শূন্য বিন্দুতে নারী - দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমাকে বলতে দিন। কথার মাঝখানে থামাবেন না। আপনার কথা শোনার মতো সময় হাতে নেই। আজ সন্ধ্যা ছয়টায় ওরা আমাকে নিতে আসবে। আগামীকাল সকালে এখানে আর থাকব না। থাকব না, জনমানবের চেনা-পরিচিত কোনো জায়গাতেও। এবং দুনিয়ার সবার অজানা গন্তব্যে এই যাত্রা নিয়ে আমি গর্বিত।

সারা জীবন এমন একটা কিছুর প্রতীক্ষায় ছিলাম, যা নিয়ে আমি গর্ব করতে পারি। এমন কিছু, যা আমাকে শ্রেষ্ঠত্বের চূড়ায় আসীন করবে। রাজা-রাজপুত্র-শাসকদের চেয়েও। প্রতিবার খবরের কাগজ খুলে এদের গোত্রীয় কোনো পুরুষের ছবি দেখলে, তাতে থুতু ছিটাতাম। জানতাম নিতান্ত একটা খবরের কাগজেই থুতু ছিটাচ্ছি, যা পরে আবার আমার রান্নাঘরের তাকেই বিছাতে হবে। তবুও থুতু ছিটাতাম ও শুকানোর জন্য ফেলে রাখতাম।

আমাকে ছবিতে থুতু ছিটাতে দেখে লোকে হয়তো ভেবেছে, ছবির পুরুষগুলো আমার পরিচিত। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। আমি সামান্য এক নারী। একা কোনো মেয়ের পক্ষে এত সব পুরুষকে চেনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যাদের ছবি হরহামেশা কাগজে ছাপা হয়। দিন শেষে, আমি ছিলাম শুধুই এক সফল বেশ্যা। আর দুনিয়ার সফলতম বেশ্যার পক্ষেও কখনো তাবৎ পুরুষকে চেনা সম্ভব নয়।

তবে যে কয়জনকে চিনেছি, তাদের প্রত্যেকে আমার একটি বাসনাই জাগাতে পেরেছে—হাত তুলে কষে তাদের গালে চড় বসিয়ে দেওয়ার বাসনা। কিন্তু মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে কখনো তা করার সাহস পাইনি। আর বেশ্যা বলে, মেকআপের প্রলেপ দিয়ে ভয়টুকু আড়াল করেছি।

নামীদামি বেশ্যা হওয়ায়, আমার মেকআপ বরাবরই ছিল সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েদের মেকআপের মতো উঁচু দামের, উঁচু মানের। শুধু অভিজাত নারীরা যায় এমন সব জায়গায় চুল বাঁধাতে যেতাম। সব সময় ‘হালকা ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ’ রঙের লিপস্টিক লাগাতাম, যাতে ঠোঁটের আবেদনে ভারসাম্য থাকে।

সমাজের উঁচু কাতারের পুরুষের স্ত্রীরা, আমন্ত্রণ ও প্রত্যাখ্যানের ভারসাম্য রেখে যেভাবে চোখ আঁকে, আমিও ঠিক সেভাবে আঁকতাম। তবে শুধু আমার মেকআপ, চুল বাঁধা ও দামি জুতোগুলো ছিল উচ্চবিত্তের, মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট ও জীবনের অপূর্ণ বাসনা নিয়ে আমি ছিলাম ‘মধ্যবিত্ত’ ও জন্মসূত্রে ‘নিম্নবিত্ত’।

---

আমার দরিদ্র-খেতমজুর বাবা লিখতে পড়তে জানতেন না। খুব সামান্য বিষয়ই ছিল তার জানা। জানতেন শুধু, কেমন করে ফসল ফলাতে হয়। শত্রুরা তার মহিষকে বিষ খাইয়ে দিলে কেমন করে সেটি মারা যাওয়ার আগে বেচে দিতে হয়। আগেভাগে বিয়ে দিয়ে কন্যার কুমারীত্বের বিনিময়ে কীভাবে যৌতুকে মাফ পাওয়া যায়। খেতে ফসল পাকলে চুরির প্রতিযোগিতায় প্রতিবেশীকে কীভাবে হারানো যায়। গোত্রপ্রধানের হাতের ওপর ঝুঁকে কীভাবে চুমু খাওয়ার ভান করতে হয়। প্রতি রাতে কীভাবে বউ পিটিয়ে তুলাধুনা করতে হয়…।

