মেলবোর্নে বাংলার লেখক সেলিনা হোসেন

মেলবোর্নে বাংলার লেখক সেলিনা হোসেন
মেলবোর্নে বাংলার লেখক সেলিনা হোসেন

মেলবোর্নে হয়ে গেল বাংলাদেশ থেকে আসা লেখক সেলিনা হোসেনের সঙ্গে এক মনোজ্ঞ সাহিত্য আলোচনা। গত শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) মেলবোর্নের বাংলা সাহিত্য সংসদের উদ্যোগে আয়োজিত এ সাহিত্য আলোচনায় যেমন দর্শক আশা করা যায় তেমনটাই হয়েছিল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেও আগ্রহী সাহিত্যপ্রেমীরা ছোট ছোট সন্তানকে সঙ্গে নিয়েই উপস্থিত হয়েছিলেন।

বাংলাভাষী পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাস করুক না কেন, তার যদি সামান্য পড়ার অভ্যাস বা তাগিদ থাকে, তাহলে সেলিনা হোসেন অবশ্যই তার পরিচিত একটি নাম। বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষায় শক্তিমান লেখকদের সারিতে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। পৈতৃক সূত্রে লেখিকার বাড়ি বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলায়। তবে রাজশাহীতে তাঁর জন্ম ১৪ জুন, ১৯৪৭।

বাবার কর্মসূত্রে বগুড়া ও রাজশাহী অঞ্চলে কেটেছে সেলিনা হোসেনের জীবনের অনেকটা সময়। পড়াশোনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলাদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ সম্মানিত পুরস্কারে ভূষিত লেখিকা। একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, গত বছরে অর্থাৎ ২০১৮ সালে পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক। তবে অনেক কম বয়সে যখন উচ্চমাধ্যমিকে অধ্যয়নরত, জেলাভিত্তিক প্রতিযোগিতায় ছোটগল্প লিখে স্বর্ণপদক অর্জন করেন। তবে তাঁর প্রাপ্ত পুরস্কার ও পদকতালিকা বিশাল।

সেলিনা হোসেন সম্পর্কে অনেক তথ্য গ্রন্থিত আছে বিভিন্ন মাধ্যমে। বইপত্র, নানা সাময়িকী, ইউটিউব, টিভি সাক্ষাৎকার—সবখানে একটু চোখ বোলালেই পাওয়া যাবে লেখিকাকে। ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ২০১০ সালে সাহিত্য ডক্টরেট (অনারারি) ডিগ্রি দিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও ডক্টরেট (অনারারি) ডিগ্রিতে ভূষিত করেছে লেখিকাকে।

আজীবন লিখেছেন বাংলায়। তবে অনেক বিদেশি ভাষায়ও লেখকের সৃষ্টিকর্ম অনূদিত হয়ে পঠিত হচ্ছে আজ।

লেখিকার সৃষ্টিকর্ম থেকে সিনেমা ও নাটক ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে বিভিন্ন লেখকের উল্লেখযোগ্য যত লেখা রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। এই উপন্যাসের ভিত্তিতে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তাঁর লেখা ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ উপন্যাসটিও সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত হয়ে চলচ্চিত্রে রূপ পেয়েছে।

‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে আমেরিকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যতালিকাভুক্ত হয়েছে। ভারতের ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখিকার উপন্যাস পাঠ্যতালিকায় রয়েছে। সুতরাং উল্লেখ্য অপ্রয়োজন যে শুধু বাংলা ভাষায় নয়, অন্যান্য ভাষায়ও পঠিত হচ্ছে তাঁর সৃষ্টিকর্ম।

এই সুদূর প্রবাসেও অনুষ্ঠানে লেখককে তাঁর ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ সম্পর্কে প্রশ্ন করেন একজন পাঠক। তার অর্থ হচ্ছে, দেশের বাইরেও পাঠকেরা তাঁর গল্প-উপন্যাস পড়েন।

সেলিনা হোসেন অনেক লিখেছেন। যা আমার মতো পাঠককে ভাবায় যে এত এত লেখার সময় কীভাবে পেলেন। সারা জীবন তো নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু লেখা থেকে বিরত হননি কখনো।

