জার্মানিতে বিদ্যুৎবিহীন একটি সকাল

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

এই দেশে এসব লোডশেডিং নেই বা হয়নি। অন্তত আমি দেখিনি কোনো দিন। আমার মা বলেছিলেন, রিয়াদে আট বছরে কেবল এক দিন ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়েছিল।

আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা বানানো শুরু করেছি। নাশতা বানানো মানে পাউরুটি গরম করা, ডিম ভাজি আর চা। ডিমটা যেই ছেড়েছি তেলে, একটু পরেই চুলার তাপ কমে গেল। আমি ভাবছি হয়তো কখন ভুলে চুলা বন্ধ করে দিয়েছি। চুলার নব এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যখন ডিম আর পুরো ভাজা হলো না, ওদিকে পাউরুটি আধা টোস্ট, তখন আমি নিশ্চিত চুলা নষ্ট। আমার মাথায় কোনোভাবেই আসেনি ইলেকট্রিসিটি নেই।

এই দেশের চুলা, গরম পানির কেটলি, পাউরুটির টোস্টার সবই ইলেকট্রিসিটিতে চলে।

এরপর রুমে ফিরে গিয়ে দেখি বাতি বন্ধ। আমার ঘরের বারান্দা, করিডর সব বন্ধ। যদিও দিনের বেলা বাতি দরকার নেই, আলো বাতাস চারদিকে। তখন আমি খুব ইতস্তত, কী ঘটেছে বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

পাশের রুমের ভারতীয়কে নক করে দেখি নেই। তার পাশে পাকিস্তানি একজন ছাত্রকে পেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার রুমে বাতি কী খবর? চুলা তো জ্বলে না। এটা তার জন্য খুবই দুঃখজনক। কারণ পাকিস্তানিরা খুবই আয়েশ করে রান্না করে প্রতিদিন। সকালে দুধ চা, সঙ্গে ঘি দিয়ে ভাজা পরোটা, সময় পেলে মুরগির ভুনা—এই সব এদের চাই-ই চাই।

আমি এদের কোনো দিন বাটার জেলি বা ওট মিলের শর্টকাট নাশতা খেতে দেখিনি। দুধ চা আবার অনেকক্ষণ চুলায় রেখে জাল করে নাশতা করে। ভার্সিটির ক্যানটিনে সব দেশের ছেলেমেয়েরা খায়। আমি তো নিয়মিত রান্নার ঝামেলা এড়াতে বাইরে খাই। বাংলাদেশি, ভারতীয় ও আফ্রিকান সবাই–ই আসে। কিন্তু পাকিস্তানিদের কখনো খেতে দেখা যায় না। কারণ, এ দেশি খাবারের স্বাদ নিয়ে এরা খুবই হতাশ। সঙ্গে হালাল-হারামের অনেক মামলা আছে।

যা হোক সাতসকালে চা হবে না, চুলা বন্ধ, এই দুঃখে বেচারার মুখ পাংশুটে হয়ে গেল। এদিকে সেদিন আবার ছুটির দিন। এ দেশে রোববার কেউ অসুস্থ হতেও ভয় পায়। কারণ, রোববার দোকানপাট সব তো বন্ধ থাকেই, হাসপাতালে মাছি মারারও কেউ থাকে না। এখন যদি এই বিল্ডিংয়ের ইলেকট্রিসিটি চলে যায় তো খুবই বিপদ। সোমবারের আগে আর সারানোর লোক আসবে না। ইশ্‌! দুই দিন বিদ্যুৎ থাকবে না মানে খুবই বড় ধরনের সংকট।

কেউ যদি এদিকে বেড়াতে চলে আসেন বা প্লেন থেকে নামেন আর জার্মানিতে রোববার শপিংয়ের প্ল্যান থাকে তো, তার সে আশায় গুঁড়েবালি। রোববার এই দেশে সব বন্ধ থাকে, রেস্টুরেন্ট বাদে। সুতরাং যদি চুলা না জ্বলে সারা দিন উপোস থাকা লাগবে। এই সব সাতপাঁচ ভেবে পাকিস্তানি ছেলেটা খুবই বিমর্ষ।

