উত্তর আমেরিকায় যাযাবরের প্রথম মিলনমেলা

উত্তর আমেরিকায় যাযাবরের প্রথম মিলনমেলা
উত্তর আমেরিকায় যাযাবরের প্রথম মিলনমেলা

বিমানবন্দরের সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স পার হতে বেশ দেরি হওয়ায় একটু ভয়ই পেয়ে গেলাম। ফ্লাইটটা না আবার মিস হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে বছরের গ্রীষ্মকালের ছুটির সময় প্রায়ই বিমানবন্দরে এমন ভিড় থাকে। স্কুল ছুটি থাকায় মা–বাবারা বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে যান।

আমাদের ফ্লাইটটা মিস হয়ে গেলে ভীষণ বিপদ। কারণ, সারা দিনে আমার শহর থেকে এটাই একমাত্র ননস্টপ ফ্লাইট। আর এটাতে না উঠতে পারলে আমার এত দিনের এত প্রতীক্ষা আর আয়োজন সব জলাঞ্জলি।

আমার যে ঘণ্টা বেজে গেছে। আমাকে আজ যেতেই হবে। এ যে আমার যাযাবরের ঘণ্টা! তাই কোনো রকমে তড়িঘড়ি করে প্লেনে উঠে বসতে পারার পর স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। যাত্রা শুরু হলো আমেরিকার অরেগনের একটি শহর পোর্টল্যান্ডের উদ্দেশে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রতি ব্যাচের একটা নাম থাকে। সেই পরম্পরাতেই আমরা যারা ১৯৯৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ঢুকি তাদের নাম ‘যাযাবর’।

গত বছর ডিসেম্বরে বাংলাদেশে এই ব্যাচ ক্লাস শুরু হওয়ার ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে হয়ে গেল এক বিশাল বর্ণাঢ্য রিইউনিয়ন। আর সেই রিইউনিয়নে অনুপ্রাণিত হয়ে উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত প্রবাসী যাযাবরেরা ওরেগন রাজ্যের সি সাইড শহরে আয়োজন করে এক আনন্দঘন উৎসব।

তিন দিনব্যাপী এই উৎসব চলে জুলাইয়ের ২৬ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত। সেই মিলনমেলায় অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য থেকে, আমার মতোই পরিবার-সন্তানসহ ছুটে আসেন যাযাবর অ্যালামনাইরা। আমি জানি, সবার জন্যই সেই ঘণ্টা বেজেছে-বন্ধুত্বের ডাক দিয়ে। ২০ বছরের বন্ধুত্বকে আবার নতুনভাবে আবিষ্কারের প্রেরণায়।

পোর্টল্যান্ড বিমানবন্দরে গিয়ে যখন পৌঁছাই সেটা জুলাইয়ের ২৬ তারিখ। বেলা ২টা। একদিন যে মুখগুলো পলাশী বাজার, ক্যাম্পাস, লাইব্রেরি, ক্যাফে বা হলে প্রতিদিন দেখা, আটপৌরে কিছু মুখ ছিল, আজ আবার দীর্ঘ ১৫ বছর বিরতির পর দেখা হবে। এই তীব্র উত্তেজনা কাজ করছিল সারাটা পথ।

উত্তর আমেরিকায় যাযাবরের প্রথম মিলনমেলা
উত্তর আমেরিকায় যাযাবরের প্রথম মিলনমেলা

বিমানবন্দর থেকে রিইউনিয়ন গন্তব্যস্থল প্রায় ২ ঘণ্টার পথ। কিন্তু রাস্তায় নেমে দেখি প্রচণ্ড ভিড়। গাড়ি কিছুটা কচ্ছপগতিতে চলছে। প্রমাদ গুনলাম এই ভেবে, বিকেল ৫টায় অনুষ্ঠানের শুরুটা মিস হয়ে যাবে।

এদিকে আমার আরেক দল বন্ধুরাও যারা সিয়াটল থেকে রওনা দিয়েছে তারাও মেসেজ পাঠাচ্ছে, জ্যামে আটকে আছে। সিয়াটল পোর্টল্যান্ডের সবচেয়ে কাছের শহর। কিন্তু শুক্রবার বলে সব রাস্তাতেই তীব্র যানজট। সবাই ছুটছে উইকেন্ড কাটাতে।

