টোকিওতে দুর্গাপূজা উদ্যাপন

সমবেত পূজারিদের একাংশ। ছবি: তপন পালের মাধ্যমে প্রাপ্ত
সমবেত পূজারিদের একাংশ। ছবি: তপন পালের মাধ্যমে প্রাপ্ত

উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে জাপানের রাজধানী টোকিওতে উদ্‌যাপিত হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। গতকাল রোববার (৬ অক্টোবর) টোকিওর তাকিনোগাওয়া কাইকানে স্থাপিত অস্থায়ী মণ্ডপে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

প্রবাসে ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজনে সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও দেশটিতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশি হিন্দুদের সংগঠন সর্বজনীন পূজা কমিটি জাপান প্রতিবছর টোকিওতে এই পূজার আয়োজন করে থাকে। টোকিওতে এ পূজা ছিল এই সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত ২৪তম দুর্গাপূজা।

সকালের দিকে টোকিও এলাকায় আবহাওয়া খারাপ থাকায় দুপুরের পর দূরদূরান্ত থেকে পূজারিরা পূজার মণ্ডপে এসে সমবেত হতে শুরু করেন। এর আগে পূজার স্বেচ্ছাসেবকেরা এসে অস্থায়ী মণ্ডপ স্থাপন করাসহ পূজার হল ও পূজার উপকরণ তৈরি এবং পূজার প্রসাদ প্যাকেট করার কাজ সম্পন্ন করেন। এরপর একে একে পূজারিরা হলে আসতে থাকেন।

সমবেত পূজারিদের একাংশ। ছবি: তপন পালের মাধ্যমে প্রাপ্ত
সমবেত পূজারিদের একাংশ। ছবি: তপন পালের মাধ্যমে প্রাপ্ত

সকালের দিকে একপর্যায়ে পূজার মণ্ডপে এসে হাজির হন দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা। তিনি ঘুরে ঘুরে পূজার বিভিন্ন প্রস্তুতি দেখেন। কীভাবে স্বেচ্ছাসেবকেরা এগুলো করছেন ও কেন করছেন, তার খোঁজখবর নেন। অন্য অনুষ্ঠানে যোগদানের কর্মসূচি থাকায় তিনি কিছুক্ষণ থেকে প্রবাসী হিন্দুধর্মাবলম্বীদের পূজার শুভেচ্ছা জানিয়ে পূজার মণ্ডপ ত্যাগ করেন।

এবার প্রায় পাঁচ শ পূজারি দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গার চরণে অঞ্জলি দেওয়ার জন্য ছুটে এসেছিলেন। একবারে সবার অঞ্জলি দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে দুবার মায়ের চরণে অঞ্জলি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। পূজায় পৌরোহিত্য করেন অমিতাভ ভট্টাচার্য।

প্রতিবছরের মতো এবারও হিন্দুধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি ও জাপানি উপস্থিত ছিলেন আবহমান বাংলা ও বাঙালি ঐতিহ্যের এই অনুষ্ঠানে।

মায়ের চরণে অঞ্জলি দেওয়ার পর উপস্থিত সবার মধ্যে বিতরণ করা হয় পূজার প্রসাদ। প্রতিবছর পূজা কমিটি পর্যাপ্ত পরিমাণে পূজার প্রসাদ তৈরি করে থাকে। হল ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা থাকায় পূজার দিন পূজার সব প্রসাদ তৈরি করা সম্ভব হয় না বলে পূজা কমিটি প্রসাদ পূজার আগের দিন রান্না ও প্যাকেট করে রাখে।

অঞ্জলি শেষে বিতরণ করা পূজার প্রসাদে সাধারণত থাকে পুষ্পার্ঘ্য, নিরামিষ, চাটনি, সয়াবিন, ফল ও মিষ্টি। অনেকে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন পূজার এই প্রসাদের জন্য।

সমবেত পূজারিদের একাংশ। ছবি: তপন পালের মাধ্যমে প্রাপ্ত
সমবেত পূজারিদের একাংশ। ছবি: তপন পালের মাধ্যমে প্রাপ্ত

পূজার প্রসাদ বিতরণের পর ছিল আলোচনা পর্ব। এই পর্বের শুরুতেই শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন পূজা কমিটির সভাপতি সুনীল রায়, সাধারণ সম্পাদক রতন বর্মণ ও সহসাধারণ সম্পাদক অঞ্জন দাস। শুভেচ্ছা বক্তব্যের পর দুর্গাপূজার তাৎপর্য বাংলা ও জাপানি ভাষায় ব্যাখ্যা করেন পূজা কমিটির উপদেষ্টা সুখেন ব্রহ্ম।