প্রতি শুক্রবার সকালে তিনি একটি পরিষ্কার গালাবিয়া (ছেলে-মেয়েদের লম্বা, ঢিলেঢালা, কলার ও বোতামবিহীন আলখাল্লা মতো মিসরীয় পোশাক) গায়ে চড়িয়ে, জুমা পড়তে মসজিদের দিকে রওনা দিতেন। নামাজ শেষে দেখতাম, তিনি ও তারই মতো আরও লোকজন একসঙ্গে হেঁটে আসতে আসতে শুক্রবারের খুতবা নিয়ে আলাপ করছেন। বলছেন, ইমাম সাহেব কীভাবে তার সম্মোহনী কথার জাদুতে নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন। এ কথা কি সত্য না যে, চুরি করা পাপ, খুন করা পাপ, নারীর সম্ভ্রমহানি পাপ, অবিচার করা পাপ ও কাউকে পেটানো পাপ…?

এ ছাড়াও কে অস্বীকার করতে পারে যে ইমানদার হওয়া ফরজ, দেশপ্রেমও। কে অস্বীকার করবে যে শাসক ও আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা এক ও অবিচ্ছেদ্য। আল্লাহ আমাদের শাসককে দীর্ঘজীবী করুন এবং তিনি আমাদের দেশ, গোটা আরব জাতি ও সমগ্র দুনিয়ার জন্য শক্তি ও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকুন।

আঁকাবাঁকা সরু গলির মধ্য দিয়ে তাদের হেঁটে যেতে দেখতাম। দেখতাম, মহাত্মা ইমামের বলা প্রতিটি কথায় একমত হয়ে ভক্তিতে মাথা দোলাচ্ছেন। দেখতাম, মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে যেতে, আপ্লুত হয়ে হাত কচলাতে, প্রতিবার আল্লাহর নাম নেওয়ার সময় ভ্রুতে আঙুল ছোঁয়াতে, আল্লাহর রহমত প্রার্থনা করতে, একনাগাড়ে ফ্যাসফ্যাসে ও চাপা স্বরে বিড়বিড় করে দোয়াদরুদ পড়তে।

আমার মাথায় থাকত পানিভর্তি ভারী মাটির কলস। এর ওজনে আমার ঘাড় কখনো কখনো পেছনে, ডানে বা বামে ঝাঁকি খেত। রীতিমতো কসরত করে এর ভারসাম্য রাখতে হতো, যাতে পড়ে না যায়। এমনভাবে কদম ফেলতে হতো, যাতে শিরদাঁড়া সব সময় সোজা থাকে। ঠিক যেমনটি মা শিখিয়েছিলেন। আমি তখনো অনেক ছোট ও স্তন তখনো পুষ্ট হয়নি। পুরুষ সম্পর্কেও কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু তাদের চাপা, ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠের দোয়াদরুদ কানে আসত। দেখতাম, মাথা দোলাচ্ছে, হাত কচলাচ্ছে, আর সেই সঙ্গে চলছে খুকখুক কাশি, গলা খাঁকারি, ক্ষণে ক্ষণে বগল ও ঊরুসন্ধি চুলকানো। দেখতাম, আশপাশে ঘটে চলা সবকিছু তারা মাপছে সতর্ক, দ্বিধান্বিত ও চোরা চাহনিতে। সেই চাহনি ছোঁ মারতে উদ্যত, আগ্রাসী, আবার একই সঙ্গে অদ্ভুত রকম ভিতু।

