প্রবাসজীবনে আমাদের ঈদ

ঈদের নামাজ শেষে সবাই
ঈদের নামাজ শেষে সবাই

ছোটবেলায় পড়েছিলাম ঈদ মানে আনন্দ। স্কুল-কলেজজীবনে আসলেই ঈদ মানেই ছিল আনন্দ। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে এসে বুঝলাম, ঈদ মানে বাড়ি ফেরা এবং পরিবারের সবার সঙ্গে কিছু আনন্দের সময় কাটানো।

প্রবাসজীবনে এসে আবারও ঈদের মানে বদলে গেল। এখন ঈদ মানে মনের ভেতর অনেক কষ্ট জমিয়ে রেখেও বাসার সবার সঙ্গে হেসে কথা বলা আর কোনোমতে দিনটা অতিবাহিত করা।

হয়তো ভবিষ্যৎ জীবনে আবারও ঈদের অর্থটা বদলে যাবে। মানুষ পরিবর্তনশীল। তাই জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে একই জিনিসের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ পায়।

প্রবাসজীবনে এটা আমার তৃতীয় ঈদ। এবারের ঈদ ছিল রোববার, ছুটির দিন।

যদিও এবারের ঈদ যে শহরে থাকি, সেখানে করিনি। ঈদের কিছুদিন আগে রিফাত ভাই আর অর্পা বলল, তারা আইডাহো ফলসে যাবে ঈদ করতে। ওখানে নয়জন বাংলাদেশি আছেন। তাঁরা সবাই আইডাহো ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে ফুল টাইম জব ও ইন্টার্নশিপ করছেন। আমিও যেন তাদের সঙ্গে যাই।

ঈদের নামাজ শেষে
ঈদের নামাজ শেষে

অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম, একা একা ঈদ করার চেয়ে সবার সঙ্গে ঈদ করাই ভালো। সঙ্গে বোনাস হিসেবে একটা নতুন শহর ও নতুন কিছু জায়গায় ঘোরাঘুরি করার সুযোগ তো আছেই।

শনিবার দুপুরে আমরা চারজন (আমি, অর্পা, রিফাত ভাই ও সোহেল ভাই) রওনা দিলাম তানিম ভাইয়া আর রাকিবা আপুর বাসার উদ্দেশে। বইসি থেকে আইডাহো ফলসের দূরত্ব ২৫৪ মাইল বা ৪০৪ কিলোমিটার, যেটা আমরা চার ঘণ্টায় পৌঁছেছি। এখানে এটাই খুব সুবিধার। ড্রাইভ করে কোথাও যাওয়াটা মজার। বাংলাদেশে রোড জার্নিটা অনেক বিরক্তিকর।

যা হোক, আমরা দুপাশে পাহাড় আর পাইনগাছকে পেছনে ফেলে ছুটে চলেছি নিজেদের গন্তব্যে।

উইন্ডমিল
উইন্ডমিল

পৃথিবীর সুন্দর গাছের মধ্যে পাইন অন্যতম। পৃথিবীতে প্রায় ১২৬ প্রজাতির পাইনগাছ রয়েছে। প্রজাতিভেদে গাছের গড় উচ্চতা ১৫ থেকে ৪৫ মিটার। এরা দীর্ঘজীবী। কোনো কোনো প্রজাতি ১০০ বছর থেকে ১০০০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। তবে এর চেয়েও বেশি বয়সী পাইনগাছ দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় হোয়াইট মাউন্টেন পাহাড়ে। পাইনগাছের এ প্রজাতির ইংরেজি নাম ‘গ্রেট বেসিন ব্রিস্টলকোন পাইন’। হোয়াইট মাউন্টেন পাহাড়ে এ প্রজাতির অসংখ্য গাছ রয়েছে। এর মধ্যে ‘মেথুসিলা’ নামক পাইনগাছটি এ পাহাড়ের, এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক গাছ। বিজ্ঞানীদের মতে, গাছটির বয়স প্রায় ৪ হাজার ৮৪৮ বছর।

আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ দিয়ে যেতে যেতে রাস্তার দুপাশে সবুজ গাছ ও ছোট–বড় পাহাড়ের সমারোহ দেখে মন আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে। ভ্রমণের ক্লান্তি নিমেষেই উধাও হয়ে যাবে। আমরা বিকেলে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। ফ্রেশ হয়ে, বিশ্রাম নিয়ে আমরা আর্লি ডিনার করে নিলাম আপুর রান্না করা মজাদার সব ডিশ দিয়ে। সঙ্গে আড্ডা তো চলছিলই।

মেসা ফলসে
মেসা ফলসে

খাওয়াদাওয়া করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ব্ল্যাকটেল লেক দেখতে। ব্ল্যাকটেল লেক পার্কটি সাঁতার ও পিকনিকের জন্য দুর্দান্ত জায়গা। এখানে যাওয়ার রাস্তায় আমরা অনেক উইন্ডমিল দেখেছিলাম। গাড়ি থেকে নেমে আমরা উইন্ডমিলের সঙ্গে ছবিও তুলেছি।

আমরা জানি, উইন্ডমিল একটি কাঠামো, যা পাল বা ব্লেড নামক ভ্যানের মাধ্যমে বাতাসের শক্তিকে ঘূর্ণনশক্তিতে রূপান্তর করে। শত শত বছর আগে উইন্ডমিলগুলো সাধারণত দানা (গ্রিস্টমিলস), পাম্প ওয়াটার (উইন্ডপম্প) বা উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো।

ব্ল্যাকটেল লেক থেকে বাড়ি ফিরে আমরা সবাই ব্যাকইয়ার্ডে ফায়ার পিটে আগুন জ্বেলে চারপাশে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম আর অসাধারণ চাঁদের আলো উপভোগ করছিলাম। এভাবেই শেষ হলো প্রথম দিন।

ঈদের দিন সকালে উঠে আপুর রান্না করা পায়েস আর পাস্তা খেয়ে ঈদের নামাজ পড়তে চলে গেলাম। এখানে প্রায় ৩০ জন মুসলিমের বাস। ঈদের নামাজ শেষ করে ওখানেই আমরা সকালের নাশতা করলাম একসঙ্গে। এখানের এই জিনিসটা খুব ভালো লাগল।

মজাদার সব খাবার
মজাদার সব খাবার

ঈদ নামাজ ও নাশতা শেষ করে বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ইয়েলোস্টোন বেয়ার ওয়ার্ল্ড দেখতে। ইয়েলোস্টোন বেয়ার ওয়ার্ল্ড একটি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ড্রাইভ-থ্রু ওয়াইল্ড লাইফ পার্ক। এটি ইয়েলোস্টোন জাতীয় উদ্যানের কাছে আইডাহোর রেক্সবার্গে অবস্থিত। এটি ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পার্কটি গ্রেটার ইয়েলোস্টোন ইকোসিস্টেমের আদিবাসী ৪০০টিরও বেশি প্রজাতির বন্য প্রাণী ধারণ করে।

পার্কের অন্য আকর্ষণগুলোর মধ্যে একটি ছোট বিনোদন পার্ক ও একটি পেটিং চিড়িয়াখানা অন্তর্ভুক্ত। ইয়েলোস্টোন বেয়ার ওয়ার্ল্ড হলো আমেরিকার একমাত্র বন্য জীবন পার্ক, যেখানে অতিথিরা ভালুকশাবকগুলোকে ফিডিং করাতে পারে। প্রতিদিন তিনবার পার্কটি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ভালুকশাবককে বোতলজাত মিল্ক খাওয়ানোর ও তাদের পোষ্যের সুযোগ দেয়।

