ডাক্তারদের দুঃখের কাহিনি

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

ব্যথার ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহার এ দেশের একটা সমস্যা। মানুষ নির্ভরশীল হয়ে যায়। আমরা যাঁরা হাসপাতালে কাজ করি, তাঁদের জন্য সমস্যা আরও গুরুতর। রোগী ভর্তি হন গুরুতর কারণে। ভর্তি হয়েই শুরু হয়ে যায় নানা বাহানায় ইনট্রাভেনাস ব্যথার ওষুধ চাওয়া। ওষুধের ক্ষতিকর দিকগুলো বোঝাতে বোঝাতে আমাদেরও চোয়াল খুলে যাওয়ার অবস্থা। কিন্তু রোগী নাছোড়বান্দা।

মোটামুটি সব ডাক্তারেরই দুঃখের কাহিনির মধ্যে এ রকম কিছু থাকবে। সদ্য জয়েন করা প্রায় ছয় ফুট লম্বা ছেলে ডাক্তার টমেটোর মতো লাল হয়ে রোগীর রুম থেকে বের হয়ে আমাকে বললেন, ‘ফারহানা, তোমাকে মেন্টর হিসেবে মানি। জানো রোগী কী বলেছে আমাকে? অতিরিক্ত নারকোটিক দেব না বলে সে নার্সকে বলেছে, এ রকম আগলি রেলফ লরেন মডেল সে আর ডাক্তার হিসেবে চায় না।’

হাসি চাপতে গিয়ে আমার চোখে পানি চলে আসার অবস্থা।

লেখিকা
লেখিকা

হাসপাতালে কাজ করতে গিয়ে কোড গ্রে অনেক শুনতে হয়। মানে কেউ খেপে গেছে কোনো কারণে। আর সিকিউরিটি ডাকতে হবে। সেদিন আমার এক কলিগ দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বললেন, তাঁকে ৭৫ বছর বয়সের রোগী প্লাস্টিকের ছুরি দিয়ে ভয় দেখিয়েছেন। রোগী নারকোটিকস চান। সারা জীবন অতিরিক্ত আজেবাজে ড্রাগ ব্যবহার করে বুড়ো বয়সে হাসপাতালে এসে হামলা।

একবার ২৫ বছরের এক রোগী পেলাম, সারা গায়ে হেরোইন ইনজেকশন নিয়ে নেশা করে বাজে ইনফেকশন নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। প্রায় মর মর অবস্থা থেকে তাঁকে বাঁচিয়ে তোলা হলো। বাঁচা আর মরার মাঝামাঝি সময়ে তাঁর সব উইথড্রল সিম্পটম চলে গিয়েছে। তখন তিনি মোটামুটি সুস্থ। অনেক সময় নিয়ে তাঁকে বোঝালাম তিনি দ্বিতীয় জীবন পেয়েছেন। অবশ্যই যেন এসব ছেড়ে দেন। যত দিন হাড়ের ইনফেকশন ভালো না হয়, মুখে খাওয়ার নারকোটিকস তিনি পাবেন।

দুই দিন পর নার্স ফোন করে বললেন, ওই রোগী তাঁর মামাতো ভাই এসে ঘুরে যাওয়ার পর থেকে কেমন যেন অতিরিক্ত ঘুমাচ্ছেন। বাইবেলের মধ্যে তাঁরা হেরোইন আর সিরিঞ্জ পেয়েছেন।

রোগীর সঙ্গে কথা বলতে গেলাম, কোনো অপরাধ বোধ তাঁর নেই। অরণ্যে রোদন কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম।

তারপর কোনো কোনো রোগীদের আছে ক্যাসিনো–প্রীতি। যে শহরে আমি থাকি, সেই শহর থেকে লাস ভেগাস (জুয়ার স্বর্গরাজ্য) মাত্র ছয় ঘণ্টার দূরে। কিছুদিন আগে এক কলিগ ছুটি পেলেই খেলতে সেখানে খুব যাওয়া শুরু করলেন। বললেন, ‘দূর, এত কষ্টের কাজ কে করে। রাত নাই দিন নাই। তারপর এর ঝাড়ি, ওর ঝাড়ি।’

তাঁকে বললাম, কিন্তু সবকিছু হারিয়ে ফেললে কী হবে? কিন্তু কার কথা কে শোনে। তিন হাসপাতাল হওয়ার কারণে তাঁর সঙ্গে এরপর দেখা হয়েছে কম। ছয় মাস পর রাতে একসঙ্গে কাজ পড়ল। করুণ চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘ফারহানা তোমার কী মজা। ধর্মের কারণে কখনো জুয়া খেলনি। আমি আমার সব সঞ্চয় হারিয়েছি। এখন যত দিন বেঁচে থাকি, কাজ করে যেতে হবে।’

মনে মনে চিন্তা করলাম, কী ভয়াবহ নষ্ট নেশা। সবকিছু ভুলিয়ে দেয় সর্বস্ব না হারানো পর্যন্ত।

আরেকজন কলিগ খুব ফান লাভিং ছিলেন। শুধু স্ট্রেস কমাতে অ্যালকোহল খেতেন। তাঁকে বলতাম, একজন প্রফেশনাল তুমি। এক্সসারসাইজ বা অন্য হবি চেষ্টা করে দেখ না। তিনি শুধু হাসতেন। কোনো পার্টিতে গেলে আমার পাশে বসার তাঁর অন্য রকম আগ্রহ থাকত। আমি ওয়াইন খাই না। আমার ভাগের দামি ওয়াইনগুলো তিনি খাবেন। তারপর...সেদিন দেখলাম লিভার সিরোসিসের রোগী তিনি। হার্টও ঠিকমতো কাজ করছে না। ট্রান্সপ্লান্টের জন্য ডোনার খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু সে অনেক লম্বা পথ। ছয় মাস পুরোপুরি অ্যালকোহল না খেয়ে থাকতে হবে। প্রায় মর মর অবস্থায় ডোনার পেলে ও সফল ট্রান্সপ্লান্ট হলেও সারা জীবন প্রচুর ওষুধ খেয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলা।

একবার নেশাগ্রস্ত হয়ে গেলে এ পথ থেকে বেরিয়ে আসা একরকম অসম্ভব। এত ইচ্ছাশক্তি খুব কম মানুষেরই থাকে। তাই এসব এড়িয়ে চলাটাই উচিত।