মাঝে মাঝে তাদের মধ্য থেকে বাবাকে আলাদা করতে পারতাম না। অন্যদের সঙ্গে তার এত মিল যে, আলাদা করা বেশ কঠিনই ছিল। তাই একদিন মাকে তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করি। জানতে চাই, জন্ম দিতে বাবা কেন লাগে। শুনে, প্রথমে তিনি আমাকে ইচ্ছামতো পেটান। তারপর এক নারীকে নিয়ে আসেন। ওই নারীর সঙ্গে ছোট ছুরি বা ব্লেড জাতীয় কিছু একটা ছিল। আর তাই দিয়ে সেই নারী আমার ঊরুসন্ধি থেকে ছোট্ট একটি মাংসপিণ্ড কেটে নেয়।

আমি রাতভর কাঁদি। পরদিন সকালে মা আর আমাকে চাষের জমিতে পাঠালেন না। তিনি সাধারণত আমার মাথায় এক ঝুড়ি গোবর চাপিয়ে জমিতে পাঠাতেন। বাড়িতে থাকার চেয়ে ফসলের মাঠে যেতেই বেশি ভালো লাগত আমার। সেখানে ছাগলের পিছে ছুটে বেড়াতাম। চাকাকৃতির সেচের যন্ত্র বেয়ে ওঠানামা করতাম। আর ছেলেপুলেদের সঙ্গে খালে সাঁতরাতাম। মোহাম্মাদাইন নামে এক ছোকরা ছিল। সে পানির নিচে আমাকে চিমটি কাটত। আর আমার পিছু পিছু ভুট্টার আঁটি দিয়ে বানানো ছোট্ট ছাউনি পর্যন্ত যেত।

সেখানে আমাকে সে খড়ের গাদার ওপর শুইয়ে দিয়ে আমার গালাবিয়া গুটিয়ে নিত। এভাবে আমরা ‘জামাই-বউ’ খেলতাম। তখন আমার শরীরেরই কোনো এক জায়গা থেকে, ঠিক কোথা থেকে তা বুঝতাম না, তীব্র এক আনন্দের শিহরণ বয়ে যেত। আমি চোখ বন্ধ করে, হাত বুলিয়ে ওই জায়গাটি খুঁজে বেড়াতাম, যেখানে স্পর্শ করা মাত্র একই শিহরণ ফিরে আসে। আমরা আবার খেলায় ফিরে যেতাম, একদম সূর্যাস্ত পর্যন্ত। পাশের জমি থেকে তার বাবা নাম ধরে তাকে ডাকলে সে ছুট লাগাত। আমি তাকে ছাড়তে চাইতাম না। পরদিন আবার আসার কথা দিয়ে সে ছুটে পালাত।

মা কিন্তু আমাকে আর ফসলের মাঠে পাঠাতেন না। সূর্য ওঠার আগেই, কাঁধে গুঁতো দিয়ে জাগিয়ে দিতেন। আমি উঠে, মাটির কলস তুলে নিয়ে পানি আনতে যেতাম। ফিরে এসে, পশুপাখির খোঁয়াড় পরিষ্কার করে, গোবর দিয়ে সারি সারি ঘুঁটে বানিয়ে রোদে শুকাতে দিতাম। রুটি তৈরির দিনে, আটা চটকে ময়ান করে রুটি বানাতাম।

আটা চটকানোর জন্য গামলাটি দুই হাঁটুর মাঝখানে রেখে মেঝেতে নিচু হয়ে বসতাম। একেকটি আটার দলা পরপর এমনভাবে শূন্যে ছুড়ে দিতাম, যাতে ওগুলো ফিরে এসে গামলায় পড়ে। উনুনের আঁচ আমার মুখে এসে লাগত, মাঝে মাঝে চুলের আগা ঝলসে দিত। আমার গালাবিয়া প্রায়ই ঊরুর ওপর উঠে যেত। সেদিকে আমার কখনো খেয়াল থাকত না, যে মুহূর্ত পর্যন্ত না চোখের কোনায় দেখতে পেতাম, বই পড়তে থাকা চাচার হাত, বই ছেড়ে ধীরে ধীরে আমার ঊরু ছুঁতে এগিয়ে আসছে। পরমুহূর্তে টের পেতাম, সতর্ক, চোরা, কম্পিত আঙুলগুলো আমার ঊরু বেয়ে চুপিসারে উঠে আসছে।

