কাচের গুঁড়ায় কত ধার

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পলাশের সঙ্গে আমার ঠিক কীভাবে প্রথম পরিচয় হয়, তা মনে নেই। আমি দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র তখন। আব্বু রাজবাড়ী থেকে কুষ্টিয়া বদলি হয়ে এলেন, ১৯৮৮ সালের বন্যার শেষে। আমাদের যে ডি-টাইপ ফ্ল্যাটে ওঠার কথা, সে ফ্ল্যাট আম্মু-আব্বু কারোরই পছন্দ হলো না। ওই ফ্ল্যাটে পাটের চট দিয়ে মোড়ানো আমাদের সব আসবাব ও মালামাল পড়ে রইল। আব্বু এক জেলা থেকে অন্য জেলায় বদলি হলে এভাবে চট দিয়ে মোড়ানো হতো সবকিছু, যাতে কোনো কিছুতে আঁচড় না পড়ে যায়।

আমরা অস্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করলাম সার্কিট হাউসে, যত দিন পর্যন্ত নতুন বাসা না পাওয়া যায়। সার্কিট হাউসের প্রাচীরের ওপারেই কলকাকলী স্কুল। আমাকে সেখানে ভর্তি করানো হলো। আমার বড় দুই বোনকে ভর্তি করানো হলো কুষ্টিয়া গার্লস স্কুলে।

জীবনের দ্বিতীয় স্কুল আমার। আগের স্কুলের দুই-একজন বন্ধু হারিয়ে আমার তখন করুণ হাল। আমি খুব ভিতু ছিলাম। খুব কড়া কড়া মেজাজের টিচার, বিশেষ করে হেড মিস্ট্রেস রিজিয়া ম্যাডাম অসম্ভব কড়া। তাঁর দুই যমজ ছেলেমেয়ে আমার ক্লাসে পড়ত।

স্কুলে আমার ভালো লাগত না। ক্লাসে গিয়ে আমি কান্নাকাটি করতাম। আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আম্মু আমার ছোট বোনকে (দুই বড় বোনের মধ্যে যে ছোট) আমার সঙ্গে আমার স্কুলে পাঠিয়েছেন কয়েক দিন। যদিও সে এই স্কুলে পড়ত না। দুই-এক দিন আমি স্কুল শেষ হওয়ার আগেই প্রাচীর টপকে সার্কিট হাউসে চলে গিয়েছি।

স্কুল ভালো লাগেনি আমার একদম। স্কুলের ক্লাসরুমে চার সারি বেঞ্চ ছিল। দুই সারিতে ছেলেরা বসত। অন্য দুই সারিতে মেয়েরা। মেয়েদের সংখ্যা মনে হয় ছেলেদের চেয়ে কিছু কম ছিল। তাই যে ছেলে সবচেয়ে পরে আসত, তার আর ছেলেদের সারিতে জায়গা হতো না। তাকে মেয়েদের সারির সবচেয়ে পেছনে গিয়ে বসতে হতো।

ক্লাসের মধ্যে এটা ছিল বিরাট লজ্জার একটা ব্যাপার। সব ছেলেপুলে মিলে ওই ছেলেকে খ্যাপাতে থাকত, ‘এই তুই তো আজকে মেয়েদের লাইনে বসছিস। তুই হাসসাহি।’ এ জন্য আমার কোনো দিন স্কুলে যেতে দেরি হলে আমি আম্মুকে বলতাম, আম্মু আমি আজকে স্কুলে একদমই যেতে চাচ্ছি না। এ ব্যাপারটা আমাকে স্কুলে দেরি করে না যাওয়ার জন্য যতটা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, আমার জীবনে আর কোনো কিছুই কোনো কাজে সময়মতো যাওয়ার জন্য এতটা উদ্বুদ্ধ করেনি।

যা হোক, বিষণ্ন কড়কড়ে বন্ধুহীন স্কুলের ছুটির পর সার্কিট হাউসের জীবনটা খারাপ ছিল না মোটেই। আমরা দুটো রুম নিয়ে থাকতাম। ছোটাছুটি করতাম সারা দিন। নিচে ছিল ডাইনিং হল। বাবুর্চির নাম ছিল মনিরুজ্জামান। ক্রিং ক্রিং ফোন বাজলেই ফেরিওয়ালাদের মতো গলার স্বরের একটা নির্দিষ্ট টোনে তিনি বলতেন, ‘হ্যালো, স্লামালাইকুম, সার্কিট হাউস। আমি বাবুর্চি মনিরুজ্জামান বলছি।’ ব্যাপারটা কেন জানি না আমাদের কাছে খুব আমোদপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। নিচে ফোন বাজলেই আমি আর আমার ছোট বোন দৌড়ে চলে যেতাম বাবুর্চির সেই কথা শোনার জন্য।

কিছুদিন পরে নতুন বাসা পাওয়া গেল। থানা পাড়ায়। ছয় রাস্তার মোড় থেকে কাছাকাছি। ছয়টা রাস্তা ওই মোড়ে এসে মিলেছে, ভাবতে খুব অবাক লাগত। তখনো জীবনে এ রকম আর কিছু দেখিনি। ছয় রাস্তার মোড় থেকে যে রাস্তাটা গড়াই নদের দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তায় গড়াইয়ের পারেই আমাদের বাসা। তৃতীয় তলায় আমাদের বাসার বারান্দা থেকে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া চর পড়া গড়াই আর তার ওপারের হরিপুর গ্রামের ঘাটের বিশাল বটগাছ, সবই দেখা যেত। প্রকৃতির সঙ্গে আমার প্রেমটা মনে হয় সেখান থেকেই শুরু।

সেই বাসার চতুর্থ তলায় থাকত পলাশরা। আমার চেয়ে লম্বা। বয়সে কয়েক বছরের বড়। পড়েও কয়েক ক্লাস ওপরে। ছিমছাম গড়ন। শ্যামবর্ণ। তিন বোন আর সে-ই একমাত্র ভাই। সে সবার ছোট। ওর বড় দুই বোন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। হলে থাকত। ঘুড়ি ওড়াতে গিয়েই বোধ হয় পলাশের সঙ্গে প্রথম খেলতে যাওয়া।

চতুর্থ তলার ওপরেই বাসার ছাদ। ছাদে গড়াই নদের বাতাস। ঘুড়িকে আর পায় কে। পলাশের কাছ থেকে শিখেছি কীভাবে লাটাই ঘুরাতে হয়। ঘুরাতে ঘুরাতে দুই হাতের বুড়ো আঙুলের চামড়া ছিলে গেছে। বাতাসের ঝাপটা যখন আসবে, তখন আমি ছাদের এক কোনা থেকে ঘুড়িটাকে ওপরের দিকে ছুড়ে দেব। আর তখনই ছাদের ওপর প্রান্ত থেকে পলাশ লাটাই দিয়ে সুতা টানা শুরু করবে। বাতাসের সঙ্গে সঠিক সময়ে এটা করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। না হলে ঘুড়ি উড়বে না। এই জ্ঞান ওর কাছ থেকেই পাওয়া।

ছয় রাস্তার মোড়ে ঘুড়ি পাওয়া যেত। বড়গুলো এক টাকা, ছোটগুলো আট আনা (৫০ পয়সা)। কাগজ আর কাঠি দিয়ে ঘুড়ি কম খরচে বানানো যায়। কিন্তু অতটুকু বয়সে ঘুড়িটাকে ব্যালান্স করা খুব মুশকিল। যাঁরা ঘুড়ি উড়িয়েছেন, তাঁরা জানেন, বর্গক্ষেত্রাকার একটা ঘুড়ির এক অতিভুজ বরাবর একটা চ্যাপ্টা কাঠি থাকে। অন্য দুই কোনায় লাগানো থাকে ধনুকের মতো একটা বাঁকানো গোল কাঠি।

আম্মুর কাছ থেকে অনেক ঘ্যান ঘ্যান করে টাকা নিয়ে শুধু ঘুড়ি কিনলেই তো আর হবে না, চ্যাপ্টা কাঠির পাশে ছোট্ট ছিদ্র করে দড়ি বাঁধতে হবে, যেটা আমি পারতাম না। পলাশ আমাকে বেঁধে দিত। ভাগ দড়ি বাঁধার পর ঘুড়িটা ব্যালান্স করতে হবে। দুপাশে সমান না হলে ছোট কাগজের টুকরা ধনুকের একপাশে লাগিয়ে দিতাম। একে বলে কোনু দেওয়া।

বয়সে আমার বড় হলেও পলাশকে ‘তুই’ ছাড়া আমি আর কিছুই বলিনি। আমার বোন, আমি আর সে একসঙ্গে কাদা ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। রাস্তার পাশের নর্দমার মতো খালে মাছ ধরেছি বড়শি দিয়ে। নাইলোটিকা কিংবা খলসে মাছ। খলসে মাছ হরলিকসের বোতলে বেশ অনেক দিন বেঁচে থাকে। গায়ের রংও লালচে, বেশ সুন্দর। তখন গোল্ড ফিশ কী জিনিস, আমরা জানিও না। অ্যাকুয়ারিয়াম একটা বিরল বিলাসিতা।

আমাদের দালানের সামনে একটা মাঠ ছিল। সেই মাঠের ঝোপঝাড়ে আসত অসংখ্য ফড়িং। নানান রঙের, নানান ঢঙের। একটাকে আমরা বলতাম ‘রাজা ফড়িং’, অন্যগুলোর চেয়ে একটু বড় আর লাল রঙের। কতগুলো ছিল কাঠির মতো রংবেরঙের, দেহ আর পাখাটা ছোট। আমরা বলতাম কাঠি ফড়িং। আমরা তিনজন অনেক ফড়িং ধরে একটা গাছের ডাল ভেঙে তার রস খাওয়াতাম, অজ্ঞানের মতো পড়ে থাকত। পরদিন এসে দেখতাম আর নেই। চলে গেছে।

পুজোর সময় মেলা হতো। সেই মেলা থেকে কিনেছিলাম কেরোসিনের লঞ্চ। ছোট্ট কেরোসিনের কুপির আলো একটা বয়লারকে তাপ দিত। বয়লার থেকে দুটো পাইপ পানির মধ্যে ভট ভট শব্দ করতে করতে লঞ্চকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেত। এখন দেখি না আর এসব। বর্ষায় মাঠে পানি জমলে পলাশের সঙ্গে লঞ্চ চালিয়েছি কত। পশুপাখির প্রতি তার খুব মায়া ছিল। একবার কোথা থেকে ধরে নিয়ে এল একটি ছোট্ট কুকুর। আমরা তিনজন ছাদে একটা ঘর বানিয়ে পালতে শুরু করলাম। পাখির বাচ্চাও এনেছিল। মরে গেছে। আমাদের কী মন খারাপ। মাঠের কোনায় বাবলা গাছতলায় আমরা তিনজন কবর দিয়েছি পাখিটাকে।

পলাশের সঙ্গে খেলতে খেলতে আমি লাট্টু (লাটিম) ঘোরানো শিখেছি। লোহার চোখা মাথাওয়ালা কাঠের লাটিমের চারপাশে কীভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দড়িটা প্যাঁচাতে হবে, কীভাবে মারলে লাটিমটা ঘুরবে, খুব সহজ কাজ না কিন্তু এটা। একজন তার লাটিম দিয়ে আরেকজনের লাটিমকে ‘কোপ’ দেবে। সেটা আরও মজার। যার লাটিম ভেঙে যাবে, সে হেরে গেল। ঠিক ঘুড়ির সুতা কাটাকাটির মতো।

ঘুড়ি দিয়ে কাটাকাটি খেলতে হলে সুতোয় মাঞ্জা দিতে হবে। আমরা তিনজন মাটির হাঁড়িতে সাগুদানা জ্বাল দিতাম। গরম হলে ওটা আঠা হবে। সেই আঠা সুতোয় লাগিয়ে, তার ওপর কাচের গুঁড়া লাগিয়ে দিতে হবে। সব সুতা একসঙ্গে না কিন্তু। লাটাই দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে করতে হবে। অনেক সময় লাগে। একজন সাগুদানার আঠা লাগবে সুতায় এবং তার অতিরিক্ত আঠা কাপড় দিয়ে মুছে ফেলবে। আরেকজন সেই সুতায় কাচের গুঁড়া লাগাবে। তৃতীয়জন লাটাই গুটাবে। খুব জটিল একটা ব্যাপার।

