সামিনের ভাবনা

প্রথম আলোর ফাইল ছবি
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

মধ্যবয়সী সামিন আজকে কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে। জীবনের টানাপোড়নে খুব ব্যালান্সড জীবনের খেতাবধারী সামিন আজ সব হারাতে বসেছে প্রায়। তাই ছুটি নিয়ে চলে এসেছে সমুদ্রের কাছে। নিজের জীবনের হিসাব-নিকাশ বুঝে নিতে।

বিয়ে হয়েছে ২০ বছর বয়সে। তারপর পড়াশোনা ও বাচ্চা বড় করা। এর সঙ্গে তিল তিল করে নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তোলা। কেমন যেন ঘোরের মতো কেটে গেল ২৪টা বছর।

যদিও বিয়ে কী, ভালো করে বোঝার আগেই আবিরের আগ্রহেই বিয়েটা হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পরপরই আবিরকে মুগ্ধ করার আর সুখী রাখার প্রতিযোগিতায় যেন নেমেছিল সে।

হাত পুড়িয়ে রান্না শিখল। বাবার টাকাতেই প্রায় পড়া শেষ করল। কারণ, আবির সদ্য পাস করা ইঞ্জিনিয়ার। তা ছাড়া ওর পরিবারের বড় বড় খরচ ওকেই সামলাতে হয়। এত বছরে কখনো আবির নিজ থেকে কিছু কিনে দেয়নি সামিনকে। বরাবরের জবাব, ‘তোমার তো সব আছে।’ বোনের কাছ থেকে পেয়ে কোনো কিছুর অভাব আবির বোঝেনি বা মাথায় আনতে চায়নি।

চাকরি শুরুর পর থেকে সব টাকা একই অ্যাকাউন্টে রাখা থেকে শুরু করে সব করেছে সংসারের জন্য। কিন্তু আবির কেন যেন খুশি নয়। একটু দামি রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেও রাগ। অথচ দুজনের আয় যত বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে আবিরের পরিবারের খরচ করার হাত তত খুলেছে।

এ সংসারে যা হয়। খুঁটিনাটি সব হিসাব চলে যায় আবিরের বোনের কাছে। তিনি সব সময় সামিনকে বোঝান, আবির রেস্ট ডিজার্ভ করে, বাসায় এসে ওর কোনো কাজ করা উচিত নয়। পরিবারকেই সব সময় দিতে হবে কেন? মাঝে মাঝে শুধু বোনকে সময় দেওয়া বা নিজে ঘুরে বেড়ানো উচিত।

কোথাও যেতে গেলে বউ-বাচ্চার জন্য সবচেয়ে সস্তা টিকিট করতে পরামর্শ দিতে লাগলেন বোন। আবির অক্ষরে অক্ষরে শুনল সেসব। কেন যেন বাচ্চাদের ফেলে রেখে আবিরের ফানের ব্যবস্থা হয়। সেসব বাজে পরামর্শ আবির লুফে নিল।

লেখিকা
লেখিকা



সব বিষয়ে অবহেলা সহ্য করেও বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে সামিন চাইল সংসারটা টিকিয়ে রাখতে। যে আবির কখনই রান্নার ধারেকাছে যায় না, সে ইদানীং রান্না করে। যখন-তখন বোনকে দিয়ে আসতে লাগল। যখন-তখন নিজের মাকে দেখার নাম করে সিলেট চলে যেতে শুরু করল।

সামিন কীভাবে এত কিছু সামলায় সে বিষয়ে আবিরের কোনো বিকার নেই। আবির কোনো ছুটি সামিনের সঙ্গে নিতে চায় না। কোথাও পরিবার নিয়ে সে যাবে না। আবিরের ভালো লাগে না। ইদানীং সামিন বারবার বোঝাতে চেষ্টা করছে, একা একা সে সবকিছু সামলায়। দেশটা তো এত সেফ না। বিনা কারণে মানুষ মানুষকে মেরে ফেলছে। নিজের পরিবারকে সময় দেওয়ার নেশায় আবির বলে ফেলেছে, সেটা তার সমস্যা না।

অতঃপর সমুদ্রের কাছে খুব ভোরে এসে হেঁটে হেঁটে জীবনের হিসাব–নিকাশের চেষ্টা করছে সামিন। মনে বেজে চলেছে শুধু একটাই সুর—‘কখনো জানতে চেও না, কী আমার সুখ, কী আমার বেদনা, তুমি কখনো দাওনি মালা, কেন দাও কাঁটার জ্বালা।’