বাড়ির সদর দরজায় পায়ের আওয়াজ পাওয়ামাত্র হাতটি দ্রুত উধাও হয়ে যেত। কিন্তু মাঝে মাঝে উনুনে দেওয়ার জন্য আমার হাতে শুকনো ডালপালা ভাঙার শব্দটুকু ছাড়া যখনই আশপাশ নিশ্চুপ হয়ে পড়ত ও বইয়ের আড়াল থেকে তার ভারী নিশ্বাসের শব্দ ভেসে আসত। বোঝা যেত না, উনি কি ঘুমের মধ্যে হালকাভাবে নাক ডাকছেন নাকি জেগেই হাঁপাচ্ছেন। হাতখানি কিন্তু নাছোড়বান্দার মতো আমার ঊরু আঁকড়ে ধরে একটানা ডলে যেত।

আগে মোহাম্মাদাইন যা করত, তিনিও আমার সঙ্গে তা-ই করতেন। সত্যি বলতে, তিনি আগাতেন আরও অনেক দূর। কিন্তু আমি আমার শরীরের অদেখা অথচ অতি পরিচিত অঙ্গটি থেকে উঠে আসা ভালো লাগার শিহরণ আর পেতাম না। চোখ বুজে আগের সেই শিহরণ ফিরে পেতে চাইতাম। কিন্তু কাজ হতো না। শিহরণের উৎসবিন্দুটি আমি যেন আর খুঁজে পাচ্ছি না কিংবা আমার অস্তিত্বের একটি অংশ হারিয়ে ফেলেছি চিরতরে।

---

চাচার বয়স মোটেও কম ছিল না। ছিল আমার কয়েক গুণ। যখন অক্ষরও চিনতে শিখিনি, তখনই তিনি আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য, একা একা কায়রো আসা-যাওয়া করতেন। চাচা আমার আঙুলের ফাঁকে চক গুঁজে দিয়ে স্লেটে লেখাতেন—আলিফ, বা, জিম, দাল… কখনো কখনো তার সঙ্গে বলতে হতো, ‘আলিফের ওপর নুকতা নাই বা এর নিচে এক নুকতা, জিমের মধ্যে এক নুকতা, দালের কোনো নুকতা নাই।’ সুর করে মাথা দুলিয়ে, কোরআন তিলাওয়াতের মতো করে তিনি ইবনে মালিকের সহস্র পঙ্‌ক্তির কবিতা পড়ে শোনাতেন। আমিও তার সঙ্গে সঙ্গে বারবার করে প্রতিটি বর্ণ বলতাম, আর তারই মতো মাথা দোলাতাম।

ছুটি ফুরালে, গাধার পিঠে চড়ে চাচা ডেলটা রেলওয়ে স্টেশনের দিকে রওনা দিতেন। আর আমি ডিম, কেক, বইপত্র ও কাপড়চোপড়-ভর্তি বিশাল এক বাক্স নিয়ে তার পিছে পিছে যেতাম। একদম স্টেশনে পৌঁছা পর্যন্ত পুরো পথ তিনি সিটাডেলের কাছে মোহাম্মদ আলী সড়কের শেষ প্রান্তে অবস্থিত তার কামরা, আল-আজহার, আতাবা স্কয়ার, ট্রাম ও কায়রোবাসীর গল্প শোনাতেন। কখনো কখনো মিষ্টি সুরে গান ধরতেন এবং গানের তাল ও গাধার চলনের ছন্দে ছন্দে তার শরীর দুলতে থাকত।

‘উতল সাগর ঢেউয়ে তোমায় যাইনি আমি ছেড়ে
তবুও ঊষর জমির পরে ফেলেই গেলে মোরে।
উজল সোনার লোভে তোমায় দিইনি বেচে আমি
তুচ্ছ খড়ের জন্য দিলে আমায় বেচে তুমি
ও মোর দিঘল রাত
ও আমার চোখের তারা, ওহো রে…’

চাচা হন্তদন্ত হয়ে ট্রেনে উঠে বিদায় জানালে, তার সঙ্গে কায়রো যাওয়ার জন্য কান্না জুড়ে দিতাম।

কিন্তু তিনি বলতেন, ‘ফেরদৌস, কায়রোতে গিয়ে করবেটা কী?’