আজকে আমার ওই বয়সের ভাগনে-ভাগনিকে আমি কোনোভাবেই সেটা বোঝাতে পারব না। কাচের গুঁড়া দেওয়া হয়ে গেলে সুতা ছাদের মধ্যে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শুকাতে হবে। সেদিন বৃষ্টি হলেই হলো, সুতো পচে যাবে। এই কাজ করতে গিয়ে কাচের গুঁড়ায় হাত কেটে ফেলেছি। আমরা তিনজন মিলে আগেই ঠিক করে রাখতাম কবে সুতোয় মাঞ্জা দেব।

কাটাকুটি খেলার সময় সুতা কেটে যাওয়া ঘুড়ির পেছনে ছোটাও একটা মজা। আকাশে অনেক ঘুড়ির মধ্যে যেটা কেটে যাবে, সেটা ধীরে ধীরে দুলতে দুলতে নিচের দিকে পড়তে থাকবে। একদিন ঘুড়ি আর ওড়ে না কিছুতেই। বাতাস নেই। ছাদের এক কোনায় পানির ট্যাংকি। তার ওপর উঠেছি, যদি ওড়ানো যায়। লাটাই টানার সময় আর খেয়াল নেই। পড়ে গেলাম ছাদের ওপর। ভুরু কেটে গেল। ভুরুতে সেই কাটে দাগ এখনো আছে আমার।

বাড়িওয়ালার পেয়ারা আর পাশের বাড়ির আতাফল চুরি করতাম আমরা। কষটে পেয়ারা, খাবে কে, চুরিই সার, কাঁচা আতাফল আমরা চালের ড্রামে রেখে দিতাম, পেকে যেত কয়দিন পর।

ইদানীং আমি কোনো কিছুই মনে রাখতে পারি না। মানুষ বলে আমি স্মৃতিকাতর। স্মৃতি ধরে রাখার এত প্রযুক্তি তো তখন ছিল না। তাই আমি মনের অজান্তেই সব ধরে রেখেছি আমার মনে। কুষ্টিয়া ছেড়ে এসেছি আজ ২৮ বছর। পলাশকে এত বছর পরে আজ দেখে হঠাৎ সব মনে পড়ে গেল।

ওর অফিস রুমে ওর সঙ্গে কফি খেতে খেতে বসে গল্প করলাম। স্মৃতিচারণা তেমন কিছুই করিনি আমরা। সাধারণ সব কথা, ‘তোমার মা-বাবা-বোনেরা সব কেমন আছে, কোথায় আছে? ও, তোমার বাবা মারা গেছেন, শুনিনি তো।’

এত দিন পর দুই বন্ধুর মুখোমুখি কথা, নিষ্পলক দৃষ্টিতে দুজন দুজনকে দেখছি। অফিসে দু-একজনের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বলল, ‘ও আমার ছোটবেলার খুব...খুব ঘনিষ্ঠ...’, ও বাক্যটা শেষ করতে পারল না একবারও। ওর সেই কণ্ঠস্বরেই আমি জানি, স্মৃতি শুধু আমার একার নয়, ওরও মনে পড়ে সবকিছু, এ কোনো দিন ভোলার নয়।

পরদিনই আবার আমার বিদেশে ফেরত যাওয়ার ফ্লাইট। বেশি সময় বসতে পারিনি ওর অফিসে। ও আমাকে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসার পথে আমি শুধু বলেছিলাম, ‘জানো, কাচের গুঁড়ো দিয়ে ঘুড্ডির সুতোয় মাঞ্জা জীবনে আর কখনো দেওয়া হয়নি আমার।’
---

আহমেদ আসিফ আশরাফ: ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র।