মিশিগানের মাটি বুয়েটিয়ানদের ঘাঁটি। এই বাক্যটি আক্ষরিক অর্থেই সত্যি।
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্য গাড়ি তৈরির জন্য বিখ্যাত। এখানে আছে বিগ থ্রি জেনারেল মোটরস, ফোর্ড আর ক্রাইসলারের অবস্থান। তাই বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের প্রকৌশলীদের একটি বড় গন্তব্য হলো মিশিগান।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পাস করা প্রকৌশলীরা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছেন মিশিগানের আনাচকানাচে। মেধাবী ও পরিশ্রমী বাঙালিরা চাকরি করে শুধু নিজেদের রুজিরোজগারই করেন না, দেশে পরিবারের উনুনে আগুনের ব্যবস্থাও করে থাকেন। তাঁরা পরিবার–পরিজনদের কাছ থেকে দূরে থাকলেও দেশ থাকে অন্তরে ও ভাবনায়।
বাঙালি ভাইয়েরা প্রতিদিনের মতোই মিশিগানের ভারী শিল্পের উৎপাদনের চাকা ঘুরিয়ে পরিশ্রান্ত শরীরে পড়ন্ত বিকেলে যখন নীড়ে ফিরছিলেন, ঠিক তখনই আবরারের অসময়ের অস্বাভাবিক বিয়োগের সংবাদটি আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আছড়ে পড়েছিল মিশিগানের মাটিতে।
কাজ শেষে ক্লান্ত শরীরে তখন একটু বিশ্রাম নেওয়ার কথা। তা না করে চা নাশতা ভুলে গিয়ে সবাই মনোনিবেশ করলেন ইন্টারনেট ব্রাউজিং ও খবরের সত্যতা অনুসন্ধানে।
৬ অক্টোবর রোববার দিবাগত রাত। বাংলাদেশে তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। বুয়েটের শেরেবাংলা হলের সামনের বড় কড়ইগাছগুলোতে তখনো কাকের কা–কা শুরু হয়নি। কিন্তু হলের ভেতর শুরু হয়ে গেল অনেকের আনাগোনা।
সেখানে একটি ছেলেকে মানুষরূপী কিছু হায়েনা খুবলে খেয়েছে। দীর্ঘ সময় নিয়ে অত্যাচার করে ছেলেটার প্রাণটাকে একটু একটু করে দেহ ত্যাগে বাধ্য করেছে। একটু মেরেছে, তারপর ওষুধ লাগিয়ে আবার মেরেছে। এই পাশবিক নির্যাতন শুধু আবরারের আত্মাকে দেহ ত্যাগে বাধ্য করেই ছাড়েনি, ষোলো কোটি মানুষের হৃদয়ে কড়া নেড়ে গেছে।
সেই চাপা ক্ষোভের বিষবাষ্প শুধু যেন বুয়েটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বাংলাদেশের সব প্রান্তরের মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। চারদিকে প্রতিবাদ, বিচারের দাবিতে মুখর।
মিশিগানের বাঙালিরাও এর ব্যতিক্রম নন। গত বুধবার (৯ অক্টোবর) সন্ধ্যায় কাজের শেষে সবাই জমায়েত হন হ্যামট্রামিক শহরে মানববন্ধনে। অনেক মানুষের সমাগমে আলাদিন রেস্তোরাঁটি খুব সরগরম হয়ে যায় অল্প সময়ে। সবাই হাজির মানববন্ধনে শামিল হতে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানববন্ধনের দৈর্ঘ্যও লম্বা হচ্ছিল।
সবার মুখে একটাই দাবি, সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার। মানববন্ধনে ছিল বিভিন্ন বয়স ও পেশার মানুষ। তবে প্রকৌশলীদের সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য।
যেকোনো বিষয়ে কারও ভিন্নমত থাকতেই পারে। কিন্তু এই ভিন্নমত প্রকাশের দায়ে একটি স্বাধীন দেশে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হবে, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ফেসবুকে সামান্য একটি স্ট্যাটাসের জের ধরে আবরারকে শিবির সন্দেহে শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর রুমে, পরে ২০০৫ নম্বর রুমে নিয়ে দফায় দফায় বেধড়ক পেটানো হয়।
আবরার মধ্যে দুই দফা বমি করেন এবং যাঁরা তাঁকে মারছিলেন, অনেকবার তাঁদের কাছে ক্ষমা চান। কিন্তু এতেও ঘাতকদের মন গলেনি। তাঁরা ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে পেটানো অব্যাহত রাখেন। যার করুণ পরিণতি আবরারের মৃত্যু।
মানববন্ধনে অনেকেই বক্তব্য রেখেছেন। নিজস্ব মতামত আর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন, প্রাণের বুয়েট আজ এমন হলো কীভাবে? সমাবেশে সবচেয়ে তরুণেরা তাঁদের বুয়েট–জীবনের স্মৃতি তুলে ধরেন। তাঁরা কীভাবে হলে নির্যাতন হয় তার কিছু বুক কাঁপানো উদাহরণ দেন। মানববন্ধনে বিচার প্রত্যাশার পাশাপাশি কীভাবে বুয়েটকে ভবিষ্যতে বাঁচানো যায় তা নিয়ে অনেক মতবিনিময় হয়।
বুয়েটের বিভিন্ন হলে এই ঘটনা অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। এর আগেও অত্যন্ত সামান্য কারণে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আরও অনেক ছাত্র। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী গত কয়েক বছরে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বুয়েট ছেড়েছেন অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী। র্যাগিং, নির্যাতন এখন হলসমূহে একদম সাধারণ ঘটনা।
ব্যাপারটা এমন, আবরার যদি একটু কম মার খেয়ে বেঁচে থাকতেন, তাহলে এ বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলতেন না। সবার কাছেই স্বাভাবিক মনে হতো।