জবাব দিতাম, ‘কেন, আপনার মতো আল-আজহারে পড়াশোনা করব।’

তখন তিনি হেসে উঠে বলতেন, আল-আজহারে শুধু ছেলেরা পড়ে। আমি কাঁদতাম ও ট্রেন চলতে শুরু করা পর্যন্ত তার হাত আঁকড়ে ধরে থাকতাম। কিন্তু তিনি আমার হাত এক ঝটকায় এমনভাবে ছাড়িয়ে নিতেন যে, আমি মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়তাম।

মনে একগাদা প্রশ্ন নিয়ে, নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে, নত মাথায় পায়ের পাতার দিকে ধ্যানমগ্ন হয়ে তাকিয়ে থেকে, গ্রামের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে যেতাম। আমি কে? আমার বাবা কে? খোঁয়াড় পরিষ্কার করে, গোবর মাথায় নিয়ে, রুটির ময়ান বানিয়ে, রুটি সেঁকেই কি জীবন কাটবে আমার?

পিতৃগৃহে ফিরে, মাটির দেয়ালের দিকে এমন আগন্তুকের মতো তাকিয়ে থাকি, যেন আমি জীবনেও এই দেয়াল দেখিনি। চারপাশে এমন বিস্ময় নিয়ে তাকাই, যেন আমি এখানে জন্মাইনি। অকস্মাৎ আকাশ থেকে পড়ে বা মর্ত্যের গভীর থেকে উঠে এসে নিজেকে এমন এক জায়গায় আবিষ্কার করেছি, যা আমার নয়; এমন এক বাড়িতে, যা আমার নয়। এমন মা-বাবার ঘরে জন্মেছি, যাঁরা আমার মা-বাবা নন। তাহলে কি চাচার বলা কায়রোর গল্প, কায়রোবাসীর গল্প আমায় বদলে দিল? আমি কি সত্যি সত্যি আমার মায়েরই মেয়ে, নাকি অন্য কারও? নাকি এই মায়ের গর্ভে জন্মে এখন অন্য এক মানুষ হয়ে গেছি? নাকি রূপান্তর ঘটেছে মার কিন্তু তা এত সূক্ষ্ম যে এত দিন ধরতে পারিনি?

মাকে প্রথম কেমন দেখেছি, তা মনে করতে চেষ্টা করি। চোখ দুটো শুধু মনে পড়ে। তার দুটো চোখ। কিন্তু চোখের রং ও ধরন মনে করতে পারি না। আমি সেই চোখের দিকে খেয়াল রাখতাম। আর সেগুলো খেয়াল রাখত আমার দিকে। এমনকি চোখের আড়াল হলেও নজরের আড়াল হতাম না। সবখানে অনুসরণ করত, হাঁটা শিখতে গিয়ে হোঁচট খেলে আমাকে যাতে টেনে তোলা যায়।

আমি প্রতি কদমেই হোঁচট খেতাম। মনে হতো, একটি শক্তি যেন আমাকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে সামনে ফেলছে বা সামনে থেকে চেপে বসে পেছনে ঠেলছে। বাতাসের এক প্রবল চাপ যেন আমাকে গুঁড়িয়ে দিতে চাইছে। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ যেন আমাকে পাতালে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। আর এত কিছুর মধ্যে পড়ে আমি হাত-পায়ের পেশি টান টান করে, প্রাণপণে কসরত করছি উঠে দাঁড়াবার। কিন্তু এই চতুর্মুখী শক্তির ঘূর্ণাবর্ত আমাকে বারবার ফেলে দিচ্ছে। আমি যেন-কূলকিনারাহীন। তলদেশহীন অসীম সাগরে ছুড়ে ফেলা কোনো বস্তু, যা ডুবতে গেলে জলের আর ভাসতে গেলে বাতাসের চাবুকে ক্ষতবিক্ষত।

অনন্তকাল ধরে যেন সমুদ্র ও আকাশের মধ্যে ডোবা আর ভাসা, ভাসা আর ডোবা। খড়কুটোহীন। কোনো কিছু আঁকড়ে ধরার নেই। শুধু দুটো চোখ ছাড়া। দুটো চোখ আমি প্রাণপণে আঁকড়ে থাকি। দুটো চোখ একাই আমাকে ধরে রাখতে পারে। চোখ দুটো আয়ত না সরু, পাপড়ি আছে কী নেই, তা আজ পর্যন্ত মনে পড়ে না। শুধু মনে পড়ে, ঘন কালো দুটো বৃত্ত ঘিরে ধবধবে সাদা দুটো চক্র। আমি তাকানোমাত্র সাদা অংশটুকু আরও ধবধবে, আর কালোটুকু আরও মিশমিশে হয়ে যেত। ওই মুহূর্তে মনে হতো, কোনো জাদুকরি উৎস থেকে যেন সূর্যকিরণ এসে পড়ছে তার চোখে, অথচ পৃথিবীটা নিকষ কালো আর আকাশও রাতের মতো অন্ধকার, সূর্য-চন্দ্রবিহীন, তবুও।

আমার বুঝতে একটুও সমস্যা হয়নি যে তিনিই আমার মা। কেমন করে তা আমি নিজেও জানি না। তার গা ঘেঁষে থাকতাম, তার শরীরের উষ্ণতা নিতাম। আমাদের কুটির এমনিতেই বেশ ঠান্ডা। তার পরও শীতকালে বাবা আমার খড়ের পাটি ও বালিশ উত্তরমুখী ছোট্ট কামরায় পাচার করতেন। আর নিজে দখল করতেন উনুনের পাশে আমার উষ্ণ কোণটা। আর মা, পাশে থেকে আমাকে উষ্ণ রাখার বদলে, আমাকে একা ফেলে রেখে বাবার কাছে যেতেন তাঁকে উষ্ণ রাখতে। গরমকালে দেখতাম তিনি হাতে টিনের মগ নিয়ে বাবার পায়ের কাছে বসে ঠান্ডা পানি দিয়ে বাবার পা ধুইয়ে দিচ্ছেন।

আমি একটু বড় হতেই, বাবা পানিভরা টিনের মগ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে শিখিয়েছেন, কেমন করে পা ধুইয়ে দিতে হয়। তখন থেকে আমি মায়ের জায়গা নিয়ে নিই ও তিনি যা যা করতেন, সেসব করতে থাকি। মা তখন আর সেই মা নেই। এই মহিলা আমার হাতে বাড়ি মেরে টিনের মগ ছিনিয়ে নিতেন। বাবা বলতেন, তিনিই নাকি আমার মা। সত্যি বলতে, সেই একই লম্বা কুর্তা, একই চেহারা, একই রকম চালচলন কিন্তু তার চোখের দিকে তাকালে বুঝতে পারতাম, তিনি আমার সেই মা না। এই চোখ সেই চোখ না, যা আমার বিপদের সহায়। ঘন কালো দুটো বৃত্ত ঘিরে থাকা ধবধবে সাদা চক্র দুটো আর নেই। এই চোখে তাকালে কালো আরও মিশমিশে, আর সাদা আরও ধবধবে হয় না। সেই সঙ্গে অপার্থিব চন্দ্র-সূর্যের আলো আর এতে প্রতিফলিত হয় না।

