কালো আর ধলো বাইরে কেবল

‘কায়েতের ছেলের সঙ্গে সাপুড়ের মেয়ের নিকা—এ তো একটা হাসিয়া উড়াইবার কথা! কিন্তু কাল হইলো ঐ যে ভাত খাইয়া! হোক না সে আড়াই মাসের রুগী, হোক না সে শয্যাশায়ী! কিন্তু তাই বলিয়া ভাত। লুচি নয়, সন্দেশ নয়, পাঁঠার মাংস নয়। ভাত খাওয়া যে অন্ন-পাপ। সে তো আর সত্য সত্যই মাপ করা যায় না। অন্ন-পাপ! বাপরে! এর কি আর প্রায়শ্চিত্ত আছে। বিলাসীর আত্মহত্যার ব্যাপারটাও অনেকের কাছে পরিহাসের বিষয় হইল!’—বিলাসী: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

সেই যুগের বর্ণবিদ্বেষ, জাত, নিচু জাত, উঁচু জাত, হিন্দু-মুসলিম ছোঁয়াছুঁয়ি, কাটাকাটি থেকে ভারত-পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। রাজনৈতিক অন্য কারণ তো ছিলই। তবে এই বর্ণবাদ, ঘৃণা, হানাহানি সেই বিদ্বেষের আগুনে বারুদ ঢেলে দিয়েছিল। সে সবাই জানি, দেশ ভাগের ঘটনা। এই আজকের দিনেও আমরা টিভি ও পত্রপত্রিকা খুললে এই হিন্দু-মুসলিম মারামারি কাটাকাটি আবার দেখতে পাই। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে আবার যুদ্ধ-যুদ্ধ উত্তাপ ফিরে ফিরে আসছে।

কিন্তু উপমহাদেশের ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ছেলেমেয়েগুলো যখন দেশের বাইরে আসে সীমান্ত পেরিয়ে, তখন টিভি ও পত্রিকার দৃশ্যগুলো রূপকথার গল্পের মতো লাগে দেখতে। এই কিছুদিন আগের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ-যুদ্ধ মনোভাবের সময় খাবার টেবিলে দেখেছি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি একসঙ্গে বসে টিভি দেখছে চোখ বড় বড় করে। এদের কেউ-ই কিন্তু যুদ্ধ চায় না।

পাকিস্তানিদের সঙ্গে ভারতীয়রাও মোদি সরকারের চরম নীতির সমালোচনা করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিল বলে রাজনৈতিকভাবে ভারত-বাংলাদেশ বন্ধু দেশ আর ভারত-পাকিস্তান চিরশত্রু হলেও হয়তো খুব অদ্ভুত শোনাবে। কিন্তু সত্যি হলো, দেশের বাইরে ভাষার কারণে এই ভারত-পাকিস্তান বন্ধুত্ব খুবই বেশি চোখে পড়ে।

আমাদের ক্লাসে এক ভারতীয় ছেলেকে দেখেছি। তার নাম আলিম। সে হয়তো ধর্মীয় কারণে সব সময় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানিদের সঙ্গে থাকত! নামাজে যাওয়া, হালাল রান্না খাওয়া সব একসঙ্গে। হঠাৎ করে ভারতীয়দেরও অবশ্য বিভ্রম হতো। তাকে ভারতীয় হিসেবে নতুন অনেকে বুঝতেও পারত না!

ভারতীয়রা যে ধর্মেরই হোক বা যে প্রদেশেরই হোক, ছেলেমেয়ে-নির্বিশেষে সবাই দেশের বাইরে আসার সময় লাগেজে দু-একটি করে প্রেশার কুকার নিয়ে আসে। এর সুবিধা হলো, রান্না করতে সময় কম লাগে। তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করে বেড়াতে যাও বা পড়াশোনা করো বা আড্ডা দাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এরা রান্নাঘরে নিজেদের আটকে রাখতে নারাজ।

আর ভারতে বেশির ভাগ বাড়িতে গ্যাসের সিলিন্ডার কিনে ব্যবহার করতে হয়। বাংলাদেশের মতো গ্যাসের লাইন নেই। সিলিন্ডারের গ্যাসের দাম সবার জন্য সমান। আমাদের বাংলাদেশে কেউ বেশি দামে গ্যাস পায় সিলিন্ডারে আবার কেউ চুলা জ্বালিয়ে রেখে কাপড় শুকোলেও একই বিল মাসের শেষে, যতই সে অপচয় করুক। এ রকম বৈষম্য বা অপচয় রোধে সিলিন্ডারে গ্যাস অন্তত কিছুটা বৈষম্য কমাতে পারে। পাশাপাশি সবাই কিছুটা হিসাব করে ব্যবহার করত। এতে অপচয় কমত। আর এ কারণেও ভারতীয়রা প্রেশার কুকারে রান্না করে অভ্যস্ত।

আর পাকিস্তানিরা সাধারণত স্লো কুকিং পছন্দ করে। আস্তে আস্তে ঘণ্টাব্যাপী রান্না করবে। সময় যতই লাগুক রান্নার স্বাদের সঙ্গে কোনো কম্প্রোমাইজ হবে না।

যা হোক, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে একজন খুব আনাড়ি ও ব্যতিক্রমী পাকিস্তানি ছেলে এসেছে। সে তেমন রান্না পারে না। তার কাছের বন্ধু আবার ভারতীয় হিন্দু ব্রাহ্মণ। এরা সারা দিন পড়াশোনা করে একসঙ্গে। রান্নার ধারেকাছে নেই। ওদের হোস্টেলে একটা ভারতীয় মেয়ে এসেছে। হিন্দু। অন্ধ্র প্রদেশের। এই মেয়ের কাছেই শোনা, নিচু জাত বলে ওদের এলাকায় গ্রামের বাড়িতে টয়লেট বানানোর রীতি নেই।