বন্ধুদের টেক্সটে আশ্বস্ত হলাম এই ভেবে যে, অন্তত দল বেঁধেই সবাই দেরি করছি। আশা করি কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে। অনেক অ্যালামনাই যাযাবর পৌঁছে গেছে এক দিন আগেই।

রিইউনিয়ন ভেন্যু সিসাইড শহরের রিভার ইন হোটেলে যখন পৌঁছালাম তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে। হোটেল লবিতে চলছে রেজিস্ট্রেশন ও রিইউনিয়ন টি–শার্ট বিতরণ।

পুরোনো বন্ধু–বান্ধবীদের এত বছর পর দেখে ছাত্রজীবনের মতোই স্থান–কাল–পাত্র ভুলে আবেগে চিৎকার করে উঠলাম। এ যেন ২০ বছর আগের আমাদের সেই বুয়েট ক্যাম্পাস, ক্যাফের আড্ডা অথবা পলাশীর ফটোকপি।

হোটেলের বিদেশি রিসেপশনিস্ট নারী আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। আমার বাচ্চারাও অবাক হয়ে তাদের বাবাকে প্রশ্ন করল আমি এমন করছি কেন। কিন্তু এত বছর পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ার অনুভূতিটা কত গভীর তা হয়তো ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তাই তো হই হই রই রই করে আমরা হোটেল মাতিয়ে ফেললাম।

শুক্রবারের আয়োজন ছিল মূলত পরিচিতি ও আড্ডা। হোটেলের পেছনের মনোরম পেটিওতে বসে জম্পেশ গল্প—সঙ্গে গরম শিঙাড়া একদম বাংলাদেশের মতো আর কফি।

আড্ডা দিতে দিতে পরিচিত হচ্ছিলাম বন্ধু–বান্ধবীদের পরিবারের সঙ্গে। ১৫ বছর তো অনেক সময়। আমরা সবাই বদলে গেছি কত। কিন্তু স্মৃতিগুলো এখনো সযতনে রেখে দিয়েছি মনের মণিকোঠায়।

শুক্রবারের আয়োজনে আরও ছিল কেক কাটা, রাতের খাবার, পরিচিতি পর্ব ওম শো। সবাই মিলে হইহই করে ফিরে গেলাম আমাদের ছাত্রজীবনে। রাতে সমুদ্রের পাড়ে হলো বন ফায়ার। সমুদ্রের এলোমেলো হিম হিম বাতাসে জমে উঠল গানের আড্ডা আর গিটার।

পরদিন শনিবার শুরু হলো নানা রকম মজার আয়োজন নিয়ে। সকালের নাশতা খেয়ে সারি রাইডেসারা শহর চক্কর দিলাম। সারি হলো রিকশার মতোই একটা বাহন যা প্যাডেল মেরে চালানো যায় সবাই মিলে। প্রতিটি পরিবার একটি রাইড নিয়ে সি সাইড ডাউন টাউনে একসঙ্গে হলাম।

ফটোশুট হলো অফিশিয়াল রিইউনিয়ন টি–শার্টে। এরপর সাগরের পাড়ে বসে সি ফুড দিয়ে দুপুরের খাবার খেতে চলে গেলাম কেনন বিচের কাছে। সমুদ্রের বালুতে বাচ্চাদের আনন্দ আর দেখে কে!

শনিবার সন্ধ্যায় এলক লজে ছিল এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান পুরোটাই যাযাবর ও তাদের পরিবারের সদস্যদের পরিবেশনা। বাইরের কোনো শিল্পী আসেনি বা প্রয়োজনও পড়েনি। এই সাংস্কৃতিক সন্ধ্যাটি শুরু হলো যাযাবরদের উপস্থাপনায় রিইউনিয়ন থিম সং দিয়ে।