বুয়েট বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে সারা দেশ থেকে সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা এসে ভর্তি হন, সেখানে এই ধরনের আচরণ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। যাঁরা ঢাকার বাইরে থেকে বুয়েটে পড়তে আসেন, তাঁদের অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগও সীমিত। আমরা শুধু বুয়েট নয়, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের ভয়ংকর পরিস্থিতির অবসান চাই।
সভায় উপস্থিত এক বক্তা আবরার হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে সরাসরিভাবে দায়ী করেন। বুয়েটের বিভিন্ন হলে অবস্থিত টর্চার সেল মোটামুটি ওপেন সিক্রেট। সেখানে নিয়মিতভাবে র্যাগিংয়ের নাম করে সামান্য তুচ্ছ কারণে ছাত্রদের নির্যাতন করা হয়। এই বিষয়ে অবগত থাকা সত্ত্বেও হল প্রশাসন, ছাত্রকল্যাণ পরিষদ (ডিএসডব্লিউ), উপাচার্য কাউকেই কার্যকরী ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানিয়েও মেলেনি কোনো প্রতিকার।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্যাতনের মাত্রা এতই ভয়াবহ ছিল যে নির্যাতিতরা অনেকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ভাগ্যগুণে বেঁচে ফিরেছেন। সামান্য কারণে যেমন সালাম না দেওয়া, ক্যাম্পাসে মেয়েবন্ধু নিয়ে ঘোরা, মিছিলে যোগদান না করা, ফেসবুকে ভিন্নমত প্রকাশ ইত্যাদি, এই ধরনের তুচ্ছ কারণে অত্যন্ত নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অনেকে। মেরে একাধিকজনের হাত–পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
এমনই নির্যাতনের শিকার একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তিনি হল প্রভোস্টের কাছে তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। প্রভোস্ট স্যার তাঁকে সিনিয়র ভাইদের সঙ্গে ‘মানিয়ে চলার’ পরামর্শ দেন। এক ছাত্রের কাছে মার খেয়ে গুরুতর আহত একজনের বাবা ডিএসডব্লিউ স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তাঁকে বলা হয়, তাঁর ছেলেকে হল থেকে নিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও রাখতে।
মাত্র কিছুদিন আগে র্যাগিংয়ের সময় চড় মেরে একজনের কানের পর্দা ফাটিয়ে ফেলা হয়। এমন জঘন্য ঘটনায় প্রশাসন লোক দেখানো সামান্য শাস্তি দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছে। এমন আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, যেখানে প্রশাসন অত্যন্ত বিশ্রীভাবে নির্যাতনকারীর পক্ষ অবলম্বন করেছে।
প্রশাসনের এই নির্লিপ্ততা ও উদাসীনতা পর্যায়ক্রমে র্যাগারদের নির্যাতনে পরোক্ষভাবে উৎসাহ জুগিয়েছে। অনেক বড় ভাই নাকি বুয়েটে অলিখিত নিয়ম চালু করেছেন। যেমন প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের ক্যাফেটিরিয়াতে খাবার কিনতে ঢুকতে দেওয়া হয় না। এটা আরেকটি উদাহরণ মাত্র। আবরার ফাহাদের মৃত্যু বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার একটি বাহ্যিক সূচক মাত্র।
মানববন্ধনে সবাই এক বাক্যে আবরার হত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশে–বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বুয়েটিয়ানদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এই লক্ষ্যে একটি ফেসবুক গ্রুপ খোলা হয়েছে। এই গ্রুপের লক্ষ্য হচ্ছে নিম্নরূপ:
ক. আবরার হত্যার বিচারিক প্রক্রিয়ার নিয়মিত খোঁজখবর রাখা। কারণ, এই মামলায় সরকার বাদীপক্ষ ও সরকারি পাবলিক প্রসিকিউটররা কাজ করবেন। তাঁদের কাজ ও পুরো মামলার গতিবিধি সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখা। নির্দোষ কেউ যেন শাস্তিভোগ না করেন এবং দোষী ব্যক্তিরা কেউ যেন আইনের ফাঁক গলে বের না হয়ে যান।
খ. আবরার হত্যাকাণ্ড ছাড়াও সাম্প্রতিককালে যেসব র্যাগিং বা নির্যাতনের ঘটনা হয়েছে, তার সব কটির সঠিক তদন্ত, বিচার ও দোষী ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করার জন্য বুয়েট কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করা।
গ. ভবিষ্যতে বুয়েটে সব ধরনের র্যাগিং বন্ধে প্রশাসনের সক্রিয় ও কার্যকরী ভূমিকা পালন।
ঘ. র্যাগিং বন্ধে হটলাইন চালু করা, যাতে কেউ র্যাগিংয়ের শিকার হলে দ্রুততার সঙ্গে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা যায়।
ঙ. ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশে–বিদেশে সবার নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরকার ও বিচারিক কার্যক্রমে জড়িত সংস্থাসমূহের ওপর চাপ প্রয়োগ করা।
চ. নির্যাতনকারী ছাত্রদের একটি সেন্ট্রাল ডেটাবেইস তৈরি করা। যেখানে সব নির্যাতনের বিস্তারিত লিপিবদ্ধ থাকবে। এতে নির্যাতনকারী ছাত্রদের সামাজিকভাবে বয়কটের সুযোগও থাকবে।
এই মানববন্ধন শুধু এক দিনের বন্ধনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এটি একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কাজ করবে যেন ভবিষ্যতে সাধারণ ছাত্ররা আর নির্যাতনের শিকার না হন। অকালে যেন আর কোনো প্রাণ ঝরে না যায়। দেশ যেন কোনো নিষ্পাপ নাগরিককে না হারায়।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে