পরিবার, পরিবেশ ও শিক্ষা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

শুরুতেই বলে রাখা ভালো, এখানে শিক্ষা বলতে আমি একাডেমিক শিক্ষাকে বোঝাচ্ছি। অর্থাৎ একজন মানুষের পড়ালেখা, ভালো ফলাফল এগুলোর সঙ্গে তার পরিবার বা জিনগত বৈশিষ্ট্য, তার বেড়ে ওঠা এগুলোর কোনো সম্পর্ক আছে কি না, সেটাই এই লেখার বিষয়। আমি এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নই। তবে মানুষের জীবন দেখতে আমার ভালো লাগে। আর সেই দেখা থেকেই এই চিন্তাগুলোর উদ্রেক।

আমার সঙ্গে দুজন কোরীয় নারীর আলাপ আছে। এই দুজনই জন্মসূত্রে কোরীয়। কিন্তু খুব ছোটবেলায় তাঁদের আলাদাভাবে দুটি আমেরিকান পরিবার দত্তক নেয়। এই দুজনই আমাকে বলেছেন, তাঁদের আমেরিকান পরিবার পড়ালেখার ব্যাপারে খুবই উদাসীন ছিল। মা–বাবা কখনোই তাঁদের পড়ালেখার কোনো খোঁজখবর রাখতেন না। কোনো রকম উৎসাহ বা সহযোগিতা তাঁরা পাননি।

উপরন্তু একজনের মা তাঁকে ছোটবেলা থেকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, তিনি যেন একজন প্রতিষ্ঠিত ছেলেকে বিয়ে করেন। সে–ই তাঁর ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবেন। এমনকি মেয়েটিকে ১৬ বছর বয়সে তাঁর মা প্লাস্টিক সার্জারি করার বুদ্ধিও দিয়েছিলেন।

কিন্তু এই দুজনই তাঁদের পারিবারিক চিন্তাভাবনার সম্পূর্ণ বাইরে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই ভালোবেসেছেন এবং জীবনে সেভাবেই এগিয়েছেন একা একা। অবশেষে দুজনই উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁরা জীবনসঙ্গীও বেছে নিয়েছেন সেভাবেই।

তবে একটি কথা এ ক্ষেত্রে সত্য, পড়ালেখার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উৎসাহ না পেলেও তাঁরা কোনো বাধা পাননি এবং ন্যূনতম পরিবেশ বা ব্যবস্থা সেখানে ছিল। তাঁদের কেউ কম বয়সে জোর করে বিয়ে করতে বাধ্য করেনি বা পড়তে চাইলে এঁদের জন্য স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির ব্যবস্থা ছিল। রাষ্ট্রীয় ঋণের ব্যবস্থাও ছিল। হয়তোবা এঁদের জিন এঁদের ভেতরের ইচ্ছাটাকে তৈরি করেছে।

আমেরিকাতে পড়ালেখায় সিরিয়াস আমেরিকান মা–বাবা খুব কমই দেখেছি। যেসব বাবা-মাকে সিরিয়াস দেখি তাঁদের মধ্যে এশিয়ান বাবা-মায়েরাই বেশি। চায়নিজ, ভারতীয় মা–বাবারা প্রচণ্ড সিরিয়াস। তাঁদের সিরিয়াসনেসের মাত্রা অকল্পনীয়। জীবনকে মাপার তাঁদের একমাত্র মাপকাঠি হলো প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য। যার একটি পূর্বশর্ত হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ভালো ফলাফল ও উচ্চ ডিগ্রি।

এসব দেশে যেখানে পড়ালেখার ভালো সুযোগ-সুবিধা আছে স্কুলেই এবং মা–বাবারাও যথেষ্ট উচ্চশিক্ষিত, সেখানেও তাঁরা বাচ্চাদের কোচিং, প্রাইভেট টিউটর সবকিছুই করেন। এই বাচ্চাগুলো শৈশব থেকেই আনন্দ মানে বোঝে দাবা খেলা, ম্যাচ কমপিটিশনে যাওয়া, সায়েন্স কুইজে অংশগ্রহণ করা।

এদের দেখাদেখি বাঙালি বাবা-মায়েরাও খুব একটা পিছিয়ে নেই। এভাবে জীবনপাত করে যেসব পরিবারে বাচ্চার লেখাপড়ায় ভালো ফলাফলের চেষ্টা করা হয়, সেখানে বাচ্চা যদি নিজেও আগ্রহী হয়, পরিশ্রমী হয়, তাহলে তারা স্বাভাবিকের তুলনায় ভালো ফলাফল করে, এ কথা অনস্বীকার্য।

কিন্তু এখানে মূল চাবিকাঠি বাচ্চার আগ্রহ ও পরিশ্রম করার ক্ষমতা। যেটা অনেক বাবা-মায়েরাই বুঝতে চান না একেবারে। তাঁদের চিন্তাভাবনাটা অনেকটা এ রকম, যেন বাচ্চারা একেকটা মেশিন। ঠিক যে পরিমাণ কাঁচামাল দেওয়া হবে, সে পরিমাণ উৎপাদন হবে। কিন্তু মানুষ আসলে মেশিন নয়, সেটা বাচ্চাই হোক আর বুড়োই হোক। এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব।

শিশুর জীবনকে দুরূহ করে তুলে জীবনের অন্য সব দিকগুলোকে তুচ্ছ করে শুধু একাডেমিক ফলাফলের দিকে মনোযোগ দেওয়ার অনেক অনেক খারাপ দিক আছে। সে আলোচনা না করলেও অন্তত এটা বলা যায়, একসময় এসে এই বাচ্চাগুলো মুখথুবড়ে পড়ে।

বাচ্চারা একটু বড় হয়ে গেলে তারপরে আর মা–বাবার পক্ষে তাদের পেছনে লেগে থাকা সম্ভব হয় না। তারা কথা শোনে না। তাদের যে জিনিসে আগ্রহ, স্বাধীনতা পেয়ে সে জিনিসগুলোর পেছনে তারা তখন সময় কাটায়। জীবন সম্পর্কে ব্যালান্সড ধারণা না থাকার কারণে তারা বুঝতেই পারে না, জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ বা নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা কতখানি জরুরি।

আমাদের মা–বাবাদের জেনারেশনের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাব, তাঁদের মা–বাবারা অনেকেই স্বল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত ছিলেন। তাঁদের অনেকগুলো সন্তান ছিল। প্রতিটি সন্তানের পড়ালেখার পেছনে আলাদা করে সময় দেওয়ার মতো সুযোগ, সময় এমনকি ধারণাও তাঁদের ছিল না। তবে তাঁরা অনেকেই সফলভাবে তাঁদের ছেলেমেয়েকে পড়ালেখা শেখার প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়েছেন একেকজন একেকভাবে।

আমার নানি একজন অশিক্ষিত নারী ছিলেন। কখনো স্কুলে যাননি। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে তাঁর মনে ক্ষোভ থেকে যায়। লুকিয়ে তাঁর বড় ভাইয়ের কাছ থেকে অক্ষরজ্ঞান ও চিঠি লেখা শেখেন। তিনি তাঁর চার মেয়েকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষা না দিয়ে কাউকে তিনি বিয়ে দেবেন না। শুধু এই অনুপ্রেরণা থেকে তাঁর সাত সন্তান যার মধ্যে চারটি কন্যাসন্তান, ষাটের দশক ও সত্তর দশকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ গণ্ডি পেরিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন।

অনেকেই হয়তো বলবেন, সে সময়ে কমপিটিশন কম ছিল। কথা সত্য। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমপিটিশন বেড়েছে। শুধু বাংলাদেশে না, সারা পৃথিবীতে। সেই সঙ্গে হয়তো পরিবার ও পরিবেশকেও কিছুটা বদলাতে হবে শিশুর শিক্ষার জন্য।

সেই বদলানোর ধরনটা কেমন হওয়া দরকার? লেখার শুরুতেই যে দুজন কোরীয় নারীর কথা বলেছি, তাঁদের মা–বাবার মতো একেবারেই উদাসীন হয়ে, শুধু পড়ালেখার খরচ দিয়ে বসে থাকব? অবশ্যই না। এটা ব্যতিক্রম।

এই ব্যতিক্রমটা সম্ভব হয়েছে দুটো কারণে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা দুজনই খুব বাস্তববাদী। তাঁরা তাঁদের আমেরিকান মা–বাবার কাছ থেকে এই শিক্ষাটুকু পেয়েছেন যে, জীবনে টিকে থাকতে হলে কষ্ট করতে হবে। তুমি যেটায় ভালো সেটা নিয়ে লেগে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাঁরা দুজনই দেখেছেন তাঁরা পড়ালেখায় ভালো। সুতরাং সেই ক্ষেত্রটাই তাঁরা বেছে নিয়েছেন।