বাংলাদেশের বন্ধুদের লেখা এই মনমাতানো গানের সুরে সবাই গেয়ে উঠল—‘বুয়েট ক্যাম্পাসে জয় বন্ধুতা’। উত্তরসূরি শিশুদের চমৎকার নাচগানে মঞ্চ মেতে উঠল। বিশেষ করে বিদেশে বড় হয়ে ওঠা এসব শিশুর বাংলা নাচগান ছিল তাদের মা–বাবার অক্লান্ত শ্রমের ফসল। শিশুদের অংশের পর ছিল যাযাবর ও তাদের স্পাউসদের একক ও যুগল পরিবেশনা। কী ছিল না তাতে? নাচ, গান, উদাস করা বাঁশির সুর। আরও ছিল বাংলা সিনেমার বিভিন্ন যুগের গান নিয়ে দম্পতিদের দারুণ এক ফ্যাশন শো।

এই সাংস্কৃতিক আয়োজন শেষ হলো যাযাবরদের লেখা একটি দমফাটানো হাসির যাত্রা দিয়ে। ২০ বছর আগে বর্ষপূর্তিতে আমরা একটি হাসির যাত্রা করি যেটা সে সময় ক্যাম্পাসে ভীষণ জনপ্রিয় হয়। সেই যাত্রা ছিল মূলত বুয়েট রাজ্যের গল্প-তার রাজা, রানি, মন্ত্রী, রাজকন্যা আর রাজপুত্রের গল্প, আসলে আমাদের ছাত্রজীবনেরই গল্প। তারই সিক্যুয়াল হিসেবে আবার মঞ্চে আসে যাযাবরের রাজা, মন্ত্রী আর রানি—২০ বছর পর। এবার তাদের সোশ্যাল মিডিয়া আর ডিজিটাল জীবনের গল্প। হাসির হররা ছুটিয়ে আনন্দ আয়োজনের সমাপ্তি হয় এই যাত্রার মধ্য দিয়ে।

রোববার সকালে বেজে উঠল বিদায়ের সুর। তিন দিনের মিলনমেলার শেষ দিন। সকালের নাশতায় আড্ডা যেন আর শেষ হতে চায় না। আনন্দের সময়টুকু খুব কম মনে হচ্ছিল। দুপুর নাগাদ ভাঙল চাঁদের হাট। কেউ কেউ থেকে গেল অরেগনের মনোরম দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার জন্য। হোটেলের লবিতে সব বন্ধু একে অন্যকে বিদায় দিচ্ছিল।

আবার আমরা ফিরে যাব আমাদের ব্যস্ত জীবনে। আমাদের জীবন এখন আর ২০ বছর আগের মতো বন্ধনহীন নেই। আমরা সবাই বাবা অথবা মা। টেক কোম্পানিগুলোতে ব্যস্ত প্রকৌশলী। আমাদের সংসার ও পেশাগত জীবনে আমাদের অনেক দায়িত্ব, অনেক ব্যস্ততা। তবু আমরা ব্যস্ততার ফাঁকে অনেক কষ্টে সময় চুরি করে ছুটে এসেছি বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করব বলে। আমাদের কষ্টটুকু শতভাগ সার্থক হলো এই আনন্দঘন পারিবারিক আয়োজনে। আর তার কৃতিত্বটুকু পোর্টল্যান্ডের স্থানীয় যাযাবর অ্যালামনাই ও তাদের পরিবারকে দিতেই হয়।

জানি না, আবার কবে দেখা হবে। শুধু জানি, আমাদের বয়স যতই বাড়ুক না কেন বন্ধুদের আড্ডায় আমরা এখনো ২০ বছরেই আটকে আছি। তাই আবার এমন উৎসবে মেতে উঠতে চাই যাপিত জীবনের সব প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তি ভুলে। প্রার্থনা করি যাযাবর পরিবারের সবার সুস্বাস্থ্য। আবার যেন দেখা হলে বন্ধু গাইতে পারি গান....

পেছনে ফেলে শত ব্যস্ততা
শুরু হোক তবে ভাসুক উৎসবে
বুয়েট ক্যাম্পাসে জয় বন্ধুতা।
কিছুদিন আগেও বুয়েট ছিল ঘর,
যাযাবর যাযাবর যাযাবর নাইনটি সেভেন।

দেশে ও বিদেশে ভালো থাকো বন্ধুরা। ...ভালো থাকুক যাযাবর।