জীবন ও সমুদ্র দর্শন

কি ওয়েস্ট আইল্যান্ড। ছবি: সংগৃহীত
কি ওয়েস্ট আইল্যান্ড। ছবি: সংগৃহীত

ফ্লোরিডার ‘কি ওয়েস্ট আইল্যান্ড’ আমার ভীষণ পছন্দের একটা জায়গা। পছন্দের অন্যতম কারণ ওই দ্বীপে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বাড়ি। বলা হয়ে থাকে, ওই বাড়ির বারান্দায় বসেই তিনি লিখেছিলেন কালজয়ী উপন্যাস ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’। ওখান থেকে ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবা মাত্র ৯০ মাইল।

কি ওয়েস্ট আইল্যান্ডে আমার অনেকবার যাওয়া হয়েছে। শ্বশুরবাড়ি ফ্লোরিডা হওয়ায় এই এক বিরাট সুবিধা। মায়ামি শহর থেকে প্রায় চার ঘণ্টার পথ। যেতে যেতে মনে হবে, আহা এই পথ যেন আর শেষ না হয়। অনন্তকাল ধরে চলুক এই পথচলা। চকচকে নীল আকাশে সাদা মেঘের মিছিল দিনরাত লেগেই থাকে। গ্রীষ্মকালে গভীর রাতেও আকাশে মেঘের মিছিল চোখে পড়ে। সাধে কী আর ফ্লোরিডার নাম সানশাইন স্টেট। কী সুন্দর একটা নাম রোদেলা রাজ্য।

মায়ামি শহর থেকে গাড়ি চালিয়ে গেলে কি ওয়েস্টের পুরো পথটাই হবে আটলান্টিকের উপকূল ঘেঁষে। মাঝে মধ্যে পার হতে হবে ছোটখাটো লোকালয় বা উপশহর। দ্বীপও বলা যেতে পারে। একটা দ্বীপ থেকে আরেকটার মধ্যে সেতুবন্ধ। কখনো কখনো আচমকা বৃষ্টি এসে হানা দেবে। পরক্ষণেই আবার রৌদ্র। বাইরে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যাবে নীল সমুদ্রের স্বচ্ছতা দেখে। পথের ধারে ঝোপঝাড়ে পাখপাখালির অনবরত কিচিরমিচির।

মূল গল্পে আসি। বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। মায়ামিতে শ্বশুরালয়ে গিয়েছি মাত্র তিন কী চার দিনের জন্য। তিনটি শর্ত সাপেক্ষে। এক, দিনের আলো বা দুপুরে দাওয়াতে যাব না, দাওয়াতদার তিনি যে-ই হোন। দুই, এক রাতের জন্য হলেও কি ওয়েস্ট যাব। তিন, গাড়ি ভাড়া করব, যদিও তাদের বাড়তি গাড়ি আছে তবুও।

কি ওয়েস্ট আইল্যান্ড। ছবি: সংগৃহীত
কি ওয়েস্ট আইল্যান্ড। ছবি: সংগৃহীত

মায়ামি এয়ারপোর্টে নেমে গাড়ি ভাড়া করে একটা শর্ত বাস্তবায়ন করলাম।

এক দিন থেকে পরদিন রওনা দিলাম কি ওয়েস্টে। সবকিছুই যেন আগের মতো। আহা কী সুন্দর মলিন বাতাস, কী সুন্দর আকাশ, স্বচ্ছ জলের ওপর ছায়া ফেলতে ফেলতে একদল পাখি উড়ে যায়। তারও ওপর মেঘের ভেতর একটা সাদা অ্যারোপ্লেন বারবার ডুবে যায় আবার ফিরে ফিরে আসে। পথিমধ্যে ছোট ছোট শহরগুলোতে রাস্তার পাশে আম, লিচু, পেয়ারা নিয়ে বিক্রেতারা বসে থাকেন ক্রেতার আশায়।

