বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এখন আর স্বপ্ন নয়

বক্তব্য দিচ্ছেন শেখ মুহম্মদ বেলাল
বক্তব্য দিচ্ছেন শেখ মুহম্মদ বেলাল

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা এখন আর কেবল স্বপ্ন নয়। এখন তা এক বিমূর্ত সত্য। সব বাংলাদেশিরই আজ একই অনুভূতি। প্রকৃতপক্ষে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই সত্যের বাস্তবায়নও আমাদের দায়িত্ব।

নেদারল্যান্ডসে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা এবং উপস্থিত সবাই এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সঙ্গে শাহাদত বরণকারী পরিবারের সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনকালে বক্তারা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে নিজ নিজ প্রত্যয় ঘোষণা করেন।

জাতীয় শোক দিবসের এ অনুষ্ঠানে দ্য হেগ মিউনিসিপ্যালটির সাবেক ডেপুটি মেয়র ও তাঁর স্ত্রী, বাংলাদেশ কমিউনিটির সদস্য ও দেশটির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এবং পরিবারসহ দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় শাখার নেতা-কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন।

বক্তব্য দিচ্ছেন রবীন বলদেব সিং
বক্তব্য দিচ্ছেন রবীন বলদেব সিং

আলোচনা অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতার মধ্যে মোস্তফা জামান, মুরাদ খান ও ইমরান হোসেন বক্তব্য দেন। তাঁরা বঙ্গবন্ধুর জীবন, আদর্শ, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর পরিশ্রমের ও দৃঢ় সংকল্পের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। ১৫ আগস্টের জঘন্য হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে তাঁরা একে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে অভিহিত করেন।

তাঁরা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায়ের আংশিক কার্যকারিতায় সন্তোষ প্রকাশ এবং আদালতের রায় সম্পূর্ণভাবে কার্যকর করার জন্য পলাতক খুনিদের অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে এনে রায় বাস্তবায়নের আহ্বান জানান। তাঁরা যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বের প্রশংসা এবং উল্লেখ করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার প্রকৃতপক্ষে সোনার বাংলার স্বপ্নকে একটি বাস্তব রূপ দান করছে।

বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বদরুল হাসান। তিনি ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ বিনির্মাণের রাজনৈতিক দর্শন’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। প্রবন্ধে তিনি বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন ও অগ্রগতির কথা এবং কীভাবে বাংলাদেশ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একের পর এক মাইলফলক অর্জন করছে তা তুলে ধরেন।

তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও অধিকার অর্জনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর সাহসিকতার কোনো সীমা ছিল না। তাঁর অভিধানে ভয় নামক কোনো শব্দের অস্তিত্ব ছিল না।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি বলেন, অকুতোভয় এই নেতার দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমেই বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ ছাড়া তাঁর ফলপ্রসূ কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভসহ ১৯৭২-৭৫ পর্যন্ত সময়ে বিশ্বের প্রায় ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি লাভ করে।

বিভিন্ন বক্তা
বিভিন্ন বক্তা

হেগ মিউনিসিপ্যালটির সাবেক ডেপুটি মেয়র রবীন বলদেব সিং বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, যিনি তাঁর ৭ মার্চের কাব্যিক ও সম্মোহনী ভাষণের মাধ্যমে সারা বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। বাংলাদেশকে শান্তি ও সম্প্রীতির দেশ হিসেবে অভিহিত করে এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।

বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার প্রশংসা করে রবীন বলদেব সিং বাংলাদেশকে উন্নয়নের বিস্ময় হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বাংলাদেশকে নিয়ে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের উদ্ধৃতি মিথ্যা প্রতিপন্ন করায় বাংলাদেশকে অভিনন্দনও জানান। এ ছাড়া বাংলাদেশের মানুষের ইতিবাচক মানসিকতার প্রশংসা করে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে অচিরেই বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর আজন্মলালিত স্বপ্ন সোনার বাংলাকে বাস্তব রূপ দিতে সক্ষম হবে।

দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ মুহম্মদ বেলাল বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাংলাদেশের জনগণের জন্য তাঁর অপরিসীম ভালোবাসার প্রতি আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা, নিবেদিতপ্রাণ ও দূরদর্শিতা ছিল অদ্বিতীয়। পাকিস্তানি দুঃশাসন থেকে বাঙালিদের মুক্তির জন্য তাঁর জীবনব্যাপী সংগ্রাম পৃথিবীর বিভিন্ন মুক্তিকামী জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করেছে। একটি স্বাধীন জাতি গঠনে বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য ছিলেন আশীর্বাদস্বরূপ। রাষ্ট্রদূত বেলাল পৃথিবীর বিভিন্ন বিখ্যাত নেতা, যাঁরা নিজ নিজ জাতির জাগরণে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুর অদম্য সাহস ও দূরদর্শিতার বর্ণনা তুলে ধরেন।

বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরে রাষ্ট্রদূত বেলাল উল্লেখ করেন নিপীড়িতদের পক্ষে দাঁড়ানোর মাধ্যমে কীভাবে বঙ্গবন্ধু ফরাসি বিপ্লবের আদর্শকে ধারণ করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় ন্যাম সম্মেলনে যোগদানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু আমাদের কূটনীতিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। এ সম্মেলন চলাকালে বিশ্বখ্যাত নেতৃবৃন্দ যেমন যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, আলজেরিয়ার বুমেদিন, তাঞ্জানিয়ার নায়ার প্রমুখ নেতাদের বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁর বিশালতাকেই তুলে ধরে। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্ব ও অদম্য মানসিকতার জন্যই যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু করে।

রাষ্ট্রদূত বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রতিও গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, যিনি জাতির পিতার সঙ্গে আজীবন জড়িয়ে ছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি উল্লেখ করেন, বঙ্গবন্ধুর কারাবাসকালে বঙ্গমাতাই সন্তানদের মানুষ করার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে নীরবে কাজ করেছেন।

শেখ মুহম্মদ বেলাল আরও মন্তব্য করেন, বঙ্গবন্ধুর অসময়ে প্রস্থান আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকেই ব্যাহত করেনি, বরং আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনেও নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি করেছিল। তবে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ তার সঠিক পথ খুঁজে পেয়েছে।

তিনি বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন থেকে সহাবস্থান ও ধর্মনিরপেক্ষতার শিক্ষা নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখার আহ্বান জানান। আধুনিককালের একজন যোদ্ধা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে যাঁর যাঁর দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি সবাইকে আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য জাতির পিতার দেখানো পথে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নিজেদের নিয়োজিত করার আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানে শিশু-কিশোরদের জন্য একটি পৃথক পর্ব ছিল
অনুষ্ঠানে শিশু-কিশোরদের জন্য একটি পৃথক পর্ব ছিল

শিশু-কিশোরদের বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আরও বেশি করে জানানোর প্রত্যয়ে অনুষ্ঠানে শিশু-কিশোরদের জন্য একটি পৃথক পর্ব ছিল। শিশুরা তাদের উপস্থাপনায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শকে তুলে ধরে। রাষ্ট্রদূতের সহধর্মিণী ড. দিলরুবা নাসরিন শিশুদের মাঝে স্মারক উপহার প্রদান করেন। এরপর ১৫ আগস্টের শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা এবং দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।

এর আগে সকালে দূতাবাস ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকী পালনের অনুষ্ঠান শুরু হয়। পরে পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহ থেকে পাঠ এবং বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কর্তৃক প্রদত্ত বাণীসমূহ উপস্থিতিদের সামনে পাঠ করে শোনানো হয়।

কর্মব্যস্ত দিন হওয়া সত্ত্বেও দিবসটি পালন উপলক্ষে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রবাসী বাঙালি প্রতিকূল আবহাওয়াকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশ দূতাবাসে উপস্থিত হন। এই উপস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃক সেবা সহজীকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক নবপ্রবর্তিত অ্যাপভিত্তিক কনস্যুলার সেবা ‘দূতাবাস’ সম্পর্কে প্রবাসী বাঙালিদের অবহিত করা হয়।

এ ছাড়া জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে দূতাবাস কর্তৃক আগামী ২৯-৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে ‘বঙ্গবন্ধু স্মরণে’ শিরোনামে তিন দিনব্যাপী যে চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে, সে সম্পর্কেও অবহিত এবং সব প্রবাসীকে তাঁদের ডাচ বন্ধুবান্ধব ও পরিবারসহ এই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। বঙ্গবন্ধুর জীবনীর ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়। বিজ্ঞপ্তি