আইনের প্রয়োগ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জার্মানিতে আমার এক সহকর্মীকে রাতে খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিলাম। ভদ্রলোক আমার কাছ থেকে একটু–আধটু বাংলা শেখেন। সেই জন্য তাঁর সঙ্গে সখ্য একটু বেশি।

নির্দিষ্ট সময়ে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ ভদ্রলোকের ফোন পেলাম।

: ‘আমি আপনার বাসার কাছে গাড়ি পার্ক করেছি। বাসা খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘আমি এখনই আসছি। বললাম আমি।’

ওখানে গিয়ে দেখি, ‘ভদ্রলোক রাস্তার ওপারে ট্রাফিক লাইটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।’ আমি হাত নেড়ে বললাম, ‘রাস্তা ক্রস করুন।’

তিনি আমাকে সিগন্যাল দেখিয়ে বললেন, লাল।

আমি উত্তর–দক্ষিণ–পূর্ব–পশ্চিমে তাকিয়ে কোনো জীবন্ত প্রাণীকে দেখলাম না। পুলিশ তো দূরের কথা, একটি গাড়িও নেই।

আমার বাঙালি মাথায় জিনিসটি ঢুকল না। যেন ‘মাথার ওপর দিয়ে গেল’। ১০ সেকেন্ড অপেক্ষা করে সবুজ সিগন্যালে তিনি পার হয়ে এলেন। তাঁকে নিয়ে বাসায় ঢুকলাম।

আমার ঢাকার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। দুই বছর আগে বইমেলা উপলক্ষে যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম, রাস্তায় হাঁটছি। হঠাৎ সেনাবাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার গাড়ি ঘ্যাঁচ করে আমার সামনে এসে দাঁড়াল।

আমি কিছু বলার আগেই কর্মকর্তা গাড়ি থেকে নেমে আমার হাত চেপে ধরে বললেন, কি তারিক, আমাকে চিনতে পেরেছ?

আমি অনেক দিন দেশের বাইরে। তারপরও তাঁকে চিনতে পারলাম।

তিনি জোর করে তাঁর গাড়িতে আমাকে বসালেন। বললেন আজকে সারা দিন আমার সঙ্গে থাকবে।

এত দিন পরে পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে ভালোই লাগল। গাড়িতে এখানে–সেখানে যাচ্ছি। দেখলাম তিনি কোথাও ট্রাফিক লাইটের পরোয়া করছেন না।

আমি তাঁকে একটু ব্যঙ্গ করে বললাম, ‘তুমি কি কালার ব্লাইন্ড, লাল বা সবুজ ট্রাফিক সিগন্যালের পার্থক্য বোঝ না!’

বন্ধু তাৎক্ষণিক উত্তর দিলেন, ‘তারিক, তুমি কি অন্ধ। তুমি কি আমার গাড়ির সামনের ফ্ল্যাগটি দেখছ না।’

যাহোক, জার্মান সহকর্মীর সঙ্গে ডিনার করার পর আমরা গল্প শুরু করলাম। সাহিত্য, রাজনীতি থেকে শুরু করে চলে এলাম শেষে দুর্নীতিতে।

তিনি বললেন, ‘জানেন, জার্মানিতেও আগে এত ডিসিপ্লিন ছিল না। আমরাও তো মানুষ, কোনো ফেরেশতা নই। অন্যান্য জাতির মতো দুর্নীতি আমাদের মাঝেও ছিল।’

ফ্রিজ–টেলিভিশন নষ্ট হয়ে গেলে রাস্তার পাশে রেখে আসতাম। কে আবার কষ্ট করে শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ময়লার ডিপোতে ফেলে আসবে? রাস্তায় ময়লা ফেলতে দ্বিধা করতাম না। তারপর সরকার এমন ফাইন করা শুরু করল যে ভয়ে সবাই অস্থির। আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন, জার্মানির কোনো দোকানেই আপনি একটি খাদ্যদ্রব্য পাবেন না, যেটার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ধরা পড়লেই ওই দোকানের মালিকের অবস্থা কাহিল। তাঁকে লোটা-কম্বল গুটিয়ে শ্রীঘরে যেতে হবে।

আমি বললাম, তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন দুর্নীতি দমাতে হলে...।

জার্মান সহকর্মী আমাকে থামিয়ে দিয়ে আমারই শেখানো বাংলায় বললেন: আইনের প্রয়োগে সবাই সোজা।

মুচকি হেসে আমাকে শুভরাত্রি জানিয়ে সহকর্মী চলে গেলেন।