দ্বিতীয়টি হলো, এটা আমেরিকা। যেখানে অনুন্নত দেশগুলোর তুলনায় মাঝারি মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সহজ। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে বাচ্চাদের পড়ালেখায় সাফল্য চাইলে মা–বাবাকে সচেতন হতে হবে।

কীভাবে সচেতন হতে হবে? তাদের মধ্যে পড়ালেখা সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের গবেষণাধর্মী লেখা থেকে আমার মনে হয়েছে, বিষয়ভিত্তিক আগ্রহ তৈরি করতে পারলে সবচেয়ে ভালো। অর্থাৎ কোন বাচ্চা অঙ্ক করতে ভালোবাসলে তাকে আরও বেশি অঙ্ক করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। কেউ লিখতে ভালোবাসলে তাকে আরও লেখালেখি করার উৎসাহ দেওয়া। এ রকম।

কিন্তু কোনো অবস্থাতেই একদম শিশুকালে কমপিটিশন জিনিসটা মাথার মধ্যে ঢোকানো উচিত না। ওটার জন্য সারা জীবন পড়ে আছে। অনেক বাচ্চাই কমপিটিশনের প্রেশার নিতে পারে না। অনেকে হীনম্মন্যতায় ভোগে। আত্মবিশ্বাস হারায়।

আমেরিকান শিক্ষাব্যবস্থার এই দিকটা খুব ভালো। এরা ছোটবেলায় কোনো ধরনের ফার্স্ট–সেকেন্ড ফলাফল দেয় না। বরং বাচ্চাদের এসব নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে তারা বিরক্ত হয়। তবে কি কমপিটিশন শেখানোর দরকার নেই একেবারেই? আমার মতে নেই। ওটা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনা-আপনি শিখে নেয়।

শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তৈরির ব্যাপারে আরও দু–চারটা কথা বলতে চাই। শুধু বিষয়ভিত্তিক আগ্রহ ছাড়া আরও কিছু বিষয় আছে। খুব ছোটবেলা থেকে শিশুকে শিক্ষার মূল্য ও প্রয়োজনীয়তা বোঝান। শিক্ষা, ভালো ফলাফল, এগুলো আপনার জন্য কতখানি মূল্যবান বোঝান। আপনি যদি আপনার সন্তানকে ভালোবাসেন, সে আপনাকে ভালোবাসবে। আপনার ভালোবাসাকে ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করবে। সেই চেষ্টার অংশ হবে আপনাকে খুশি করা, আপনার পছন্দ, ভালো লাগাকে গুরুত্ব দেওয়া।

শিশুরাও তাদের মা–বাবাকে গর্বিত করতে চায়। তাকে বোঝান শিক্ষা ছাড়া জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, অর্থ, সম্মান যেকোনো কিছু পাওয়া খুব কঠিন। ভালো ফলাফলের জন্য বা এমনকি কিছু শেখার জন্য তাকে পুরস্কৃত করুন। উৎসাহ দিয়ে কথা বলুন। তার চিন্তায় এই বীজ বপন করুন যে, ভালো ফলাফল বা কোনো কিছু শেখা তার সম্মান বাড়াবে। তাকে সবাই বেশি মূল্যবান ভাববে। বিশেষ করে মা–বাবা।

আর একটা ব্যাপার খুব জরুরি। সেটা হলো বাচ্চাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ গড়ে তোলা। নিজেদের পড়ালেখাকে যেন নিজেদের দায়িত্ব মনে করে। নিজের অর্জন নিয়ে সে যেন গর্বিত হয়। যদি ছোটবেলা থেকে তারা দায়িত্বশীল হয়ে গড়ে ওঠে, তাহলে নিজের হোমওয়ার্ক, পরীক্ষার প্রস্তুতি নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই করবে। মা–বাবা বিশ্বাস করে তাদের অল্প অল্প দায়িত্ব না দিলে তারা কখনোই দায়িত্বশীল হবে না।

শিশুদের দিয়ে কিছু করাতে হলে নিজেকে তার রোল মডেল হতে হয়। আপনার সন্তান যদি দেখে আপনি পরিশ্রমী, দায়িত্বশীল, স্নেহপরায়ণ, শিক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবেন, তাহলে তারাও একইভাবে গড়ে উঠবে।