মনে হতো, কোনো রকম আলোই এই নারীর চোখ কখনো স্পর্শ করে না। এমনকি দিনটি যখন আলোক উদ্ভাসিত ও সূর্যটাও দীপ্তিমান, তখনো না। একদিন আমি তার মাথা আমার দুই হাতে চেপে ধরে সূর্যের দিকে ফেরাই, যাতে সূর্যকিরণ সরাসরি তার মুখে পড়ে। কিন্তু চোখ দুটো তবু নিষ্প্রভ, দুটো নিভে যাওয়া বাতি যেন। আমি সারা রাত জেগে, মুখে কাপড় চেপে কাঁদি, যাতে ফোঁপানির শব্দে পাশে মেঝেতে শুয়ে থাকা ছোট ভাই-বোনদের ঘুম না ভাঙে। সবার মতো আমারও অনেক ভাই-বোন ছিল। ওরা মুরগি ছানার মতো, বসন্তে কয়েক গুণ বাড়ত, শীতে পালক খসে গিয়ে ঠান্ডায় কাঁপত, গ্রীষ্মে ডায়রিয়ার কবলে দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ত, আর একের পর এক কোনা-কানায় গিয়ে মরতে থাকত।

---

মেয়েসন্তান মারা গেলে বাবা রাতের খাবার খেতেন, মা তার পা ধুইয়ে দিতেন, তারপর তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন অন্য যেকোনো দিনের মতো। আর ছেলে সন্তান মরলে, মাকে মারধর করে, রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়তেন।

যা-ই ঘটুক না কেন, বাবার রাতের খাবার কখনো বাদ পড়ত না। বাড়িতে মাঝে মাঝে খাবার না থাকলে বাদবাকি সবাইকে উপোস থেকে বিছানায় যেতে হতো। কিন্তু তার খাবার বাদ যেত না। তার খাবারটুকু মা আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে উনুনের ফাঁকের গর্তে রেখে দিতেন। তিনি একা সেটি সাবাড় করতেন, আর আমরা সবাই চেয়ে চেয়ে দেখতাম। একদিন সন্ধ্যায় সাহস করে তার পাতের দিকে হাত বাড়ালে, আঙুলের পিঠে জোটে সজোরে এক চাটি।

আমি এত বেশি ক্ষুধার্ত ছিলাম যে, কান্নার শক্তিও ছিল না। সামনে বসে খাওয়া দেখছিলাম আর খেয়াল করছিলাম, তার আঙুল কীভাবে প্লেটে ডুবে খাবার তুলে নেয়, তারপর সেই খাবার আঙুলে চড়ে শূন্যে ভেসে কীভাবে মুখে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে যায়। তার মুখ উটের মতো। যেমন চওড়া চোয়াল, তেমনই বড় হাঁ। ওপরের চোয়াল সশব্দে নিচের চোয়ালে আছড়ে পড়ছিল ও খাবারের প্রতিটি কণা চিবিয়ে চূর্ণবিচূর্ণ করার সময় দাঁতে দাঁত ঘষার শব্দ পাচ্ছিলাম। জিবটাও যেন মুখের ভেতরে ক্রমাগত ঘুরে ঘুরে, চিবিয়ে, চর্বিত খাবারের অংশ গলায় ঠেলে দিচ্ছে, আর ক্ষণে ক্ষণে লকলকিয়ে বেরিয়ে এসে ঠোঁটে এমনকি চিবুকে লেগে থাকা খাবারের প্রতিটি কণাও ছোঁ মেরে তুলে নিচ্ছে।

খাবার শেষ হলে মা তাঁকে এক গ্লাস পানি এনে দিতেন। তিনি তা পান করে, পেটে জমে থাকা সব বায়ু এক বিশাল লম্বা ঢেকুর তুলে সশব্দে উগরে দিতেন। এরপর হুঁকা নিয়ে বসতেন। কামরাটি ঘন ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যেত। আর খুকখুক কাশি ও সর্দি ঝাড়ার ফাঁকে ফাঁকে চলত নাক-মুখ দিয়ে সজোরে ধোঁয়া টানা। হুঁকা টানা শেষে তিনি শুয়ে পড়তেন। মুহূর্তের মধ্যে তার নাক ডাকার বিকট শব্দে কুটিরটি কাঁপতে শুরু করত।