রকি মাউন্টেন এল্ক, আমেরিকান বাইসন, ব্ল্যাক বিয়ারস ও গ্রিজলি বিয়ার্স সম্পর্কে আকর্ষণীয় তথ্য, খাওয়ানো ও ব্যাখ্যা করার জন্য একজন প্রাণিরক্ষক বড় বড় ট্রাকে বাচ্চাদের নিয়ে যান। বন্য জীবের ছবি পেতে অনেক অতিথি এই আকর্ষণ বেছে নেন।

ক্রেটারস অব মুন ন্যাশনাল মনুমেন্ট অ্যান্ড প্রিজার্ভ
ক্রেটারস অব মুন ন্যাশনাল মনুমেন্ট অ্যান্ড প্রিজার্ভ

ইয়েলোস্টোন বিয়ার ওয়ার্ল্ডে একটি ছোট বিনোদন পার্কও রয়েছে। রাইডগুলো তিন বছর বা তার বেশি বয়সের বাচ্চাদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। তবে এটি প্রাপ্তবয়স্করাও উপভোগ করতে পারেন। পেটিং চিড়িয়াখানাটির মতো রাইডগুলোও অন্তর্ভুক্ত থাকে। তিন বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের সঙ্গে অবশ্যই একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোক থাকতে হবে। এটা একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা।

এরপর আমরা গেলাম ফ্রিম্যান পার্কে। মজার মজার খাবার খেয়ে মুসলিমদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বিকেল হয়ে গেল। নদী দেখার জন্য এটা অন্যতম সেরা অঞ্চল। আমরা সেখানে অনেক লোককে মাছ ধরতে ও পিকনিক করতে দেখেছি। এই অঞ্চলের যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তাদের সম্মান জানিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের একটি স্মৃতিসৌধও রয়েছে।

ওখান থেকে গেলাম আপার মেসা ফলসে। এটি ক্যারিবো-তারগি জাতীয় বনভূমির হেনরিস ফর্কটির ওপরে একটি জলপ্রপাত। লোয়ার মেসা জলপ্রপাত থেকে উজানে। এটি অ্যাশটন, আইডাহোর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে। আপার মেসা জলপ্রপাতগুলো ৩৫ মিটার উঁচু ও ৬১ মিটার প্রস্থ।

লেখিকা ও তাঁর ভ্রমণসঙ্গীরা
লেখিকা ও তাঁর ভ্রমণসঙ্গীরা

মেসা ফলস টাফ, এটি একটি শিলা, যার উপরে আপার মেসা ফলস ক্যাসকেডস গঠিত হয়েছিল, ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন বছর আগে। হেনরিস ফর্ক ক্যালডেরা থেকে রিওলাইটিক আগ্নেয়গিরির একটি চক্র পুরো অঞ্চলে শিলা ও ছাইয়ের একটি ঘন স্তর জমা করেছিল। এই স্তর সময়ের সঙ্গে সংকুচিত ও শক্ত হয়ে গেছে। লাখ লাখ বছর আগে এই নদী একটি বিস্তৃত গিরিখাত নষ্ট করেছিল, যা পরবর্তী সময়ে বেসাল্ট লাভাপ্রবাহে আংশিকভাবে ভরাট হয়েছিল। স্নেক নদীর হেনরিস ফর্ক তখন বেসাল্ট দিয়ে চ্যানেলটি খোদাই করে, যা আজকের অভ্যন্তরীণ গিরিখাতটি দেখা যায়। এখানে স্নোফলের সময় প্রায় আট ফুট পর্যন্ত বরফ জমা হয়।

এখানে কিছু চমৎকার সময় কাটিয়ে আমরা ঘরে ফিরলাম। রাতে আবারও আপুর রান্না করা অসাধারণ সব খাবার খেয়ে সবাই মিলে আড্ডা দিয়ে সেদিনের মতো ঘুমিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে উঠে, সকালের নাশতা করে আপুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বইসির উদ্দেশে রওনা দিলাম।