এ ছাড়া বক্তব্য দেন জাপানপ্রবাসী বাংলাদেশিদের সুহৃদ এশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটির উপদেষ্টা কাৎসুও ইয়োশিনারি। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিপদে-আপদে সব সময় পাশে থেকে সাহায্য করেন। তিনি উপস্থিত পূজারিদের পূজার শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের সবাইকে মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা করতে হবে, তিনি যেন এ পৃথিবী থেকে সব অপশক্তিকে বিদায় এবং বিভিন্ন দেশে অভিবাসীরা যে বৈষম্যের শিকার, তা দূর করেন।’

দেশটির বাংলাদেশ দূতাবাসের ডিপ্লোমেটিক উইংয়ের কাউন্সেলর ড. জিয়াউল আবেদিন রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমার পক্ষে পূজার অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা জানান ও প্রবাসে এই দুর্গাপূজা আয়োজন করার জন্য পূজার কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানান।

সিঁদুর খেলার আগে পূজারিরা। ছবি: তপন পালের মাধ্যমে প্রাপ্ত
সিঁদুর খেলার আগে পূজারিরা। ছবি: তপন পালের মাধ্যমে প্রাপ্ত

পূজা কমিটির উপদেষ্টা ড. কিশোর কান্তি বিশ্বাস সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আলোচনা পর্বের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। আলোচনার পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক পর্ব।

সাংস্কৃতিক পর্বের শুরুতেই ছোট ছোট শিশু নাচ, গান ও প্রবন্ধ পাঠ করে দর্শক-শ্রোতাদের মন ভরিয়ে দেয়। প্রথমেই দুই শিশুশিল্পী তনুতা ঘোষ গান ও ইউরি দাস নৃত্য পরিবেশন করে।

এই পরিবেশনার পর স্বরলিপি কালচারাল একাডেমির স্কুল বিভাগের শিশুশিল্পী কথাশ্রী বিশ্বাস, ভাগ্যশ্রী পাল, প্রগতি ঘোষ, সম্প্রীতি ঘোষ, শ্রীদিকতা বাড়ৈ, শ্রেয়া পাল, আদিত্য সাহা ও অদ্বিতীয়া সাহা দুটি নাচ ও দুটি গান পরিবেশন করে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মন ভরিয়ে দেয়।

এ ছাড়া আংকা বণিক একটি ভক্তিমূলক গান ও সেঁজুতি ব্রহ্ম গীতার মন্ত্র পাঠ করে। কাব্য জ্যোতি বিশ্বাস শ্লোক পাঠসহ দুর্গাপূজার বর্ণনা দেয়।

বড়দের অনুষ্ঠানে ভক্তিমূলক গান পরিবেশন করেন শান্তা দাস, পপি ঘোষ, পলি সরকার ও শতাব্দী বণিক। নাচ পরিবেশন করেন বৃষ্টি বণিক। এরপর জাপানের দুই সাংস্কৃতিক সংগঠন উত্তরণ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও স্বরলিপি কালচারাল একাডেমির শিল্পীরা ভক্তিমূলক গান ও কীর্তন দিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের মাতিয়ে তোলেন।

রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমার সঙ্গে পূজা কমিটির কর্মকর্তারা। ছবি: তপন পালের মাধ্যমে প্রাপ্ত
রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমার সঙ্গে পূজা কমিটির কর্মকর্তারা। ছবি: তপন পালের মাধ্যমে প্রাপ্ত

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর শুরু হয় সন্ধ্যা আরতি। এরপর মায়ের কপালে সিঁদুর দেওয়ার জন্য লাইন দেওয়া হয়। সিঁদুর দেওয়া শেষে ধুনুচির তালে তালে চলে নাচ। পরে বিজয়া দশমীর মিষ্টি দিয়ে উপস্থিত সবাইকে আপ্যায়ন করা হয়।

শেষে ভক্তরা ‘বলো দুর্গা মাই কী, জয়, আসছে বছর আবার হবে! এবার মাগো বিদায় তবে, আসছে বছর আবার হবে!’ বলে দেবীদুর্গা মাকে বিদায় জানান এবং একে অপরকে আলিঙ্গন করেন। আর এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় টোকিওতে এবারের পূজার সব আয়োজন।