নিজের জীবন নিয়ে ভাবল সামিন। টাকাপয়সার জন্য সে আবিরের মুখাপেক্ষী নয়। বরং এখন প্রায় সবকিছুতে ওর কন্ট্রিবিউশন থাকে। আবিরের জোরাজুরিতে এতগুলো বছর তারা একসঙ্গে। হয়তো একটু ছোট বাড়িতে চলে যেতে হবে। কিন্তু বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ সে চালিয়ে নিতে পারবে।

রিটায়ার্ড করার পর খুব গরিব থাকার কোনো কারণ নেই। আবির এর কোনো কিছুতেই নেই। সামিন গান গাইলে কিছু মুগ্ধ শ্রোতা থাকে। কিন্তু সেই শ্রোতাদের মধ্যে আবির থাকে না। সামিনের লেখালেখির কিছু মুগ্ধ পাঠক আছে। আবির মাঝে মাঝে গোপনে পড়ে বলে খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু ফেসবুক থেকে সামিনকে বাদ দিয়েছে সে। কারণ, একবিন্দু গুরুত্ব দেয় তাকে, এটা যেন আবিরের পরিবার না বোঝে। সেটা লতায়–পাতায় যত দূরের কেউ হোক।

মূলত একাই চলছে সামিন। আবিরের ভালোবাসার আশায় জীবনের সব বসন্ত নষ্ট করেছে সামিন। একা বাচ্চা নিয়ে সে ভালো থাকবে। সেদিন আবির বলেছে, ওকে ফেলে চলে গেলে সে আবার বিয়ে করবে। সামিন হাসল। মনে মনে আবিরকে বলল, বিয়ে তো সবাই কয়েকটা করে করতে পারে। যারা অশিক্ষিত তাদেরও বউ বা বরের অভাব হয় না।

এতগুলো বছর সংসার টিকে ছিল, সামিন রান্না করে একসঙ্গে শেয়ার করে খাবে বলে। একা খেতে মজা লাগত না। আবির খুব গান পছন্দ করে। সামিনও বাংলা গান গাইত। কিন্তু ইদানীং আবির কার জন্য হিন্দি গানের বাংলা করে কাকে পাঠায় সামিন জানে না। সুতরাং কোনো খাবার, গান, লেখা বা স্বপ্নিল কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সাথি সে আর নেই।

সামিন চিন্তা করে দেখল, তার অনেক বন্ধু আছে। চাকরি আছে। বাচ্চা আছে। ইদানীং অনেক মানুষ গ্রুপ করে বেড়াতে যায় বিদেশে।এই বেড়ানো সেফ। এভাবে প্রতি রাতে কাঁদার চেয়ে একা থাকা ভালো না?

সৃষ্টিকর্তা ওকে সৃষ্টি করেছেন। ওর সুখের আর জীবনের দায়িত্ব তো তাঁর। সামিন খুব চেয়েছিল এ জীবন আর পরকাল একজনের সঙ্গে কাটাতে। কিন্তু এটা সম্ভব হচ্ছে না। সৎভাবে চেষ্টা করেও না। হবে না।

কিন্তু যদি না পারে, অন্য মেয়েদের কী বোঝাবে সামিন? সে তো প্রফেশনাল কাউন্সিলর। না, অনেক হয়েছে চেষ্টা, আর না। মা–বাবা, বন্ধু, সন্তান আর সমাজের অনেক মেয়ের আইডল সামিন। ওকে বাঁচার চেষ্টা করতেই হবে।

আবির ওর পরিবার আর বিভিন্ন মেয়েদের, যাদের ওর ভালো লাগে, তাদের নিয়ে থাকুক।

সামিনের জীবনেও ভালোবাসার অনেক রং আছে। স্বামী–স্ত্রীর ভালোবাসাই জীবনের একমাত্র ভালোবাসা নয়। এত বছরে সত্যিকারের ভালোবাসা সে অনেক দেখেছে বহু তরুণ আর বৃদ্ধদের মাঝে। আবিরের মতো ছেলেরাও আছে যারা ভালোবাসতে শেখে না।

সবার পবিত্র আলোয় সামিন দেখল একটা লাল গোলাপ নিয়ে একজন তরুণ এক তরুণীকে ভালোবাসা নিবেদন করল। চিরদিন বেঁচে থাকুক সত্যিকারের ভালোবাসা। সামিন চলল ওর জীবনে ফিরে। গুছিয়ে নিতে জীবন, সুখী হতে।