মেয়েটার মা-বাবা দুজনেই ছোটখাটো চাকরি করতে শহরে এসেছিল। সেই সুবাদে ওরা প্রথম ভাড়াবাড়িতে টয়লেট ব্যবহার করেছিল। মেয়েটা খুবই ভালো আর সহজ-সরল। সবাই তাকে খুব পছন্দ করে। সে নিজে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার আর তার স্বামী মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তার স্বামী একটা জার্মান কোম্পানিতে চাকরি করত বলেই তাদের প্রথম জার্মানিতে পড়তে আসার আগ্রহ জন্মে।

তাদের বাড়িতে টয়লেট না থাকলেও ভারত সরকার তাদের ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার জন্য বৃত্তি দিয়েছে। যখন ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তিতে চান্স পেয়েছে, বাংলাদেশের গরিব মেধাবীদের মতো ওদের ভর্তির টাকা নেই বলতে হয়নি। সরকার মাসে মাসে সাত-আট হাজার রুপি বৃত্তি দিয়েছে। এরপর যখন জার্মানিতে পড়তে আসবে, তখন অ্যাডমিশন লেটার দেখানোর ২০ দিনের মাথায় ৮ হাজার ইউরো শিক্ষা লোন দিয়ে দিয়েছে। এখন তার স্বামী আসবে স্পাউস ভিসায়। এসে এখানে চাকরি খুঁজবে। তাকেও সরকার সেই অল্প সুদে ৮ হাজার ইউরো লোন দিয়ে দেবে।

আমরা বাংলাদেশিরা তার এই শিক্ষা লোনের তথ্য শুনে সত্যি মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছি। দিল্লি বহু দূরে বাংলাদেশের গরিব মেধাবীদের জন্য। এখনো এই সব আকাশকুসুম স্বপ্ন! ছাত্রাবস্থায় স্পাউস নিয়ে আসার যে খরচ সেটা মধ্যবিত্তের নাগালের এতই বাইরে যে উচ্চবিত্তরা ছাড়া বউ আনার কথা কেউ সহজে কল্পনা করেন না।

এদের প্রায়ই দেখি খাবার টেবিলে কম্পিউটার নিয়ে একসঙ্গে পড়াশোনা করছে। মেয়েটার নাম কাবেরি। জার্মান পারে না। পাকিস্তানি ছেলেটাকে দেখলাম মেয়েটা কীভাবে চাকরি খুঁজবে, কীভাবে অ্যাপ্লিকেশন বানাবে, কীভাবে জার্মান ভাষায় লিখবে সব গুছিয়ে রেডি করে দিচ্ছে। সেদিন দেখি দুজন একটা প্রজেক্টে কাজ করছে নাক মুখ ডুবিয়ে। রান্না-খাওয়ার সময় নেই। ওদের সঙ্গে যোগ হয়েছে ওই হিন্দু ব্রাহ্মণ। সে আবার ভেজিটেরিয়ান।

একদিন কাবেরি মেয়েটা চাল ধুয়ে প্রেশার কুকারে চড়াবে। তখনই পাকিস্তানি ছেলেটার প্রতিবাদ। কারণ ওরা প্রেশার কুকারের রান্না ভাত আবার পছন্দ করে না। একসঙ্গে লেগে থাকে বলে।

সেই নিয়ে কাবেরির সঙ্গে পাকিস্তানি ছেলেটার একদফা ঝগড়াও হলো। কেন প্রেশার কুকারে চাল দাও। পানি বেশি দিয়ে বিরিয়ানির মতো করে দিলেই তো বাসমতী চালের ভাত ঝরঝরে হবে।

কাবেরি বলল, প্রেশার কুকারে রান্না তাড়াতাড়ি হবে।

পাকিস্তানি বলল, এই তাড়াতাড়ি রান্না করে সময় বাঁচিয়ে সেই সময় তুমি কী করবে?

কাবেরি বলল, কত কী! গল্প, আড্ডা, বেড়ানো, পুজো ও দুটো চাকরির অ্যাপ্লিকেশন।

শেষমেশ ছেলেটা বলল, তোমার পাতিলে আমাদের জন্য দুই কাপ চাল ব্যাগ থেকে নিয়ে বসিয়ে দাও তো!

মেয়েটা পাকিস্তানি ছেলে আর ওই হিন্দু ব্রাহ্মণ ছেলের চালের ব্যাগ থেকে চাল নিয়ে পানিতে ধুয়ে নিল। আমি শুরুতে ভেবেছিলাম ভারতীয় আর পাকিস্তানি বাসমতী চালগুলো হয়তো একসঙ্গে মিশবে না, দুরকম চাল।

কিন্তু না চালগুলো খুব ভালোভাবেই মিশে গেল। চালগুলোকে ভারতীয়, পাকিস্তানি, উঁচু জাত-নিচু জাত কিছুই আলাদা করা গেল না। সত্যি চালগুলো এক সঙ্গেই রান্না হলো। হিন্দু ব্রাহ্মণ ভারতীয় আর পাকিস্তানি মুসলিমের চাল সেই কালো নিচু জাতের মেয়েটার এক হাঁড়িতে।

‘কালো আর ধলো বাইরে কেবল, ভেতরে সবারই সমান রাঙা!’