উপেন্দ্রকিশোর ও নানি

উপেন্দ্রকিশোর রায়ের বাচ্চাদের বই ‘টুনটুনি আর বাঘের গল্প’
উপেন্দ্রকিশোর রায়ের বাচ্চাদের বই ‘টুনটুনি আর বাঘের গল্প’

ফাইজা আনসারী মেলবোর্ন এসেছেন মেয়ের বাড়ি বেড়াতে। দিনের বেশি সময় একা কাটাতে হয় তাঁকে। তাঁর মনে হয় এখানে বসবাসের ঘরবাড়িগুলো দিনের বেলা কেমন নিষ্প্রাণ। বাংলাদেশে অন্তত ফেরিওয়ালার ডাক শোনা যায় দিনে কতবার। আজকাল অবশ্য অ্যাপার্টমেন্ট গড়ে ওঠায় ফকিরেরাও দরজায় হাঁক দেওয়ার সুযোগ পায় না। চারপাশে মানুষের উপস্থিতি বিরল হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

ভাবছেন উন্নতি কি মানুষে মানুষে দূরত্ব তৈরি করছে?

টিভিতে তার আসক্তি নেই তেমন। তার একলা সময় মুখর হয়ে ওঠে বইয়ের সাহচর্যে।

খুঁজতে গিয়ে এ বাড়িতে উপেন্দ্রকিশোরের লেখা বাচ্চাদের বই দেখে একটু যেন অবাক হলেন। প্রশ্ন জাগল মনে, কে পড়ে এসব বই? বিজ্ঞান শিক্ষক ফাইজা ইংরেজিতেও চৌকস। ছোটবেলায় বাংলা বইটই তেমন পড়েননি। আজ এই নির্জন বাড়িতে, নিস্তব্ধ দুপুরে শিশুতোষ বইটিতেই মগ্ন হলেন।

উপেন্দ্রকিশোর রায়
উপেন্দ্রকিশোর রায়

বই পড়া যত এগোচ্ছে, ততই ফাইজা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন। একসময় পড়া শেষ হলো। বইটা হাতে নিয়ে বসে গল্পগুলো নিয়েই ভাবছিলেন। এই বইয়ের সব গল্প তিনি শুনেছেন তার নানির মুখে। সেই মুখে গাঁয়ের মমতা মাখানো ভাষায় গল্প বলা হতো।

ভাবনার মাঝেই একটি প্রশ্ন ঝিলিক দিল মাথায়। তার নানি কি উপেন্দ্রকিশোর পড়েছিলেন? নাকি উপেন্দ্রকিশোর বহু দূরের গ্রাম ঘুরে ঘুরে গল্পগুলো শুনেছেন, তারপর কুড়িয়ে বাড়িয়ে সুন্দর শহুরে ভাষায় লিখে বই প্রকাশ করেছেন?

ফাইজা মেধাবী। প্রশ্ন তার মনে জাগবেই। আরও কিছু কথা মেয়ের কাছে জানার আছে তাঁর।

তার মেয়ে ফারিয়া বাড়ি ফিরলে অবসরে গল্পকথার মাঝে ফাইজার প্রশ্ন, ‘তোমার বাচ্চাদের বাংলা একটু আধটু শেখাও ভালো কথা, একেবারে এতসব গল্প, ছড়া, কবিতাও কেন পড়তে হবে?’

: তোমরা বইটই পড়ে বড় হওনি মা?

: হ্যাঁ পড়েছি কিছু, তাও ইংরেজিতে। তোমার বাচ্চারা আমার চেয়েও বেশি বই ইংরেজিতেই পড়বে।

: তুমিতো ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছ। তোমাদের জন্য ইংরেজি জানা ছিল জরুরি। তা না হলে বাইরের বিশ্বকে জানবে, তার সঙ্গে মিশবে কীভাবে, তাই না?

: তাতো ঠিক; এতে দোষের কিছু নাই। আছে কি? তোমাদের বাচ্চারা ইংরেজি রপ্ত করছে সহজে। আমাদের তো কষ্ট করতে হয়েছে।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

: দোষ বলছি না মা, তোমরা ইংরেজি শিখেছ বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত হতে আর আমার বাচ্চাদেরও বাংলা শেখা, বাংলায় বই পড়া দরকার তার নিজস্ব উৎসের সঙ্গে মানে কোথা থেকে এসেছে, কোনটা তার দেশ, কিই-বা তাদের আচার আচরণ, ভাষা—এসব কিছু জানতে, তার সঙ্গে পরিচিত হতে।

: বুঝলাম তবে ওদেরও বাংলাটা কষ্ট করেই শিখতে হবে, চারপাশে সবাই বাংলা বলে নাতো।

: কষ্ট একটু করতেই হবে। বাংলায় গল্পটল্প, ছড়া-কবিতা শোনাতে হবে; তাইতো এসব বইপত্র জোগাড় করেছি।

ফাইজা বললেন, আমি অবাক যে আমার নানি উপেন্দ্রকিশোরের সব গল্প জানতেন। ছোটবেলায় নানির গা ঘেঁষে বসে এসব মজার কাহিনি কতবার যে শুনেছি তার হিসাব নাই।

 : আচ্ছা মা তোমার নানি কি স্কুলে লেখাপড়া করেছেন?

 : নাহ, তবে পড়তে পারতেন।

 : তাইতো না হলে উপেন্দ্রকিশোর পড়লেন কীভাবে?

 : আশ্চর্য! আজ দুপুরে একলা একলা বসে বইটা পড়তে পড়তে ঠিক এই প্রশ্নটা আমার মাথায়ও এসেছে; তবে নানির ভাষা ছিল গাঁয়ের সুবাস মাখা।

 : যেমন?

 : উপেন্দ্রকিশোর কুঁজো-‘বুড়ির কথা’ গল্পে ছড়া লিখেছেন শুদ্ধ ভাষায়—‘লাউ গড়গড়, লাউ গড়গড়,/ খাই চিঁড়ে আর তেঁতুল/ বিচি ফেলি টুলটুল/ বুড়ি গেল ঢের দূর!’ আমার নানির গল্পের নাম ‘কুঁজাবুড়ির কিচ্ছা’ আর...।

 : কিচ্ছা?

 : হ্যাঁ, কিচ্ছা মানে গল্প আর নানি ছড়া কাটতেন—‘লাউয়ের ভিত্রে থাখে বুড়ি/ দুদবাত খায়/ আডু থাফাইয়া বুড়ি/ গড় গড়াইয়া যায়’।

 : ওহ্ মাই গড!

 : ওহ্ মাই গডের কী হলো?

 : ভাবছি তোমার নানি যদি লেখাপড়া জানতেন তবে উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারতেন, তাই না? আঞ্চলিক কথায় বই লিখতে পারতেন।

 : হয়তো।

 *কৃতিত্ব সেই সব গল্প কথক নানি-দাদিদের, যাদের বলা কাহিনি অ্যালেক্স হ্যালির ‘রুট্স’ উপন্যাসের উৎস আর এই নানির, যার আঞ্চলিক কথনে বলা গল্প উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে কোনো এক যোগসূত্রের ইঙ্গিত দেয়।