আবরারের বাবার মুখ

আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ। ছবি: আসাদুজ্জামান
আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ। ছবি: আসাদুজ্জামান

ক্যাম্পাসের বন্ধুদের বলছি। বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসের বন্ধুদের বলছি। বন্ধুরা তোমরা একবার আবরারের বাবার মুখের ছবির দিকে তাকিয়ে দেখো। বারবার তাকিয়ে ভালো করে দেখো।

বলতে পারো, তিনি কোন দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি আজ কোনো দিকেই কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। তাঁর আজ চারদিকেই অন্ধকার। বহু ঘন অন্ধকার।

যদি তোমাদের বুকের মধ্যে থাকা হৃদয় নামক যন্ত্রটি পাথর হয়ে না যায়, তবে বুঝতে পারবে তাঁর মনে আজ কত দুঃখ।

আমিই বলে দিচ্ছি তাঁর মনে আজ কত দুঃখ। তাঁর বুকের ওপর যদি হিমালয় পাহাড়টিও এনে বসিয়ে দাও; তাতেও তিনি তত কষ্ট পাবেন না, আজ যত কষ্ট তাঁর বুকে।

আজ যারা আবরারের মা-বাবার বুক খালি করল, আমার এই লেখাটি ঠিক তাদের নিয়ে নয়। তাদের নিয়ে লেখার সাহস আমার নেই। হয়তো বা এই সামান্য কথাগুলোও লিখতাম না। কিন্তু প্রাক্তন বুয়েটিয়ান হিসেবে কিছু না লিখেও পারলাম না।

আবরার অনেক সাহসী ছিল। সাহসী ছিল বলেই আবরার দেশমাকে নিয়ে কলম ধরেছিল। ওর লেখাটি পড়েছি। এমন কী সে লিখেছিল, যার জন্য তাকে জীবন দিতে হলো।

দেশবাসীর তথা আবরারেরও নিশ্চয় ধারণা ছিল না, হায়েনারা আজকাল কত নিষ্ঠুর। ওকে বকা দিলে অথবা দুই–একটি চড়–থাপ্পড় দিলেই আবরার হল ছেড়ে পালাত। কেন একটা নিরীহ ছেলের ওপরে এই দানবের হোলিখেলা?

এই লেখার আগে এক আসামির দেওয়া জবানবন্দি পড়লাম। সে কী বীভৎস নির্যাতন। রাত আটটা থেকে বারোটা পর্যন্ত চারটি ঘণ্টা ধরে ছেলেটিকে মারা হলো।

মানুষের হৃদয় কি এত কঠিন হতে পারে? হলের সিসি ক্যামেরার সেই হায়েনার আনাগোনা কয়েকবার দেখেছি। ওদের একজনের মুখেও এতটুকু চিন্তার রেখা দেখা যায়নি। ওর সবকিছুই ঠান্ডা মাথায় করেছে।

কিন্তু যারা এই কাজটি করল, কী পেল তারা এটা করে? ওদের কী হবে সেটা নিয়ে আমি কিছু বলব না। রাষ্ট্র সেটা দেখবে। আজ তাদের মা-বাবা কী করে সমাজে মুখ দেখাবে?

আজ তারা যেমন ধ্বংস হলো, সেই সঙ্গে তাদের পরিবার তথা জাতির স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিল। আবরার পানির কথা লিখেছিল। ওপারের পানি দিয়ে আর আমাদের ফেনী নদী ভরতে হবে না। দেশ আজ দেখিয়ে দিল, এই দেশ ওই ছেলেগুলোর নয়। দেশ আবরারের; এ দেশ ভালো মানুষের। জাতি আজ যে চোখের পানি ফেলল, তাতেই ফেনী নদী ভরে যাবে।

জানি, আবরারের বাবার বুকের ওপর চেপে বসা এই বোঝা কখনোই এতটুকু হালকা হবে না। তিনি যত দিন বাঁচবেন, এই বোঝা বহন করেই চলবেন। তারপরও তাঁর একটা গর্ব থাকবে। গর্ব থাকবে এই ভেবে যে, তাঁর ছেলে শহীদ হয়েছেন। আবরারের মতো উঁচু মর্যাদার শহীদ আর কে হতে পারে? আবরার দেশের কথা বলতে গিয়ে জীবন দিয়েছে। স্বীকৃতি না পেলেও, আবরার আজ জাতির গর্ব। আবরার আজ আমাদের গর্ব।

আবার ক্যাম্পাসের বন্ধুদের কথায় ফিরে আসি। যেসব বন্ধুরা বইখাতার পাশাপাশি চাপাতি, ক্ষুর, লাঠিসোঁটা রাখ; মনের মাঝে সহপাঠীর প্রতি ঘৃণা রাখ, তাদের বলছি। একবার ভেবে দেখ, আজ যে ছেলেগুলো এই কাজ করল, আজ তাদের যে পরিণতি হবে, তাদের পরিবারের যে অবস্থা হবে, তোমরাও কি তাই চাও?

আর একটা বাস্তব কথা বলি। তোমরা শত শত ছেলে ‘অপরাজনীতি’ করে তোমাদের উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছ। বলতে পারো, কজন পাবে ওই লোভনীয় পদটি? যে পদটি এনে দেবে শতকোটি টাকা। এত টাকা কামালে সে–ও হিমশিম খাবে। কোথায় তা লুকাবে? বিছানার নিচে, সিন্দুকে নাকি মাটির তলায়?

বন্ধুরা, বিশ্বাস করো, ওই টাকা জীবনেও কোনো কাজে দেবে না। ওই টাকাই তোমার অপমৃত্যুর কারণ হবে। ওই টাকাই তোমার পরবর্তী প্রজন্ম ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট।

আর ওই এক–দুজন বড় দুর্ভাগা ছাড়া তোমরা সবাই কোনো কূলই পাবে না। না পারবে বড় দুর্ভাগা হতে; না পারবে মানুষ হতে। তাই তোমাদের বলছি, বন্ধুরা তোমরা অযথা ওই বড় দুর্ভাগাদের সঙ্গ দিয়ে তোমাদের মূল্যবান জীবন ধ্বংস করো না। তাদের তোমরা ততক্ষণই সাপোর্ট করবে, যতক্ষণ তারা একজন মানুষ; তোমার কথা ভাবে, মানুষের মঙ্গলের কথা বলে।

মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়েছ, মানুষ হিসেবেই বড় হতে চেষ্টা করো। মা-বাবার মান রাখতে, রাষ্ট্রের মান রাখতে চেষ্টা কোরো। বুকের ভেতর হৃদয় নামক যে যন্ত্রটি আছে, তাকে মেরে ফেল না। ওটা মরে গেলে তুমিও মরে গেলে। তোমাকে দিয়ে আর কারওরই কোনো কাজ হবে না। তুমি তোমার নিজের, তোমার পরিবারের, জাতির কারওরই কোনো কাজে আসবে না। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করবে ‘আমি মানুষ আছি তো? নাকি অমানুষ হয়ে যাচ্ছি।’ তাহলেই তোমার, আমার, জাতির সবার মুক্তি; তাহলেই আমরা মানুষ। তোমাদের জয় হোক; মনুষ্যত্বের জয় হোক।