নেদারল্যান্ডসে বঙ্গবন্ধু স্মরণে চিত্র প্রদর্শনী

প্রদর্শনী যৌথভাবে উদ্বোধন করেন কার্লোস জে আরগুয়েলো গোমেজ, শেখ মুহম্মদ বেলাল ও রবীন বলদেব সিং
প্রদর্শনী যৌথভাবে উদ্বোধন করেন কার্লোস জে আরগুয়েলো গোমেজ, শেখ মুহম্মদ বেলাল ও রবীন বলদেব সিং

নেদারল্যান্ডসে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কূটনীতিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাঁদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ব্যক্ত করেছেন। দেশটির বাংলাদেশ দূতাবাস বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথমবারের মতো আয়োজিত চিত্র প্রদর্শনী ‘বঙ্গবন্ধু: ইন রিমেমব্রেন্স’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে তাঁরা এ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করেন।

তিন দিনব্যাপী এ প্রদর্শনী দ্য হেগে অনুষ্ঠিত হয়। গত বুধবার (২৮ আগস্ট) উদ্বোধন করা হয়। চলে গতকাল ৩০ আগস্ট পর্যন্ত।

প্রদর্শনী যৌথভাবে উদ্বোধন করেন ডিপ্লোম্যাটিক কোরের ডিন তথা দেশটিতে নিযুক্ত নিকারাগুয়ার রাষ্ট্রদূত কার্লোস জে আরগুয়েলো গোমেজ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ মুহম্মদ বেলাল ও দ্য হেগের সাবেক ডেপুটি মেয়র রবীন বলদেব সিং।

অনুষ্ঠানে দেশটিতে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ভেনু রাজামনি তাঁর বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে অভিহিত করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার মুহূর্তে তাঁর নিজের স্মৃতিচারণা করেন। সেই মাহেন্দ্রক্ষণকে ‘জয় বাংলা’ ক্ষণ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, তিনি তখন মাত্র ১১ বছর বয়সের এক কিশোর।

রাষ্ট্রদূত ভেনু রাজামনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনাকে ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায় হিসেবে অভিহিত করে ওই হত্যাকাণ্ড–পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুর অপর কন্যা শেখ রেহানাকে ভারত সরকার কর্তৃক আশ্রয় দানের বিষয়টিও স্মরণ করেন।

ভেনু রাজামনি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে তাঁর কাজ করার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সমগ্র ভারতে এমনকি সারা পৃথিবীতে বঙ্গবন্ধুকে কত ভক্তিভরে স্মরণ করা হয় তা–ও তিনি উপস্থিত সুধীদের সামনে তুলে ধরেন। বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় জনগণের প্রশংসা করে তিনি সবাইকে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণের আহ্বান জানান। রাষ্ট্রদূত ভেনু রাজামনি তাঁর বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শনের স্মৃতি বর্ণনাকালে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।

প্রদর্শনীতে অতিথিরা
প্রদর্শনীতে অতিথিরা

রবীন বলদেব সিং তাঁর বক্তব্যে কিউবার মহান বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে করা উক্তি ‘আমি হিমালয় পর্বত দেখিনি; কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়। এভাবেই আমার হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে’ দর্শক-শ্রোতাদের পাঠ করে শোনান।

রবীন বলদেব সিং তাঁর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে নিজেকে জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে গভীর ভালোবাসা তার একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বর্ণনা করেন।

রবীন বলদেব সিং আরও জানান, ফিদেল কাস্ত্রোর হিমালয়সম বঙ্গবন্ধু যদিও স্বল্পসময়ের জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন তৎসত্ত্বেও তিনি জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মধ্যমণি হিসেবে রয়ে গেছেন। প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিকৃতির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বিদ্রোহী কবি রচিত ‘সাম্য’ কবিতাটি পাঠ করে বঙ্গবন্ধুর সাম্যবাদ ও একতাবদ্ধতার বিষয়টি সম্মানিত উপস্থিতির সামনে তুলে ধরেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথিদের একাংশ
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথিদের একাংশ

বাংলাদেশে নিযুক্ত দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত গারবেন ডি জং তাঁর বক্তব্যে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাধারণ মানুষের যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রত্যক্ষ করেছেন তা তুলে ধরেন। এ ছাড়া, তিনি ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বঙ্গবন্ধুর চিত্রকর্মের সংগ্রহশালার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।

