমান, ইয়াসমিন হোসেইন ও নাদিম রাথুর প্রমুখ। এতে মৌলবাদ মোকাবিলায় সংগীত শীর্ষক আলোচনায় অংশ নেন কাউন্সিলর শ্যারন হ্যামিলটন।
রাত ১১টা থেকে শুরু হয় স্কামোন্ডেন লেকের পাড়ে রাতব্যাপী বাংলা লোকগান, কবিতা ও নেটওয়ার্কিংয়ের আসর। এতে অতিথি হিসেবে যোগ দেন ক্যামেন আইল্যান্ডের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও শীর্ষ ব্রিটিশ কূটনীতিক আনোয়ার চৌধুরী। রাতব্যাপী গান পরিবেশন করেন সুফি আমির মোহাম্মদ, লাবণি বড়ুয়া ও অমিত দে। কবিতা পাঠ করেন মানস চৌধুরী ও শাহিন মিতুলি প্রমুখ।
পরদিন শনিবার (২৭ জুলাই) দুপুর সাড়ে ১২টায় চ্যাপেল টাউনের রেজিনাল্ড সেন্টারে শুরু হয় উৎসবের দ্বিতীয় দিনের প্রথম সেশন। এতে অতিথি হিসেবে যোগ দেন ব্রিটেনের শ্যাডো পিস অ্যান্ড ডিসয়ার্মামেন্ট মন্ত্রী ফ্যাবিয়ান হ্যামিলটন এমপি। সাংসদ ফ্যাবিয়ান তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘বাঙালি সংস্কৃতির জাদু আমাকে সত্যিই সম্মোহিত করেছে। যতবারই আমি এই উৎসবে এসে হাজির হই, আমি বুঝতে পারি কী গৌরবজনক এই ঐতিহ্য। গান, নাচ আর কবিতার কী অভূতপূর্ব মঞ্চায়ন। আর এই উৎসবে এসে বাঙালি মানুষদের পাশাপাশি বিপুল অবাঙালি দর্শক ও শিল্পীদের অংশগ্রহণ ও তাঁদের বিচিত্র পরিবেশনা দেখতে পাই, যা আমাকে সত্যিই অভিভূত করে।’
রেজিনাল্ড সেন্টারে গান পরিবেশন করেন শিল্পী ইয়াওর মিয়া, অমিত দে, জেইনা আনোয়ার, নন্দিতা মুখার্জি ও সুফি আমির মোহাম্মদ। জীবনানন্দ থেকে পাঠ করেন মাইক শেরিফ ও জসীমউদ্দীন থেকে পাঠ করেন মানস চৌধুরী। স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন শাফাকাত পারভীন। অক্সিটান ভাষার ট্রবাডোর সংগীত পরিবেশন করেন এরিক শিলান্ডার। নৃত্যে অংশ নেয় শিশুশিল্পী লিওনা চক্রবর্তী ও সোনিয়াস ফিউশনের লুজার্ন, নন্দিনী ও সোনিয়া। উৎসবের বিভিন্ন দিক নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন সৈয়দ এনাম ও কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব আবদুল কুদ্দুস।
বিকেলে অপূর্ব রাউন্ডহে লেকের পাড়ে বারবিকিউ উইথ মিউজিক সেশনের পর সেভেন আর্টস থিয়েটারে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় শুরু হয় এক অভূতপূর্ব সম্মোহনী সংগীতসন্ধ্যা। মিলি বসু ও ড. তপতি মুখার্জির কবিতা পাঠ, সোহেল আহমেদ ও সোনিয়া সুলতানার দ্বৈত নাচের পর ড. ইমতিয়াজ আহমেদ পরিবেশন করেন পরপর তিনখানা ধ্যানমগ্ন রবীন্দ্রসংগীত। তারপর মঞ্চে আসেন বিদুষী চন্দ্রা চক্রবর্তী। হামিত ওয়ালিয়ার তবলা সহযোগিতা ও অমিত দের কণ্ঠ ও কিবোর্ড সহযোগিতায় হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশাপাশি তিনি গজল, টপ্পাসহ বিভিন্ন লঘুসংগীত এবং বিভিন্ন রাগের সঙ্গে বাংলা লোকসংগীতের কিছু অভূতপূর্ব অথচ সম্মোহনী পরিবেশনা দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন হল ভর্তি দর্শকদের।
পরিবেশনা শেষ হলে দর্শকেরা দাঁড়িয়ে শিল্পীকে সম্মান জানান। শো পরবর্তী এক প্রতিক্রিয়ায় আনোয়ার চৌধুরী বলেন, ‘আমি এর আগে কোথাও এমন শ্বাসরুদ্ধকর সংগীত শুনিনি। শাস্ত্রীয়সংগীতের অভ্যন্তরীণ প্রযুক্তি আমি একদম না বুঝলেও প্রত্যেকটা সেকেন্ডে এই সম্মোহনী সংগীতের শক্তি আমি অনুধাবন করেছি।’