আমার মনে হতো, তিনি আমার বাবা না। কেউ যদিও এমনটি বলেনি, আর আমিও এমন কিছু জানতে পারিনি, তারপরও মনের গভীরে বারবার তা-ই মনে হতো। কথাটা কাউকে বলিনি, নিজের কাছেই রেখেছি। প্রতিবার গ্রীষ্মের ছুটিতে চাচা বাড়ি এলে, যাওয়ার সময় তার গালাবিয়ার কোনা ধরে ঝুলে পড়তাম। আর আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার আবদার জুড়তাম। বাবার চেয়ে চাচা ছিলেন বেশি আপন। তিনি অত বয়স্ক নন। আমাকে পাশে বসে তার বইপত্র দেখতে দিতেন। তার কাছেই বর্ণমালা শেখা। বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি আমাকে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেন। পরে মাও মারা গেলে আমাকে কায়রো নিয়ে যান।

___

মাঝে মাঝে ভাবতাম, মানুষ দুবার জন্মাতে পারে কি! চাচার বাসায় ঢুকে একটি সুইচে হাত পড়তেই কামরাটি আলোর বন্যায় ভেসে যায়। তীব্র আলোয় আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি ও আর্তনাদ করে উঠি। চোখের পাতা খুলতেই মনে হয়, এই চোখ দিয়ে যেন দুনিয়াদারি প্রথম দেখছি। যেন আমার মাত্রই জন্ম হলো। কিংবা বলা যেতে পারে দ্বিতীয় জন্ম। কারণ আমি তো কয়েক বছর আগেই জন্মেছি। আয়নায় এক পলক নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকাই। এই অভিজ্ঞতাও আমার জন্য নতুন। এটি যে একটি আয়না, তা প্রথমে বুঝতে পারি না। কেবল হাঁটু পর্যন্ত ফ্রক, আর পা-ঢাকা জুতো পরা একটি ছোট মেয়েকে এর মধ্যে দেখে আঁতকে উঠি। কামরার চারদিকে তাকাই। সেখানে আমি একা। মাথায় আসছিল না, মেয়েটি কোত্থেকে উদয় হলো। তখনো বুঝিনি, মেয়েটি যে আমি। কারণ আমি ঘরে-বাইরে সব সময় মাটিতে লুটানো গালাবিয়া পরতাম, আর পাও থাকত খালি। তবুও সঙ্গে সঙ্গেই নিজের চেহারা চিনতে পারছিলাম। অবশ্য আয়নায় তো কখনো নিজেকে দেখিনি, তাহলে কেমন করে এতটা নিশ্চিত হলাম যে এটি আমারই মুখ? তবে কামরাটি খালি, আর আলমারির আয়না একদম আমার মুখোমুখি। কাজেই, আয়নার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই মেয়েটি আমি ছাড়া আর কে-ই বা হবে। এই জামা ও জুতা জোড়া স্কুলে পরার জন্য চাচা কিনে দিয়েছিলেন।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি। আমি কে? আমি ফেরদৌস। অন্তত এ নামেই আমাকে সবাই চেনে। আমার এই বিশাল, গোল নাকটি বাবার, আর পাতলা ঠোঁট মার থেকে পাওয়া।

অশুভ একটা কিছুর ইঙ্গিত পাই যেন। না ভালো লাগে নিজের নাক, না ঠোঁট। ভেবেছিলাম বাবা মরে গেছেন কিন্তু এই বিশাল, কুৎসিত, গোল নাকের মধ্যে তিনি দেখি দিব্যি বেঁচে। মাও তা-ই। মরে গিয়েও এই পাতলা ঠোঁটের মধ্যে জীবন্ত। আর এখানে আমি সেই একই ফেরদৌস, তবে এখন দামি ফ্রক গায়ে, জুতো পায়ে।

আয়নার প্রতি তীব্র ঘৃণা অনুভব করি। ওই মুহূর্ত থেকে আর কখনো আয়নার দিকে তাকাইনি। এমনকি এর সামনে দাঁড়ালেও, চেহারার দিকে না তাকিয়ে শুধু চুল আঁচড়াতাম, মুখ মুছতাম বা জামার কলার ঠিক করতাম। তারপর বইয়ের ঝোলা তুলে নিয়ে স্কুলে ছুট লাগাতাম। (চলবে)

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে  ক্লিক করুন...