বাংলাদেশের মুক্তবাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাব

সফরকালে আলোচনা
সফরকালে আলোচনা

বাংলাদেশের প্রস্তাবিত মুক্তবাণিজ্য চুক্তির ব্যাপারে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে সাউদার্ন কমন মার্কেটের (মার্কোসুর) অন্তর্ভুক্ত চারটি দেশ আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে ও উরুগুয়ে সফর করেছেন বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তাঁর সফরকালে সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টার পাশাপাশি ওই চারটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও পারস্পরিক বিনিয়োগ উন্নয়নের উপায়সমূহও পর্যালোচনা করা হয়।

উল্লেখ্য, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে ও উরুগুয়ে মার্কোসুরের সদস্যরাষ্ট্র। চিলিসহ আরও আটটি দক্ষিণ আমেরিকার দেশ সহযোগী সদস্য।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গত ১৭ থেকে ২৫ আগস্ট ওই চারটি দেশ সফর করেন।

মার্কোসুরের সদস্যদেশগুলো দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের সমগ্র অর্থনীতির ৭৬ শতাংশ। মোট জিডিপি ৩ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার (পিপিপি ৪ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার)। দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা ৩০০ মিলিয়ন। অর্থাৎ দক্ষিণ আমেরিকার ৭০ শতাংশ জনগণের বাস এই চারটি দেশে। এই দেশগুলোর গড় মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ডলার (পিপিপি ২০ হাজার ডলার)। যেটি তাদের উচ্চ ক্রয়ক্ষমতার নির্দেশক।

বর্তমানে এই চারটি দেশের মোট আমদানি ১৬৬ বিলিয়ন ডলার (রপ্তানি ২০৩ বিলিয়ন ডলার)। এই বিশাল আমদানি বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি মাত্র ২০০ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। অথচ ওই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশের আমদানি ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। অর্থাৎ এই দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান বাণিজ্য ঘাটতি ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। প্রধানত উচ্চমাত্রার ট্যারিফ বাধার কারণে বাংলাদেশের পণ্য ওই দেশগুলোতে প্রবেশ করতে পারে না।

সফরকালে আলোচনা
সফরকালে আলোচনা

বাংলাদেশ-মার্কোসুরের মুক্তবাণিজ্য চুক্তি

সার্বিক বিষয়াদি পর্যালোচনা করে মূলত বাংলাদেশের সঙ্গে ওই দেশগুলোর বাণিজ্যে ভারসাম্য আনার লক্ষ্যে গত বছর ব্রাজিলে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. জুলফিকার রহমান মার্কোসুরের সঙ্গে একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব করেন। বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করে সিদ্ধান্তে আসে, এ ধরনের একটি চুক্তি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। গত নভেম্বরে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা জানিয়ে মার্কোসুরকে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

বাণিজ্যমন্ত্রীর এ সফরকালে চারটি দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও ব্যবসা খাতের নেতাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এক সপ্তাহের এ সফরে তিনি মোট ১৭টি আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করেন। দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ অর্থনীতি তথা বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম অর্থনীতি ব্রাজিলের বাণিজ্যিক রাজধানী সাও পাওলোতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ে একটি সেমিনারেও তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।

প্রতিটি দেশের নেতারাই (পররাষ্ট্রমন্ত্রী, শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী) বাংলাদেশের এ প্রস্তাবকে স্বাগত ও যথাসময়ে এ বিষয়ে কারিগরি আলোচনা শুরুর প্রস্তাব দেন। চুক্তি সম্পাদিত হলে বাংলাদেশ-মার্কোসুর মুক্তবাণিজ্য চুক্তির আওতায় মার্কোসুর দেশসমূহে বাংলাদেশের রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। এটি বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে বিশাল একটি মাইলফলক হবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

সফরকালে আলোচনা
সফরকালে আলোচনা

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সহযোগিতা

মার্কোসুরের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সফরকালে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার বিষয়েও আলোচনা করেন। এসব আলোচনায় তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি মার্কোসুর দেশগুলোর বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান। তিনি বাংলাদেশের বিনিয়োগবান্ধব আইনকানুন ও বিভিন্ন বড় বড় বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। একইভাবে মার্কোসুর দেশগুলোতে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরাও মার্কোসুরের বিশাল বাজারের সুবিধা নিতে পারে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ ও মার্কোসুর দেশগুলো এসব পারস্পরিক বিনিয়োগ সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করবে বলে উভয় পক্ষে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ক্ষেত্রে এই চার দেশ সফরের অর্জন