পরবর্তী সেশন স্কামন্ডেন সেন্টারে রাত ১১টায় শুরু হয়ে শেষ হয় ভোর চারটায়। এতে যোগ দেন ব্রিটেনে বাংলা লোকগানের রাজকুমারী গৌরী চৌধুরী। এ ছাড়া ছিল শিশুশিল্পী সুভাঙ্গী দাম ও স্বয়ম দাম।
উৎসবের শেষ দিন রোববার (২৮ জুলাই) বাংলাদেশ সেন্টারে অতিথি হিসেবে যোগ দেন কাউন্সিলর আসগর খান, লিডস সিটি কাউন্সিলের প্রধান কর্মকর্তা শাইদ মাহমুদ, আনোয়ার চৌধুরী ও সাংসদ মুহিবুর রহমান মানিক। দিনভর লোকগান ও ধামাইল নাচের পাশাপাশি সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার বিভাগের তরুণ অধ্যাপক ও নাট্যনির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী। যুগ্ম উপস্থাপনায় অংশ নেন গীতিকার জাহাঙ্গীর রানা।
আনোয়ার চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘৯ বছর আগে আমি এসেছিলাম এই শহরে যখন রাধারমণ উৎসবের গোড়াপত্তন হয়। আজ ৯ বছর পরে এসে দেখলাম এই উৎসব নানা ভাষা সংস্কৃতির মানুষের অংশগ্রহণে, বিচিত্র সব পরিবেশনায়, একটা সত্যিকারের উৎসবে পরিণত হয়েছে। আমি সত্যিই মুগ্ধ। আমি আশা করব সামনের বছর উৎসবের ১০ বছর উদ্যাপনের অংশ হিসেবে অন্তত দশখানা রাধারমণের গান বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে অবাঙালিদের কাছে রাধারমণের কাব্যিক সৌন্দর্য তুলে ধরা হবে।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাংসদ মানিক বলেন, ‘আমি অভিভূত হয়ে গেছি তিন দিন ধরে বাংলা লোকসংগীতকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার এই কর্মযজ্ঞ অবলোকন করে। বাংলার লোকসম্পদকে এভাবে ৯ বছর ধরে যাঁরা ছড়িয়ে দিচ্ছেন এই লিডসে, আমি আশা করি এই সংগীতকে এবং এর সঙ্গে বহমান আমাদের প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যকেও তাঁরা তুলে ধরবেন ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে, এমনকি ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও।’
উৎসবের কিউরেটর কবি টি এম আহমেদ কায়সার বলেন, ‘এই উৎসব শুধু গান, কবিতা আর নাচের উৎসব নয়। আমরা এর মাধ্যমে প্রচার করি আমাদের ভালোবাসা ও গভীর মানবিকতা। হাতে দিন গুনে বিপুল আনন্দ নিয়ে যে উৎসবের সূচনা হয়, দর্শকেরা আসেন দূর–দূরান্তের শহর থেকে, তিন দিনের কর্মযজ্ঞে শিল্পী দর্শকদের মাঝে রচিত হয় এক মানবিক বন্ধন। তাঁরা অশ্রুসজল হয়ে বাড়ি ফেরেন। আমি জানি না, এমন অনুভূতি আর কয়টা অনুষ্ঠান শেষে হয়।’
কায়সার আরও বলেন, ‘এই উৎসবের একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও আছে। তা হলো গান দিয়ে মানুষের ভেতরের উগ্র ধর্মীয় গোঁড়ামিকে জয় করা। আমার ধারণা আমরা একটু একটু করে জয় করছি প্রতিবছর। ইতিবাচক দিক হলো প্রতিবছরই এতে যোগ দিচ্ছেন বিপুলসংখ্যক অবাঙালি দর্শক ও শিল্পীরা। ফলে তা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বময়। নানা সংস্কৃতির মানুষেরা অবগাহন করছেন আমাদের লোক সংগীতের মায়ায়। দেশ–বিদেশের প্রগতিশীল মানুষদের এই উৎসব গানে, কথায় ও কবিতায় একই প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করাতে চায়, আশা করি সেদিনও আর খুব দূরে নয়।’