এদিকে আমি ভাবছি কলা–দই আর ওটস দিয়ে চালিয়ে দেব। কিন্তু যদি ল্যাপটপ না চলে! তখন আমার কিছু ডেডলাইন ছিল তাই কম্পিউটারে অনেক কাজ করা লাগবে। ভার্সিটির লাইব্রেরিতে কম্পিউটার দিয়ে হয়তো চালিয়ে নিতে হবে। কিন্তু সাততলার লিফট চলবে না। আমি তখনো নিশ্চিত না আসলে কী ঘটেছে। শুধু আমাদের তলার বিদ্যুৎ বন্ধ নাকি পুরো বিল্ডিংয়ের। নিশ্চিত হওয়া দরকার।

পাকিস্তানি ছেলেটা বলল, আমি ফিউজগুলো দেখি। তুমি অন্য ফ্লোরগুলোতে কল দিয়ে দেখো তো কী অবস্থা।

এগারো তলায় টেলিফোন করলাম সারাহর কাছে।

: সারাহ, তোমার কি বাতি জ্বলে?

: না নেই!

সারাহ খুবই বিরক্ত। বলল, জানো, আমি একদম অবাক হইনি। এই বাড়ির বাতি যেকোনো সময়ই বন্ধ হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। সে জার্মান মেয়ে। এই বাড়ির সার্ভিস নিয়ে সারাক্ষণ হতাশ।

এরপর আমি কিছুটা চিন্তিত হয়ে পাশের বিল্ডিংয়ের স্টুডেন্টস ডরমিটরিতে বাংলাদেশের একজন ছেলেকে কল দিলাম।

: অনীক, ইলেকট্রিসিটি আছে?

: না নেই, তার মানে আপনাদের টাওয়ার বিল্ডিংয়েও নেই। আমি এতক্ষণ ভেবেছি শুধু ডরমিটরিগুলোতে নেই। এখন তো মনে হচ্ছে পুরো লুডভিগসবুর্গেই নেই।

সেটা জানার জন্য আমাদের বাসা থেকে বেশ কিছু দূরের আরেকজন বাংলাদেশিকে কল দিলাম। ছেলেটা বাংলাদেশের খাবারের ভক্ত। তার খুব প্রিয় বাক্য—‘রান্না ও খাওয়ার জন্য আমি অনেক কষ্ট ও ত্যাগ করতেও রাজি আছি।’

খুব কঠিন রান্নাতেও এই বাংলাদেশি দক্ষ। বিরিয়ানি বা সাতসকালে পরোটা তার কাছে এক চুটকির ব্যাপার। বাড়িতে একা রমজান মাসে রোজা রেখে ইফতারিতে বিরিয়ানি, হালিম, মাংস, পেঁয়াজি, বেগুনি ছোলা একা হাতে রান্না করে ফেলা তার জন্য খুবই সাধারণ ঘটনা। কিছুদিন হলো তার বউ এসেছে দেশ থেকে। তার বউয়ের থেকেও রান্নায় সে বেশি দক্ষ। দুজনই তড়িৎ প্রকৌশলী। ছেলেটা খেতে ও খাওয়াতে খুবই পছন্দ করে। তাদের বাড়িতে গেলে গল্পের একটা বড় অংশ থাকে বিভিন্ন রান্না ও খাবার। আর ওদের বাড়িতে বেড়াতে গেলে এত আইটেম থাকে, আমার দু-এক কেজি ওজন বাড়ে। সুতরাং ছুটির দিন সকালবেলা এই বাড়িতে বিদ্যুৎ না থাকলে সকালটাই মাটি।

আমি কল দিয়ে বলেছি, তালহা, ইলেকট্রিসিটি আছে তোমাদের বাড়িতে?

: না আপু আমি ওপরে–নিচে সব লাইট অন করে রেখেছি। আসার সঙ্গে সঙ্গেই টের পাব। মনে হচ্ছে পুরো এরিয়াতেই নেই।

আমি আমার বাসায় জার্মান আর পাকিস্তানের দুজনকেই বললাম, পুরো এলাকাতেই বিদ্যুৎ নেই।

সেটা জেনে এবারে সেই পাকিস্তানি ছেলেটার খুশিতে চোখমুখ চিক চিক করে উঠল। সে শিস বাজাতে বাজাতে রান্নাঘরে ঢুকল। রান্নাঘরে ভারতীয়রা আগে থেকেই জেনে গেছে পুরো এরিয়াতে ইলেকট্রিসিটি নেই। তাদের ভেতর একটা পিকনিক পিকনিক অ্যাডভেঞ্চারের মতো কাজ করছে। ভাবখানা এ রকম, যাক এই প্রথম জার্মানিতে ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। এর থেকে খুশির আর কিছুই হতে পারে না। কেউ কেউ তো খুশিতে একে তাকে কল দিচ্ছে—জানিস গত পাঁচ-ছয় বছরে এই প্রথম জার্মানিতে কারেন্ট গেছে আজকে।

সবাই জেনে গেছে, পুরো এরিয়াতে বিদ্যুৎ নেই। মানে তাড়াতাড়ি চলে আসবে। কারণ, এই দেশে ইলেকট্রিসিটি ছাড়া জীবন থেমে যায়। সেটা দীর্ঘ সময় হলে পত্রপত্রিকাতে বড় বড় হেডিং হবে। আজকের এই লোডশেডিংয়ের খবর আগামীকাল নিশ্চিত পত্রিকা বড় বড় করে হেডিং করবে। কাজেই শুধু আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই হলে একটা চিন্তার বিষয় ছিল।

আমাদের দেশে বা পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে লোডশেডিং এতই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা যে, সারাক্ষণ ইলেকট্রিসিটি বা পানি থাকে এটাই কেউ কেউ মেনে নিতে পারে না, খুবই বিরক্ত থাকত।

যেমন পাকিস্তানের ছেলেটা ইচ্ছে করে সারাক্ষণ পানির কল খুলে রাখে। ব্যাপারটা কিছুটা এ রকম, তাদের দেশে পানি নেই এদের কেন আছে! এই দেশে সরাসরি কল থেকে পানি ভরে খাওয়াকে খুবই উৎসাহিত করা হয়। এই নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করা হয়। কারণ, পানি কিনে খাওয়া মানে প্লাস্টিকের বোতলের ব্যবহার। সেটা নিয়েও পাকিস্তানি ছেলেটা কেন যেন খুবই বিরক্ত। কেন ট্যাপের পানি খাওয়া যাবে! আবার দিনের বেলাতেও সে লাইট অন করে রাখে। কিছুতেই কোনো কিছু বন্ধ করা যাবে না। এ রকম একটা ব্যাপার। শুধু সে একা না আমাদের দেশের বা ভারতীয়দের দু-একজনকে ‘কিছুই বন্ধ করা যাবে না’ এ রকম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কিন্তু দেখা যায়।

তাই এই ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়াতে সেদিন তার চোখেমুখে উচ্ছ্বাস।

এদিকে জার্মান মেয়েটা তার জীবনে কোনো দিন ইলেকট্রিসিটি যেতে দেখেনি। সে ইতিমধ্যেই হাউস মাস্টারের সঙ্গে একটা ছোটখাটো স্নায়ুযুদ্ধ করে আরও আতঙ্কিত। যখন শুনেছে পুরো এরিয়াতেই ইলেকট্রিসিটি নেই। কখন আসবে কেউ কিছুই জানে না। ফ্যাকাশে মুখে রান্নাঘরে ঢুকে ভারতীয়দের এই পিকনিক পিকনিক উচ্ছ্বাসে সে হতবাক হয়ে রেগে গিয়ে বলল, ‘এ রকম একটা সংকটময় পরিস্থিতে তোমাদের কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। আমার দুশ্চিন্তায় মাথা খারাপ, তোমরা কীভাবে এত খুশি খুশি আছ। চিন্তায় আমার মাথা কাজ করছে না।’

ওর এই জেরার মুখে সবাই জোর করে একটু নিজেদের থামিয়ে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু চোখের তলায় চাপা হাসি। সে বেরিয়ে গেলে একটা উচ্চ হাসির রোল শোনা গেল রান্নাঘর থেকে!