সফরকালে আলোচনা
সফরকালে আলোচনা

ব্রাজিল

এক. বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিপণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও ব্রাজিলের সর্ববৃহৎ ব্যবসা সংগঠন সাও পাওলো চেম্বার অব কমার্সের মধ্যে একটি সহযোগিতা স্মারক (memorandum of understanding) স্বাক্ষরিত হয়েছে।

দুই. মার্কোসুরের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য-বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য দুই দেশের সরকার ধারণাপত্র (concept paper) বিনিময় করবে এবং সম্ভাব্য সহযোগিতার ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করবে।

তিন. বিজিএমইএ ও ব্রাজিলের তুলা রপ্তানিকারকদের সংগঠন ABRAPA-র সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক স্মারক স্বাক্ষরের বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা।

চার. বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের ওপর ১৯৯২ সালে ব্রাজিল-আরোপিত অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক পর্যালোচনার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

পাঁচ. ব্রাজিল ও বাংলাদেশের মধ্যে পারস্পরিক বিনিয়োগ সহজতর করার উদ্দেশ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা পর্যালোচনা করা হবে। এ বিষয়ে ব্রাজিল একটি Model Investment Treaty বাংলাদেশের মতামতের জন্য প্রেরণ করবে। দুই পক্ষে মতৈক্য হলে বিনিয়োগ বিনিময় চুক্তিটি স্বাক্ষর করা যেতে পারে।

ছয়. বাংলাদেশের ও ব্রাজিলের বেসরকারি খাতের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়েছে। একে অপরের বাণিজ্য মেলাগুলোতে অংশগ্রহণ করার বিষয়ে বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোকে তাগিদ দেওয়া হবে।

সাত. বিজিএমইএ বাংলাদেশের পোশাকপণ্য ব্রাজিলে পরিচিতিকরণ ও ব্রাজিলের বাজারের চাহিদা বোঝার জন্য আগামী নভেম্বর মাসে একটি Single Country RMG Exhibition and Fashion Show করবে। ব্রাজিলিয়ান ডিজাইনারদের সঙ্গে কাজ করারও প্রয়াস নেওয়া হবে, যাতে ব্রাজিলিয়ান জনগণের চাহিদামতো পোশাকপণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হয়।

আর্জেন্টিনা

বাণিজ্য সহযোগিতা বিষয়ে যৌথ কমিশন গঠনে মতৈক্য হয়। এ বিষয়ে প্রটোকল স্বাক্ষরিত হবে। কমিশন দ্বিপক্ষীয় ও মুক্তবাণিজ্য চুক্তির আওতায় পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট খাতগুলো চিহ্নিত করবে।

দুই. আর্জেন্টিনা চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) বা সমপর্যায়ের ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষরে আগ্রহী। যার আওতায় বাণিজ্য প্রতিনিধিদল বিনিময় হবে।

বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা
বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা

প্যারাগুয়ে

এক. বাণিজ্য বিষয়ে যৌথ কমিশন গঠনে মতৈক্য হয়েছে। এ বিষয়ে সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষর করা যেতে পারে বলে উভয় পক্ষ মত প্রকাশ করেছে।

দুই. দুই দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সংগঠনের মধ্যে সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষরে আগ্রহ প্রকাশ।

উরুগুয়ে

এক. উরুগুয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অফিশিয়াল পাসপোর্টধারীদের ভ্রমণ সহজতর করার উদ্দেশ্যে পারস্পরিক ভিসা ছাড় চুক্তি স্বাক্ষরে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

দুই. উরুগুয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব করেছে।

তিন. দুই দেশের মধ্যে দ্বৈতকর পরিহার চুক্তি স্বাক্ষরেও উরুগুয়ে বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব করেছে।

চার. দুই দেশের শীর্ষ চেম্বারের মধ্যে সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তাব করা হয়েছে।

সপ্তাহব্যাপী এ সফরে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশ ও মার্কোসুর তথা দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কে বৈপ্লবিক উন্নয়ন ঘটবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সে ক্ষেত্রে বাণিজ্যমন্ত্রীর এ সফর বাংলাদেশ-দক্ষিণ আমেরিকা সম্পর্কে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে।

এসব কার্যক্রম সফলভাবে সম্পাদনে ব্রাসিলিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানের জন্য ব্রাজিলের তথা এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক রাজধানী সাও পাওলোতে বাণিজ্যিক শাখাসহ একটি বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল অফিস খোলার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ বিষয়টি বাংলাদেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। বিজ্ঞপ্তি