সেকাল একাল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জরিনাকে বউ করে ঘরে তুলে নেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে কাজের মেয়ে রাশুনিকে বিদায় করে দিলেন শাশুড়ি খতিজা বানু। বিনা বেতনে নতুন কাজের মেয়ে পেলেন। টাকা খরচ করে কে আর কাজের মেয়ে পোষে!

চুরিও করে ওরা, দুবার চা বানাতে গিয়ে দুধের ছানা চুরি করে খেয়েছে রাশুনি। তিনি দেখে ফেলেছিলেন। কত সাহস। বিদায় না করে উপায় আছে। তা ছাড়া রহমানের বউকে বসিয়ে বসিয়ে সুন্দর দেখার আর খাওয়াবার জন্য এনেছেন নাকি?

যাওয়ার আগে এতগুলো বদ দোয়া দিতে দিতে রাশুনি কাজ থেকে বিদায় নিল।

‘কাজ করেছি নাম নাই। এক ফোঁটা ছানা খেয়ে দেখেছি। তাতেই চুরি নাম দিয়ে দিল। সোনা চুরি করিনি, টাকা চুরি করিনি, সামান্য দুধের ছানা। মাগনা কাজের বেটি পাইছে, তাই এই রাশুনির আর কদর নাই।’

‘বেয়াদব মেয়ে, চুরি করিস তা বলতেও পারব না?’ গজগজ করেন খতিজা বানু।

বিদায় করে ভালো কাজ করেছেন, খতিজা বানু ভাবেন। অবশ্য বউও যে চুরি করবে না, তারও কোনো গ্যারান্টি নাই। তবুও চোখে চোখে রাখা যাবে। তার ৩৩ বছরের জোয়ান ছেলের জন্য দেখেশুনে এইট পাস, ১৫ বছরের মেয়ে এনেছেন তিনি। বুড়ো মেয়ে আনলে কথা শুনবে না। মুখে মুখে তর্ক করবে। এখন ছোট মেয়ে, তিনি যেমন চালাবেন, তেমনই চলবে। অনেকটা নরম মাটির মতোন, যা আকার দেবেন, সে হিসেবে তৈরি হবে।

খতিজা বানু ভাবেন, তাকেও কি তার শাশুড়ি তৈরি করেননি? তার বয়স তো তখন আরও কম ছিল। কখনো তাকে চড়-থাপ্পড়ও দিয়েছেন শাশুড়ি। প্রয়োজনে তিনিও জরিনাকে দেবেন। স্কুলে কি শিক্ষক মাইর ছাড়া ছাত্রছাত্রী মানুষ করতে পারেন? শ্বশুরবাড়ি হলো সবচেয়ে বড় স্কুল। সবচেয়ে বড় পাস-ফেল।

খতিজা বানুর মেয়ে শাহেদাকে কী তার সামনেই তার শাশুড়ি থাপ্পড় মারেননি। দোষ করলে দু-একটা থাপ্পড় দেওয়া যায়। শাহেদা সেদিন ভাত পুড়ে ফেলেছিল। যদিও মেয়েকে অন্যের হাতে থাপ্পড় খাওয়া দেখতে তার বুকে খুব লেগেছিল। কিন্তু তিনি কিছুই বলেননি। কিছু বলা সাজে না। মেয়ে লাই পেয়ে যাবে। তিনি লাই দিয়ে মাথায় তুলবেন, অমন মা নন। যেখানে নিজের মেয়েকে মাথায় তোলেননি, সেখানে জরিনা তো অনেক পরের কথা।

রহমান বিয়ের ২০ দিন পরই আবার আরব দেশে চলে যায়। ১০ বছরে খুব একটা কম আয় করেনি খতিজা বানুর একমাত্র ছেলে। ঘর বেঁধেছে। ছোট দুই বোন বিয়ে দিয়েছে। বাপের চিকিৎসা চালাচ্ছে। জমি আর চাষ বাড়াল, ঘর খরচ, বিয়ে করল। কম নাকি!

বিয়েটা সামান্য দেরিতে। তাতে কী। ছেলেদের রং আর বয়স দেখতে নাই। তা ছাড়া, তিনি প্রায় ফ্রিতে মেয়ে আনলেন। শুধু কটা ফার্নিচার ছাড়া আর কিছু কী দিল মেয়ের হাড়কিপটে বাপ। তবে মেয়ে খারাপ না। মাটির কাই যেন। যা বলেন মুখ নিচু করে নিখুঁতভাবে করে যায়। গরুকে ঘাস খাওয়ানো, দুধ দোয়ানো, ধান শুকানো, রান্নাবাড়া সব করে সে। অবশ্য এসব একদিনে সে শেখেনি। খতিজা বানু হাত ধরে ধরে শিখিয়েছেন। এখানে তার ক্রেডিট ১০০ ভাগ।