পথিমধ্যে আমরা Craters of the Moon National Monument & Preserve দেখলাম। ক্রেটারস অব মুনের ল্যান্ডস্কেপ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক মুঠো লাভাপ্রবাহ তৈরি করেছিল। এখানকার লাভা আগ্নেয়গিরি থেকে বেরিয়ে আসেনি, বরং পৃথিবীতে বিচ্ছিন্নতা থেকে বেরিয়ে আসে এবং মাঝেমধ্যে ভেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে। কখনো কখনো কোনো প্রবাহ আংশিকভাবে আগের লাভাবিছানাটিকে ঢেকে রাখত, অন্য সময় এটি নতুন তৈরি করে। ফলাফল ১৮ বর্গমাইল (সমস্ত জাতীয় স্মৃতিসৌধে নয়) সিন্ডার শঙ্কু, লাভা টিউব, গাছের ছাঁচ, লাভা নদী, স্পাটার শঙ্কু এবং লাভাবিছানা যত দূর আপনি দেখতে পাচ্ছেন।

ঈদ সেলফি
ঈদ সেলফি

দর্শনার্থী কেন্দ্রের কাছাকাছি থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ৮৮ কিলোমিটার প্রসারিত গভীর ফাটল রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ক্রেটারস অফ মুন লাভা ক্ষেত্র ১ হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার ঢেকে উঠেছে। ৩০ কোটি বছর ধরে অঞ্চলটি ব্যাপক প্রসারিত হয়েছে। এই চলমান বাহিনীর একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ ১৯৮৩ সালে মাউন্ট বোরাহ ভূমিকম্প। সেই ইভেন্টের সময় আইডাহোর সর্বোচ্চ পয়েন্ট, বোরাহ মাউন্ট, যখন হারিয়ে যাওয়া নদীর সীমাটির ভিত্তিজুড়ে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, তখন কিছুটা উঁচুতে পৌঁছেছিল। মাউন্ট বোরাহ প্রায় এক ফুট ওপরে উঠেছিল এবং আশপাশের লস্ট রিভার ভ্যালি প্রায় চার ফুট দেবে গেছে।

পূর্ব সাপ নদী সমভূমিতে পর্বতমালার উৎপাদন না করে এই উত্তেজনাপূর্ণ শক্তিগুলো আগ্নেয়গিরির ক্রিয়াকলাপ শুরু করেছে। ভূত্বকের প্রসারিত নিচে গরম শিলাগুলোর ওপর চাপ প্রকাশ করে, যার ফলে এটি দ্রবীভূত হয়। ম্যাগমা তারপরে গ্রেট রিফ্টের মতো দুর্বলতার প্লেটগুলোসহ পৃষ্ঠের দিকে ভ্রমণ করতে পারে, যতক্ষণ না এই শক্তিগুলো কাজ চালিয়ে যায়। অবশেষে আরও বিস্ফোরণ ঘটবে। চাঁদের লাভা মাঠের ক্রাটারগুলোয় বিস্ফোরণের সময়গুলোর মধ্যে সময় গড়ে দুই হাজার বছর। শেষ বিস্ফোরণের পর দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় হয়ে গেছে।

ব্ল্যাকটেল লেকে
ব্ল্যাকটেল লেকে

বিকেলের মধ্যেই আমরা বইসিতে পৌঁছালাম। এরই সঙ্গে শেষ হলো আমাদের ঈদ। আইডাহো ফলসের বাঙালিদের কাছ থেকে যে আতিথেয়তা পেয়েছি, তা কখনোই ভোলার নয়। বিশেষ করে তানিম ভাইয়া আর রাকিবা আপুর কাছ থেকে।

শেষ করব একটি উক্তি দিয়ে, ‘No one realizes how beautiful it is to travel until he comes home and rests his head on his own, familiar pillow.’ —Lin Yutang