প্রাণের মানুষ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অলংকরণ: আরাফাত করিম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে/ তাই হেরি তায় সকল খানে...।’

বইয়ের পাতায়, আঁকার খাতায়, আমার জীবনের বিশাল একটা অংশ জুড়ে আছেন রবিঠাকুর। একেবারে ছোটবেলায় নানুর বাসায় বেড়াতে গেলেই বায়না ধরতেন নানু—এটা শোনাও...সেটা শোনাও...। কচি কণ্ঠে আমার তখন ‘আয় তবে সহচরী’ বা ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’-ই সম্বল।

নানা ও দাদা, দুজনেই পৃথিবী ছেড়েছেন আমার জন্মের আগে। দাদি যখন গেছেন, আমার তখন মাত্র বছরখানেক বয়স। আমি একমাত্র নানুকেই চিনেছিলাম। আর নানু মানেই রবীন্দ্রনাথের গান।

গান শোনার পাল্টা বায়না আমিও ধরতাম মাঝেমধ্যে। নানু তখন মিষ্টি, কিছুটা বিরহী সুরে ধরতেন—‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ/ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন/ আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন...।’

বেড়ে উঠেছি ক্যাসেট প্লেয়ারে সাগর সেন আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মধুমাখা কণ্ঠ শুনে। সঙ্গে আমাদের রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও সাদী মহম্মদ তো ছিলেনই। তত দিনে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে (বাফা) পাঠ শুরু করেছি। বয়সের সঙ্গে কণ্ঠের ব্যাপ্তি বাড়ছে। বাড়ছে নানুর বায়নাও। তখন আমার কণ্ঠে বাউলাঙ্গ, কীর্তনাঙ্গ আর রাগাশ্রয়ী গানগুলো শুনতে চাইতেন নানু। আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করতাম।

একা আমি নই। আমার সঙ্গে কণ্ঠ মেলাত আমার প্রিয় বন্ধু, আমার বড় ভাই। বড় দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোটটির সঙ্গে আমার সখ্য বেশি ছিল, আমার পাঠকেরা জানেন সে গল্প। আচমকা দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু আমার মনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছিল। গান গাওয়া হয়তো ছেড়েই দিতাম, যদি না গোটা পরিবার উৎসাহ জোগাত আমায়। কয়েক বছর পর, কিছু বার্ধক্যজনিত রোগের কাছে হার মানলেন নানু। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আর নয়। এবার হয়তো বিদায় জানাব রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু চাইলেই কি হয়? বিশ্বকবি আমার প্রাণের মানুষ যে!

নবম শ্রেণির বাংলা ক্লাসে হাতে তুলে নিয়েছিলাম চকচকে, মোটাসোটা একটা বই। যা আমার পাঠ্যসূচির মধ্যেই ছিল। কী বই? গল্পগুচ্ছ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পের ঝুড়ি। এ বইটির ভেতর দিয়ে নতুন করে জানলাম কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির এ মেধাবী মানুষটিকে। ক্লাসে কঙ্কাল, সমাপ্তি বয়া কাবুলিওয়ালা পড়তে পড়তে ঢুকতে চেষ্টা করতাম চরিত্রগুলোর ভেতর। মিষ্টি মিনির জন্য কাবুলিওয়ালা সত্যি ঝোলার ভেতর হাতি নিয়ে আসতেন কি না, ভেবে হাসতাম। ভালো লাগত কাবুলিওয়ালার স্নেহশীল পিতৃরূপ। সমাপ্তির মৃণ্ময়ী কেন এত দুরন্ত? একটু স্থির হতে পারে না সে? কঙ্কালের সেই অতৃপ্ত আত্মার মধ্যেই যেন দেখতে পেতাম সে যুগের অকাল বিধবাদের জীবন। ছুটি গল্পে ফটিকের শেষ পরিণতি পড়লে চোখ ভিজে আসে আজও। মামিরা এতটা নিষ্ঠুর ছিলেন সে যুগে? এ কি সম্ভব?

আর গান ভুলতে চাইলেই কি ভোলা যায়? আমি ফাল্গুনী, রাত–দিন গুনগুনই! সেই গুনগুন ঘরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে পৌঁছেছিল পরিবারের নতুন একজন সদস্যর কানে। তখন আমি দশম শ্রেণিতে। দরজায় কড়া নাড়া মাধ্যমিকের প্রস্তুতিতে জেরবার অবস্থা তখন আমার। জন্মদিনে গভীর রাতে ডেকে তুলেছিলেন ভাবি। ‘এ অবস্থায় আমার পক্ষে তোমার উপহারটা দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। মায়ের ঘরে এসে দেখে যাও।’

আম্মুর ঘরের মেঝেতে দেখতে পেলাম আমার জন্য ভাবির প্রথম স্নেহাশিস, চামড়ার ব্যাগে মোড়ানো ঝকঝকে নতুন হারমোনিয়াম। আনন্দে চেঁচালাম—এটা আমার? সত্যি?

‘আবারও গান শিখবে তুমি। নিজের জন্য আর...’ কথা শেষ করার আগেই কঁকিয়ে উঠেছিলেন ভাবি। ওর ‘এ অবস্থা’ ততক্ষণে মায়ের পেটে কষে লাথি ছুড়েছে যে। বুঝলাম, খুদেটিও হয়তো চায় ইশুর কণ্ঠে গান ফুটুক। ছোট্ট ভাইপোটির জন্মের পরে ওকে বুকে নিয়ে শুরু হতো আমার আবার ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি...’ রবিঠাকুরের সুরের মায়ায় খুদেটি আরামে ঘুমাত আমার বুকে। আমার ঘুম পাড়ানোও হতো, চর্চাও হতো।

পরীক্ষার পর আবার ফিরে গেলাম বাফায়। ভর্তি হলাম চার বছর মেয়াদি সার্টিফিকেট কোর্সে। কণ্ঠে ফিরে পেলাম প্রিয় রবীন্দ্রসংগীতের সুর। পরিচিত হলাম রবীন্দ্র সৃষ্ট আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে। চিত্রাঙ্গদা প্রমাণ করে, নারী মানেই শুধু রূপ মাধুরী নয়, যোগ্যতাবলে নারী হয়ে ওঠে অনন্যা।

রবীন্দ্রনাথ আমার প্রথম প্রেম। এখন তো বিশ্বকবির চিত্রকলা, উপন্যাস, কবিতা ইত্যাদি আরও অনেক কিছুর প্রতিই ঝোঁক তৈরি হয়েছে। আর কোনো দিন ভুলতে চাই না আমার প্রাণের মানুষকে। তাঁর সৃষ্টির মাঝে শক্তি খুঁজে পাই যে!