বহুদিন আগে কথা প্রসঙ্গে এই প্রশ্নটি করেছিলাম লেখিকাকে। নম্র কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমার স্বামী বলেন রান্না তো কাজের বুয়াও করতে পারে’। কী সুন্দর! একটিমাত্র বাক্যে তাঁর একান্ত আপনজনের সহযোগিতার বিষয়টি ব্যক্ত করলেন।

দিলরুবা শাহানা
দিলরুবা শাহানা

এ প্রসঙ্গে দুটি ঘটনা উল্লেখ যুক্তিযুক্ত হবে। একটি ঘটনা সেলিনা হোসেনের মুখ থেকেই এবার শোনা। বাংলাদেশে একটি মেয়ে ব্যাংকে কর্মরত। স্বামী-সংসার-সন্তান, কর্মজীবন সবই আছে, তবু শখ হলো লেখালেখি করার। লেখেনও মেয়েটি কিছু কিছু। একদিন তিনি সেলিনা হোসেনকে আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, কাগজ-কলম নিয়ে বসলেই তাঁর স্বামী বিরক্তি ঝাড়েন। এ কথা থেকে একটি ব্যাপার বেরিয়ে এসেছে, সব মেয়ের লেখালেখির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশের জন্য পরিবেশ এখনো অনুকূল নয়। তখন মনে হলো, স্ত্রীর সৃজনশীল কাজে সেলিনা হোসেনের স্বামীর সহযোগিতার জন্য তাঁর একটি হাততালি প্রাপ্য।

এরপর যে ঘটনা, তাও একজন পেশাজীবী নারীর স্বামীর তাঁর স্ত্রীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির কথা। ভদ্রমহিলা পেশায় ডাক্তার। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে এসেছেন। ব্যস্ত ভীষণ। নিজস্ব প্র্যাকটিস। ভদ্রমহিলা রোগী দেখা নিয়ে বড়ই ব্যস্ত যখন, তাঁর চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট স্বামী তখন ক্লিনিকের রিসেপশন, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে অ্যাকাউন্টস—সবকিছুর দেখভাল করতে ব্যস্ত থাকেন। একদিন শেষবেলায় সামান্য হঠাৎ উদয় হওয়া বিরক্তিকর এক অ্যালার্জির কারণে ডাক্তারের চেম্বারে হাজির হয়েছি। বেশ ভালো পরিচিত বলে আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই ডাক্তার ভদ্রমহিলা শেষবেলাতেও আমাকে দেখতে রাজি হলেন। পৌঁছানোর পর রিসেপশনে বসা ডাক্তারের স্বামীর ত্যক্তবিরক্ত চেহারা দেখে থতমত খেলাম। ভদ্রলোক আপনমনে গজগজ করছিলেন, রোগী আসার আর সময় পায় না। কখন কাজ শেষ করে তাঁর বউ গিয়ে রান্না করবেন আর কখনোই-বা তিনি খাবেন।

আমি বিব্রত অবশ্যই। তারও চেয়ে বেশি বিরক্ত ডাক্তারের স্বামীর মনোবৃত্তি দেখে। ডাক্তারি একটি ব্যবসা নয়, একটি মানবিক পেশা। তাই সময়সীমার বাইরেও তাকে রোগী দেখতে হয়। কর্মক্লান্ত ডাক্তার স্ত্রীর শ্রান্তি মোচন জরুরি নয়, জরুরি হলো স্বামীর জন্য খাওয়া তৈরি। এবারও মনে হলো, সেলিনা হোসেনের জীবনসঙ্গী আনোয়ার হোসেন একজন সহমর্মী মানুষ ও স্ত্রীর কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি। এমন মানুষ যাঁরা তাঁরা হাততালি পেতেই পারেন।

সেলিনা হোসেন নারীবিষয়ক ইস্যুতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, গণমানুষের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি। তাঁর কাজ সুচারুভাবে এগিয়ে চলুক, এই প্রার্থনা।