একটা সময় পর আমার পথ শেষ হয়। আস্তে ধীরে ওখানে গিয়ে পৌঁছাই। এই আইল্যান্ডের মোটামুটি চারদিকেই উত্তাল সমুদ্র। অন্য পাশে কিউবা। এক দিকের সুদীর্ঘ সেতুই হচ্ছে গাড়িপথে যোগাযোগের একমাত্র মধ্যম। ছোট ছোট অসংখ্য দ্বীপের সঙ্গে একটি মাত্র সেতু দিয়ে সংযোগ। সূর্য তখন মাঝ আকাশ থেকে একটু পশ্চিমে হেলে পড়েছে। বালুকা তীরে অসংখ্য পর্যটকের পদচারণা। সঙ্গে আছে ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে নারকেলগাছের নুয়ে পড়া মাথা ঝাঁকানি। অদূরেই চঞ্চল ছেলেমেয়েদের দৌড়ঝাঁপ। কেউ বালিতে নুড়ি খুঁজছে, কেউ ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। একঝাঁক কবুতর বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে দলছাড়া হচ্ছে আবার দলে ঢুকছে।

সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করে হোটেলে গেলাম। তারপর লম্বা ঘুম। ঘুম ভাঙলে দেখি জানালার ওপাশে বিশাল চাঁদের হাতছানি। আমাকে ডাকছে। দেহে ক্লান্তি আর অবসাদের লেশমাত্র নেই। এমনি সময়ে পৃথিবীর সবকিছুই যেন ভালো লাগে, লাগতেই হয়।

মৃদু পায়ে হোটেলের বারান্দায় গেলাম। পূর্ণিমায় চারিদিকটা আলোকিত। ওই তো চাঁদের আলোয় ঢেউয়ের ঝলকানি চোখে পড়ে। পাশের কক্ষের বারান্দায় দেখি এক ভদ্রলোক বসে বসে মদ্যপান করছেন। টেবিলের ওপর একটা খোলা বই। অতটুকুন আলোতেও নামটি চোখে পড়ল The Old Man and The Sea. তাকে দেখতে দেশি মনে হচ্ছে।

: হ্যালো, কেমন আছ? এই রাতে কী বই পড়ছ? একসঙ্গে অনেক প্রশ্ন জুড়ে দিয়েই কথা শুরু করলাম।

ভদ্রলোক বাংলাদেশি-আমেরিকান। বয়স ষাটোর্ধ্ব ও সাম্প্রতিক ডিভোর্সড। এই হোটেল ভাড়া নিয়েছেন এক সপ্তাহের জন্য। নাম ড. শরাফত হোসেন। নিউইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়ান। প্রায় তিন যুগ ধরে আমেরিকায় থাকেন। জীবনের ধাপে-ধাপে তাঁর অর্জন অনেক। আবার বিসর্জন বা ব্যর্থতাও অনেক। তার জীবনের অর্জন আর ব্যর্থতার গতি অনেকটা একই রকম। কি ওয়েস্ট তারও অনেক পছন্দের একটা জায়গা। প্রায়ই আসেন। উদ্দেশ্য, দুঃখ ঘোচানো বা বিসর্জন। এবারও এসেছেন আটলান্টিক পাড়ে বসে দুঃখ বিসর্জন দিতে।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বাড়ি। সংগৃহীত
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বাড়ি। সংগৃহীত

জিজ্ঞেস করলাম, এ দফায় কিসের দুঃখ বিসর্জন?

বললেন, তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র মেয়ে দুজনেই তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে।

: আপনিও কি আপনাকে ছেড়ে চলে যেতে এসেছেন?