রাষ্ট্রদূত কার্লোস জে আরগুয়েলো গোমেজ বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম নিয়ে এ ধরনের চমৎকার একটি চিত্র প্রদর্শনী আয়োজনের জন্য বাংলাদেশ দূতাবাসকে অভিনন্দন জানান। তিনি বাংলাদেশের হিমালয় বঙ্গবন্ধুকে জানার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যর সঙ্গে একমত পোষণ করে গোমেজ জানান, জনতুষ্টিবাদ মতবাদে আচ্ছন্ন বর্তমান পৃথিবীর নানামুখী সমস্যা সমাধানে বঙ্গবন্ধুই হতে পারতেন উত্তম ব্যক্তিত্ব।

প্রদর্শনীতে অতিথিরা
প্রদর্শনীতে অতিথিরা

বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ মুহাম্মদ বেলাল বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে উপস্থিত সুধীদের বঙ্গবন্ধুর বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা ও দেশের মানুষের কল্যাণে তাঁর অপরিসীম ত্যাগের বিষয়টিও সবার সামনে তুলে ধরেন।

বিশ্বের মহান নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর তুলনা করে রাষ্ট্রদূত বেলাল বলেন, মানুষের প্রতি ভালোবাসার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অদ্বিতীয়। নিজ মানুষের প্রতি অসীম ভালোবাসাকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর জীবনের একমাত্র দুর্বলতা হিসেবে অভিহিত করেন।

শেখ মুহাম্মদ বেলাল বলেন, বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবনের পরিব্যাপ্তি এত ব্যাপক যে তা এ রকম একটি সীমিত আয়োজনের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ভালোবেসে বঙ্গবন্ধুকে যে ‘অমরত্বের শৈশব’ প্রদান করেছে তা চিরন্তন এবং নিবিড় গবেষণামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে এই মহান ব্যক্তিত্বকে আরও ভালোভাবে জানা সম্ভব হবে।

প্রদর্শনীতে অতিথিরা
প্রদর্শনীতে অতিথিরা

রাষ্ট্রদূত বেলাল প্রসঙ্গক্রমে আরও উল্লেখ করেন, দেশের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা, ত্যাগ ও দূরদৃষ্টি ছিল অতুলনীয়। বঙ্গবন্ধুর অকালপ্রয়াণ বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে শুধু বাধাগ্রস্তই করেনি বরং তা দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে একধরনের শূন্যতা সৃষ্টি করেছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ তার হৃত পথ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।

শেখ মুহাম্মদ বেলাল প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা প্রদান করেন এবং কীভাবে বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে তাও তুলে ধরেন।

বুড়িগঙ্গা আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসের কিউরেটর রফিক সুলায়মান বাংলাদেশের সমসাময়িক চিত্রকলার বিবর্তন ও বর্তমান সময়ের চিত্রশিল্পীরা কীভাবে সমসাময়িক চিত্রকলাকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তুলেছেন সে সম্পর্কে ধারণা প্রদান করেন। তিনি জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের এই অভিনব প্রয়াস গ্রহণের জন্য দূতাবাসকে ধন্যবাদ জানান।

শান্তি ও ন্যায়বিচারের শহর হিসেবে খ্যাত দ্য হেগে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শর্বরী রায় চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, আবদুস সাত্তার, জামাল আহম্মেদ প্রমুখের ৩০টি চিত্রকর্ম নিয়ে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এই আয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতা করে বাংলাদেশের বুড়িগঙ্গা আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস।

প্রদর্শনীর উদ্বোধনের আগে শিশুদের নিয়ে একটি আর্ট ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়
প্রদর্শনীর উদ্বোধনের আগে শিশুদের নিয়ে একটি আর্ট ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়

প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারত, ইরান, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া, কসোভো, নিকারাগুয়া, ভেনেজুয়েলা, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, আফগানিস্তান, জর্জিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সুদান ও ভ্যাটিকানের রাষ্ট্রদূত এবং যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ান ফেডারেশন, স্পেন, অস্ট্রিয়া ও পানামার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) ট্রাস্ট ফান্ড ফর ভিকটিমসের বোর্ড চেয়ারম্যান ফেলিপ্পি মিচেলিনিসহ অন্য বোর্ড সদস্য, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি, শিক্ষার্থী ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে দূতাবাস পরিবার ও বাংলাদেশ কমিউনিটির শিশুদের নিয়ে একটি আর্ট ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হয়। ঢাকা থেকে আগত চিত্রশিল্পী কর্তৃক পরিচালিত এই আর্ট ক্যাম্পে শিশুরা তাদের উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীল চিত্রকর্মের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করে। আর্ট ওয়ার্কশপ ও উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দুটি সঞ্চালনা করেন রাষ্ট্রদূতের সহধর্মিণী ড. দিলরুবা নাসরীন।

তিন দিনব্যাপী এই প্রদর্শনীতে বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। বিজ্ঞপ্তি