দেড়-দুই বছর পরপর রহমান দেশে আসে। প্রতিবার একটা করে নাত-নাতনিও পেটে দিয়ে যায়। তাতে অবশ্য বউয়ের খুব একটা কাজের ব্যাঘাত ঘটে না। বাচ্চা পেটে কাজ করার সুবাদে সহজে বাচ্চা জন্ম নেয়, তাতো আর মিথ্যে কথা নয়। তিনিও তো কাজ করেছেন। যখন পোয়াতি ছিলেন। তিনি তো অন্য শাশুড়িদের মতো বউকে ভুখা পেটে রাখেননি। প্লেট ভরে ভাত দেন। অবশ্য লাভের আশায়।

না, তার লাভ না, জরিনার লাভ। পোয়াতি মাইয়া বেশি বেশি খেলে বাচ্চা পেটে বড় হতে পারে না। খাবারের জন্য বড় হওয়ার সুযোগ পায় না। তাতে করে সহজে বাচ্চা বের হয়। তার শাশুড়ি তাকে শিখিয়েছেন, এখন তিনি তা শেখালেন জরিনাকে।

কিন্তু এত নিয়ম কানুন চালিয়েও বাচ্চাগুলো কেমনে এত মোটাসোটা গাবদাগোবদা হয়ে জন্ম নেয়, খতিজা বানুর মাথায় ঢোকে না।

২৫ বছর বয়সেই দুই ছেলে ও এক মেয়ের মা হয় জরিনা। তিনটা বাচ্চাই মায়ের চেয়ে দাদা-দাদির ভক্ত বেশি। তারা যা বলেন, সেই মোতাবেক চলে। জরিনা বাপের বাড়ি নাইওর গেলে তিনি যেমন শিখিয়ে দেন, তেমনি করে আসামাত্র দাদা-দাদির কাছে দৌড়ে এসে মায়ের সব কথা বলে দেয়।

মা কার কার সঙ্গে কথা বলেছে। বাড়িতে আর কোন খালা নাইওর এসেছে, দাদা-দাদির কোনো বদনাম করেছে কি না, সবই বলে দেয়। তারপর তিনি জরিনাকে চেপে ধরেন, বকা দেন।

একবার জরিনা পুকুরে সাঁতার কেটে গোসল করেছে বাপের বাড়ি।

খতিজা বানু সেটা জেনে কিছুটা রাগী স্বরে জানতে চান, ও বউ, তোমার কি লাজ লজ্জা কিছু নাই?

কী করেছি মা? ভিতু কণ্ঠে জরিনার জবাব।

তুমি নিজে চিন্তা করে দেখো। বয়স তো তোমার কম হয়নি। এই বয়সে বাপের বাড়ির পুকুরে সাঁতার কাটো!

জরিনা চুপচাপ সব শুনে যায়। কথা সত্য। কিন্তু এটা যে কোনো অপরাধ হবে, তা তার জানা ছিল না। ঘরের পেছনে পুকুর। তাও বেড়া দিয়ে ঘেরা। জরিনা মনে মনে ভাবে, থাক, নিশ্চয় তার অপরাধ মনে হয়েছে, তাই শাশুড়ি বকেছেন। আর ছেলেমেয়েগুলোই বা কেমন! সব বলে দেয়।

খতিজা বানু আবার বলেন, আর হ্যাঁ, ঘরে তোমার বাপ-ভাই থাকে না?

জি থাকেন।

তবে মাথায় কাপড়ের ঠিক থাকে না কেন? এমন হলে নাইওর আর যেতে দেব না।

জরিনা পরেরবার নাইওর গেলে, তার বড় বোন জরিনার ছেলেমেয়েদের অনেক বুঝিয়ে বলেন। জরিনা বললে হয়তো বুঝবে না। ভাববে, দাদা-দাদির বদনাম করছে।

তোমরা তোমাদের মাকে ভালোবাসো না?

বাসি তো।

তবে দাদিকে সব কথা বলে দাও কেন?

দাদি বলতে বলেছে।

দাদি মাকে বকা দেয়, তোমাদের কষ্ট হয় না?

হ্যাঁ।

জরিনার বাচ্চারা কিছু ভাবে। হয়তো ওই কষ্ট উপলব্ধি করার মতো যথেষ্ট বড় তারা তখনো হয়নি। তবুও একটা জবাব দেওয়ার জন্যই বলা।

তবে আর বোলো না। তোমার মাতো কোনো খারাপ কাজ করছে না। তোমার নানা-নানু-খালাদের সঙ্গেই কথা বলে। পুকুরে গোসল করার সময় সাঁতার কাটে কখনো। তোমরা সাঁতার কাটো না?

হ্যাঁ।

তোমার আম্মু বলে দেয়?

না। বাচ্চাদের জবাব।

তবে? খালাও নাছোড়বান্দা।

আর বলব না খালা।

হুম, আজ তোমরা সবাই মাঠে খেলতে যেও, কেমন?