: না, না, তা কেন হবে? আমি আসলে আমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। এই সমুদ্রের ধারে এলে আমি বারবার আমাকে খুঁজে পাই। তারপর তাকে নিয়ে জীবনে ফিরে যাই। বাংলাদেশে ফেরিওয়ালাদের কাঁধে যেমন একটা ব্যাগ ঝোলানো থাকে, অনেকটা সেই রকম। আমাকে আমি কাঁধের ব্যাগে করে নিয়ে যেতে এসেছি।

মদ্যপ অবস্থায় মানুষ অনেক কিছু বলে ও করে। সবকিছুর মানে বোঝা যায় না। বোঝার প্রয়োজনও নেই। ভদ্রলোক বারান্দায় বসে সারা রাত সমুদ্র দেখেছেন আর মদ খেয়েছেন। সঙ্গে ছিল আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’। চাঁদের আলোতে হোটেলের বারান্দা থেকে অদূরে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সেই দোতলা বাড়িটি দেখা যাচ্ছিল। বলা হয়ে থাকে, ওই বাড়ির বারান্দায় বসেই হেমিংওয়ে কালজয়ী বইটি লিখেছিলেন।

লেখক
লেখক

হেমিংওয়ের নারকেলগাছ ঘেরা বাড়িটিতে দিনের বেলা অসংখ্য বুনো কবুতর উড়ে বেড়ায়। থাকে দর্শনার্থীদের আনাগোনা। দেয়ালের অন্যপাশে উৎসুক মানুষেরা মাথা উঁচু করে ভেতরের পরিবেশটা দেখে নেন। শরাফত হোসেন রাতভর পানি পান করেছেন। হঠাৎ একটা বনমোরগের কুউ-উউ-কুরু-কুক শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে সাগরের দিকে মিলে যায়। কী মনে করে তিনি হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের কাছে গেলেন। মাতাল অবস্থায় সমুদ্রের কাছে যাওয়া খুবই বিপজ্জনক। তবুও গেলেন। আমিও তাঁকে অনুসরণ করলাম। ইতিমধ্যে দিগন্তরেখায় লাল আলোর আভা ফুটে উঠেছে।

কিছুটা অন্ধকার কিছুটা আলোয় শরাফত হোসেন বালিতে হাঁটু গেড়ে বসলেন। অর্ধ ভেজা বালিতে আঙুল ডুবিয়ে কিছু একটা লিখলেন। বোঝা গেল না।

: কিছু বুঝলে?

: না।

: আমার শৈশব কেটেছে ঢাকায়, যখন খুব ছোট ছিলাম। খুব ছোট। সবেমাত্র ছোট ছোট কথা বুঝতে শিখেছি। এই যেমন বৃষ্টি, পানি, সমুদ্র, আকাশ, বাতাস।

বিরতি না নিয়েই শরাফত হোসেন বলে চললেন, একদিন আমি বৃষ্টির জলে সমুদ্র বানাতে চেয়েছিলাম। নির্ঘাত পারতাম। কিন্তু পারিনি, কারণ আমার চাওয়া ছিল তেতো, সন্দেহে ভরা। তাতে কী? বৃষ্টির জলকে তো থামিয়ে দিয়েছিলাম, মাটিতে বাঁধ দিয়ে, সমুদ্র না হোক শেষমেশ একটা পুকুর হয়েছিল, সেই পুকুরে পদ্মপাতা এসেছিল, অর্ধেক তার জলে, অর্ধেকটা আকাশমুখী, সেই পদ্মপাতায় একবার প্রজাপতি বসেছিল। তাকে ধরতে হাঁটু জলেও নেমেছিলাম। সে উড়ে গিয়েছিল আকাশের দিকে। অথচ আমি দেখেছি তাকে গভীর জলে হারাতে।

এক নিশ্বাসে শরাফত হোসেন ওপরের কথাগুলো বলে সমুদ্রের দিকে হেঁটে গেলেন। ঢেউয়ের ফেনায় পা ভিজিয়ে তিনি হাঁটছেন। তার পা আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে। আমি তাঁকে থামাচ্ছি না। অপেক্ষা করছি তিনি আরও কিছু বলবেন। কিন্তু কিছুই বলছেন না। শুধু গভীরতার দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। আমি কিছু একটা শোনার অপেক্ষায়। অপেক্ষা আমার একদম ভালো লাগে না।
---

জামাল সৈয়দ। ই-মেইল: <[email protected]>