এ মুক্তি অনন্তের

ছবি: ফয়সাল আহমেদ ভূঁইয়া
ছবি: ফয়সাল আহমেদ ভূঁইয়া

কাঁচা হলুদ মাখামাখির পর্বটা আগেই শুরু করে দিয়েছি। বৌদিমণিও যোগ দিয়েছেন। বৌদিরও নতুন করে বউ সাজার শখ। পুরোনো গয়নাগাঁটির নতুন করে ঝালাই। সীতাহার তো সহজে আর পরা হয় না। টায়রা-টিকলিও। ননদিনির বিয়েতে সবটুকু দিয়ে সাজগোজ করবেন আমার ভীষণ আদরের বৌদিমণি।

অনিন্দ্যকে চিঠি লিখেছি—‘আমি কিন্তু আমার দাদির দেওয়া পৌরাণিক গয়নাই পরব বিয়েতে’। টিনের বাক্সবন্দী মালা শাড়ি, তিব্বত স্নো, কাঠের কাঁকই, গন্ধরাজ তেল। বউ বাসন্তীতে ভরে যাবে পুরো বাড়ি। স্বপ্ন পূরণের লগ্ন যখন একবারই আসে, সবটুকু সত্তা দিয়ে বউ বউ ঘ্রাণটুকু না হয় এ যাত্রায় অনুভব করি। লাল বউ! কী...মিঠাই ঘ্রাণ। বড়ই সোন্দর, আহা…।

সুহিলপুর চৌধুরী বাড়ি ততক্ষণে নাইওরি, সওয়ারিতে মুখর। হুনহুনা হুনহুনা পালকিতে চড়ে উঠোনে নামছেন দাদিজানেরা। ধানদূর্বা দিয়ে সাদর সম্ভাষণ। আর বাতাসা দিয়ে মিঠাই মুখ। মাতৃভান্ডারের রসগোল্লা, চমচম আর ছানামুখিতে ঘর সয়লাব। মাটির পাতিলে এসেছে ঐতিহ্যবাহী জামাই পিঠা, পাক্কন, কাটাকুটি, হান্দেশ। আর কত রকম রং করা গোলাপ, অপরাজিতা, শিউলি চামেলির মৌ মৌ ঘ্রাণ। বিয়ে বলে কথা।

উঠোনের কোণে চন্দ্রাবতী গাইছেন—

‘লীলাবালি লীলাবালি বর যুবতী সই গো
বর যুবতী সই গো
কী দিয়া সাজাইমু তোরে...।’

ছবি: ফয়সাল আহমেদ ভূঁইয়া
ছবি: ফয়সাল আহমেদ ভূঁইয়া

হুন্দামেন্দির পর্ব শুরু হতেই টোলপড়া লাল গালে জোছনার মাখামাখি। অন্য আমেজ। ভালোবাসাময়। আর আমি একটু একটু করে অমন আরাধ্য ভালোবাসায় মগ্ন হতে থাকি। বারবার ভাবছি ‘বড় অবেলায় আরাধ্য মানুষের দেখা মেলে!’ অনিন্দ্য আমার পূর্ব জনমের খোয়াব। কতশতবার হিজলঘাটের ওই বটতলায় আমরা মনোস্নানে গিয়েছি, জবা ফুলের রং ঠোঁটে মেখেছি। পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া টুপটাপ টুপটাপ জলরাশিতে মন ভিজিয়েছি। বুকে মাথা রেখেছি। অন্তর্জমিন ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাজরে আসওয়াদে চুমু খেয়েছি বারবার। মনে মনে বলেছি, মরলে আর বেহেশতের দরকার নাই! আমরা তো জেনেই গেছি, মন্ত্র পাঠ নিছক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বিয়া তো হেই দিনই হইয়া গেছে, যেদিন ভালোবাইসা তরে মন দিছি, আমার আর কোন্তা নাই, কিচ্ছু নাই...আত্মা তোর কাছে দিয়া খাছা লইয়া আমি বনবাঁদাড়ে ঘুইরা বেড়াই।

মেঘ রাত শেষে অঝোর ধারায় আজও নামছে বৃষ্টি। ভিজে যাচ্ছে কিছু খয়েরি ম্যাপল, সোনাই নদী আর কাশবন। আমি ভেবেই আকুল। মধ্যরাতে শ্রীকৃষ্ণের লীলাকীর্তনে মগ্ন থাকা নরেশ মাঝি কী অবলীলায় আসন্ন মৃত্যুর অপেক্ষায় কালিন্দীতে দাঁড়িয়ে থাকা রাইকে জীবনবাজি রেখে মঙ্গলাঘাটে পৌঁছে দিল, বজরায় বইঠা বেয়ে নিশি রাইতে পদ্মাবতীকে পৌঁছে দিল মন মানুষের কাছে। তার আর ঘর হলো না! অমন কাহিনিকে কেউ কেউ বলে নিয়তি।

কুদ্দুস বয়াতি সুর তোলেন—‘ভবের লীলা বোঝা দায়!’ আর আমি বলি, তোমার বুক পাঁজরে যে পরম নির্ভরতায় ঘুমিয়ে পড়েছে, পুজো করো তার। তালপাতার ছাউনি, শাপলার ছালুন, কই মাছের সওরা এসবের মাঝেও ঘর নেই। ঘর যে বুকে...শুধু তার সঙ্গে একবার শুধু একবার পাহাড়তলীর ওই বকুলঘাটে আত্মার স্নানে নিমগ্নচিত্তে মিশে যেতে হয়। আমি ছাড়া অমন অনন্ত সরোবরে কেউ পৌঁছাতে পারে না…. কখনোই না।

তিতাসের কোলঘেঁষে সামনে এগোতেই বাউলবাড়ি। বাউড়ি বাতাসে সোনারোদের খেলা। জলচৌকিতে ধ্যানে বসেছেন উত্তরপাড়ার করিম বয়াতি। উঠোনজুড়ে চম্পা বৈষ্ণবীর মানব বন্দনা—‘মানুষ ভজলেই সোনার মানুষ হবি, মন মানুষ পাইতে হইলে, তাঁর সন্ধান কর, তাঁর!’ রুহের সঙ্গে আত্ম আলাপন। সত্য দর্শন। এ মুক্তি অনন্তের।

বুকে ধিপধিপ বাজে—

‘মায়া নদী ক্যামনে যাবি বাইয়া
রঙিলা দেশের নাইয়া
মায়া নদী ক্যামনে যাবি বাইয়া।’