খুশি হয় বাচ্চারা। মাঠে দাদি যেতে বারণ করেছে। রোদে পুড়ে গায়ের রং ময়লা হয়ে যাবে তাই। কিন্তু তাদের ওখানে যাওয়ার খুব লোভ।

জরিনার সব বাচ্চা বড় হয়ে গেছে। শ্বশুরও মারা গেছেন অনেক বছর। পাঁচ বছর হয় মেয়েটার বিয়ে হয়েছে ২৪ বছর বয়সে। এত পড়ালেখা করিয়েছে, এ জন্য শাশুড়ির কম কথা শুনতে হয়নি। তবে তার আর আগের মতো বয়স, শক্তি কিছুই নেই। শুধু মুখটাই শক্ত। জরিনা এখনো তাকে আগের মতো সম্মান করে। ভয় পায়। তবে তার সন্তানদের মানুষ করার ব্যাপারে তার কোনো কথা কানে তোলেনি।

বউ, মেয়েকে এত পড়াচ্ছ, আইবুড়ো বানাচ্ছ, বিয়ে দিতে পারবে? কে করবে তোমার বুড়ি মেয়েকে বিয়ে? মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি। ওর এই বয়সে তুমি তিন বাচ্চার মা হয়েছ, ভুলে গেলে? খতিজা বানু বলেন।

না, মা ভুলিনি। তবে যুগ পাল্টেছে মা। পড়ালেখা ছাড়া গতি নাই।

ছেলেদের করাচ্ছ, মেয়েকে কেন?

মেয়েদের বেশি দরকার মা।

কী করবে এত পড়া দিয়ে? চুলাই তো গুঁতাবে।

তা তো করবেই মা। বাচ্চা মানুষ করতে পড়ালেখা দরকার, স্বামীর কাজে সাহায্য করতে, তারপর বিপদ আপদে...।

বিপদ আপদ আবার কী? পড়লেও বিপদ আসবে, না পড়লেও আসবে।

ধরেন, কারও স্বামী মারা গেল কিংবা তালাক হলো, তখন মেয়ে কাজ করে সংসার চালাতে পারবে।

শুভ শুভ বলো বউ, খারাপ চিন্তা, বিপদ ভাবলে খারাপই হবে, আমরা ভাবি নাই, তাই হয় নাই।

না মা, বিপদ কি কাউকে বলে আসে, তাও আল্লাহর হুকুমেই আসে, তাই তা মোকাবিলা করার জন্য আমাদের সব সময় প্রস্তুত থাকা ভালো।

হুম কী জানি! খতিজা বানু সন্তুষ্ট হতে পারেন না।

এরপরও খুব ভালো প্রস্তাব পেয়ে এমএ পরীক্ষার আগে মেয়েকে বিয়ে দিতে হয় রহমানের জোরাজুরিতে।

বিয়ের পরে অবশ্য মেয়ে পরীক্ষা দিয়ে ভালোভাবে পাস করেছে। এবার ছেলের জন্য মেয়ে দেখা চলছে। ছেলের বয়স ২৯। আরও আগে বিয়ে করাতে চেয়েছিল জরিনা। ছেলে পাস করে তিন বছর চাকরি করে নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে করবেই না। এখন ছেলে বিয়েতে মত দিয়েছে।

ও বউ, বুড়ি মেয়ে আনবে না, ষোলো সতেরো বছরের বেশি বড় আনলে মেয়ে তোমার কথা শুনবে না। শাশুড়ি পরামর্শ দেন।

জরিনা শাশুড়ির কথা শুনে যায়। কিন্তু সে অত ছোট মেয়ে আনতে রাজি না। অনার্স পরীক্ষা দিয়েছে, রেজাল্টের অপেক্ষা করছে, এমন এক মেয়ে তার খুব পছন্দ হয়। কিন্তু ওদের শর্ত, মেয়েকে পড়াতে হবে। জরিনা ও তার ছেলে তা হাসি মুখে মেনে নেয়। জরিনা দুজন কাজের মেয়ে রাখে, বিয়ে বাড়ির ঝামেলা, কত কাজ, তা ছাড়া নতুন বউ।

ও বউ, কাজের মেয়ে রাখলে কেন আবার? টাকা কেন নষ্ট করছ? ছেলে বিয়ে করালে, বউ কাজ করবে।

মা, এক মেয়ে বিদায় করে, আরেক মেয়ে আনলাম, ওতো কাজের মেয়ে না। ওর যদি টুকটাক কখনো করতে মন চায়, করবে। আর পড়ালেখা করে সময় পেলেই না করবে।

কী বলো, এত বুড়া বউ আনলে, আরও পড়বে!

মা, এর চেয়েও বেশি বয়সে আমার মেয়ে বিয়ে দিয়েছি।

তা ওরা কই যাচ্ছে? কই পাঠাচ্ছ তাদের?

যাক, কদিন ঘুরে আসুক। স্বামী-স্ত্রী দুজন দুজনকে ভালোভাবে চিনুক জানুক। জরিনা জবাব দেয়।

ও মা, এসব কী বলো, ঘোরাঘুরি করা ছাড়া, আমরা কি সংসার করিনি!

জরিনা জবাব দেয় না। ওরও ইচ্ছে হয় রহমানের সঙ্গে কোথাও ঘুরতে যেতে।
---

ফারহানা বহ্নি শিখা: লন্ডন, যুক্তরাজ্য।