বন্ধু মানে কী?

বন্ধুদের সঙ্গে লেখিকা
বন্ধুদের সঙ্গে লেখিকা

আসলে বন্ধু মানে কী? মানবতা। পরিবারের বাইরে ছোট ছোট পা ফেলে জীবনের শুরু। তখন থেকেই বন্ধুত্বের সূচনা। তারপর হোঁচট খেলেই দৃশ্য বা অদৃশ্য হাত ধরে জীবনসংগ্রামে বেঁচে থাকা। দুঃখের সময় একটা শোল্ডারে কাঁদার আর দুঃখ ভোলার আনন্দ।

ছোট্টবেলায় বন্ধু সুজনের বাসায় ওর নানুর কাছ থেকে চেয়ে চা খেতাম। আম্মুর নিষেধ ছিল আমাকে চা দেওয়ার। কিন্তু সুজনের কান্নাকাটিতে চা পাওয়ার কোনো অসুবিধে হয়নি আমার।

বেশি ছোট হওয়ায় খেলায় পাত্তা পেতাম না আমি আর সুজন। বাগানে বাগানে প্রজাপতি ধরে কেটে যেত আমাদের দিনকাল। পাশের বাসার রুমনের মামা একবার ওকে ঘুঙুর কিনে দিল। একটু পরতে দেওয়ার বিনিময়ে পিঠা ভাগ করে খেয়েছিলাম মনে আছে।

পাশের বাসার পুতুল–মেয়ে হিনা আসার পর থেকে স্কুলের অনেকগুলো বছর ওর সঙ্গে খেলে। প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে ওদের বাসায় বা আমাদের বাসায় সারা দিন থেকে খেলে কেটে যেত। তখন সবাই আচার বানাত খুব। তেঁতুল চুরি করে মেখে খেতে খেতে কলোনিতে হাঁটতাম। দস্যি হওয়ার কারণে বিশাল খেলার বন্ধু দল ছিল। ঝগড়া হলে কারও না কারও বাংলোয় নিজের দলসহ খেলতে চলে যেতাম।

কলেজে বান্ধবীরা মিলে ব্যাগে কে কাঠচাঁপা ফুল বা কবিতা রেখে যেত লেকচার গ্যালারিতে, সে গবেষণা করে কেটে যেত। তারপর টিফিনে ক্যারম খেলা বা শিঙাড়া খাওয়ার সেই দিনগুলো মাঝেমধ্যে খুব মনে হয়।

এরপর মেডিকেল হোস্টেলের সেই দিনগুলো। ফাস্ট ইয়ারে বাসার জন্য কান্নাকাটি করে চরম বিরক্তিকর চরিত্র হয়ে উঠলাম। কিন্তু এর মধ্যেও বান্ধবীরা মিলে বাইরে খেতে যাওয়া, ক্যাসেট প্লেয়ার জোগাড় করে গান শোনা, সবকিছুতেই মন ভালো করার চেষ্টা। মানে এই প্যানপ্যানানিরও অনেক ভালো কিছু বন্ধু হয়ে গেল। তক্ষকের সঙ্গে ‘আমার রানি রে’ গাওয়া কমনরুমে ছিল নিত্যবিনোদন।

এর মাঝে ছাদের কাছাকাছি রুম পেলাম আমরা। এক্সটেনশনে সিঁড়ির কাছে যেখানে বিদেশি আপুরাও থাকত। তত দিনে আমি একটা ক্যাসেট প্লেয়ারের মালিক। একদিন এক নেপালি আপু এসে মহা আদুরি গলায় বলে গেলেন, ‘আপুরা, তোমরা গান আস্তে শোনো। ছাদে পড়ি তো।’ মাথা নেড়ে প্রায় খুলে ফেলার জোগাড় করলাম। অবশ্যই আপু। তারপরই তাঁকে বই নিয়ে ছাদে উঠতে দেখলেই বিকট শব্দে ‘রূপ তেরা মাসতানা গান’। ছাদ থেকে দৌড়ে আসতে তার চার-সাড়ে চার মিনিট সময় লাগত। ততক্ষণে অনেকটুকু গান শোনা শেষ।

গোসলের সময় হেঁড়ে গলার গান তো ছিলই। বান্ধবী কলি যে পুরো সুচিত্রা সেনের মতো দেখতে, যার পছন্দও উত্তম-সুচিত্রার সিনেমার গান, মাঝেমধ্যে ছাদে হাঁটতে গিয়ে গাইতে বলত, ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই’ বা ‘যখন জমেছে মেঘ আকাশে’। অতি আবেগ নিয়ে দুই লাইন গেয়েই শুরু করতাম, ভাবি তোমাকে, রজনী গন্ধা...।

তারপর আজীবন বাইরে বড় হওয়া রিতাকে দিয়ে রুনকে বলিয়েছি রুন আকাশের চাঁদের মতো। তোমাকে আমি অর্ধচন্দ্র দিতে চাই। চার বান্ধবী মিলে একবার স্কলারশিপের টাকা দিয়ে আড়ং থেকে একই রকম ড্রেস কিনে ফেললাম। মানুষ দেখলেই কেন হাসত, আমি এখনো বুঝি না। একসময় গভীর রাতে ছাদে যাওয়া নিষেধ করা হলো। তাতে উৎসাহ দ্বিগুণ হলো। গভীর রাতে হোস্টেলের পাশের রাস্তায় কে যেন বাঁশি বাজাত।

বিদেশে চাকরিতে জয়েন করে একটা পাগলা গ্রুপ তৈরি হয়েছে। যত দুঃখই আসুক একসঙ্গে শেয়ার করি। অনেক হালকা লাগে। বিগ বস একবার প্রো বাজিয়েদের নিয়ে ব্যান্ড গড়লেন। আমরা পাত্তা না পেয়ে গড়ে ফেললাম আমাদের নিজস্ব ব্যান্ড। যা পারি তা–ই। কারও সঙ্গে কারও এক বিন্দু মিল নেই চেহারায়। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে সবাই কেমন যেন একই।

বন্ধু ছাড়া জীবন অচল। সবাই ভালো থাকুন পাশের বন্ধুটিকে নিয়ে। আহ্‌, বন্ধু দিবস।