নীল পাহাড়ের দেশে

থ্রি সিস্টার। ছবি: এহতেশাম ফেরদউসের মাধ্যমে প্রাপ্ত
থ্রি সিস্টার। ছবি: এহতেশাম ফেরদউসের মাধ্যমে প্রাপ্ত

সিডনি শহরের রোদঝলমলে বসন্তের এক সকাল। নীল আকাশ আর রং-তুলিতে আঁকা শুভ্র মেঘের আনাগোনা। শনিবার সকালটাতে এমনিতেই মন ভালো থাকে। সপ্তাহের ছুটি শুরু। তাই অন্য দিনের চেয়ে শনিবার সকালটা বেশ আলাদা। ঘুম থেকে উঠে কোনো তাড়া নেই। ট্র্যাফিক জ্যাম নেই। মন ভালো থাকলে সবকিছু সাধারণের চেয়ে বেশি সুন্দর মনে হয়।

অনেক দিন থেকে বাইরে কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। আর আজকে পরিকল্পনামাফিক কাজ। ঝটপট কিছু খাবার তৈরি করে বেরিয়ে পড়ার পালা। বেশি দূরের পথ নয়। কিন্তু তারপরও দুপুরের জন্য তিন মিনিটের ঝটপট নুডলস আর কিছু শুকনো খাবার গাড়ির পেছনে নিয়ে নিলাম। আমি, আমার স্ত্রী আর দুই কন্যা।

ঝরনা। ছবি: এহতেশাম ফেরদউসের মাধ্যমে প্রাপ্ত
ঝরনা। ছবি: এহতেশাম ফেরদউসের মাধ্যমে প্রাপ্ত

আমাদের গন্তব্য নীল পাহাড়। নামটা শুনতে যে রকম সুন্দর, জায়গাটিও সে রকম সুন্দর। সিডনি শহরের একপাশে সুবিশাল তাসমান সাগর আর অন্য পাশে সুবিশাল পর্বতমালা। দিগন্তবিস্তৃত পর্বতমালা চলে গেছে বহু দূর পর্যন্ত। এই পর্বতমালার শুরুর অংশটার নাম নীল পর্বতমালা, যা স্থানীয়ভাবে ‘ব্লু মাউন্টেন’ নামে পরিচিত।

নাম শুনে মনে হতে পারে পাহাড়ের রং নীল। আসলে পাহাড়ের রং অন্য সব জায়গার মতোই সবুজ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে হওয়ায় বেশ ঠান্ডা। শীতকালে তুষারপাত পর্যন্ত হয় এখানে। সিডনি শহরের সবচেয়ে কাছে একমাত্র এখানেই তুষার পড়ে। আর রয়েছে ঐতিহাসিক ট্রেনে চড়ার ব্যবস্থা, কেবল কার ইত্যাদি।

ব্লু মাউন্টেনে ঢোকার মুখেই রয়েছে ঐতিহাসিক ছোট একটা শহর, যা ব্লু মাউন্টেন ভিলেজ নামে পরিচিত। ছবির মতো করে সাজানো একটা শহর। চারপাশে পুরোনো কিছু ঘরবাড়ি। শহরের কেন্দ্রস্থলে কিছু খাবারের দোকান আর রাস্তার দুপাশে নাম না–জানা বাহারি ফুলের গাছ। বসন্তের রং লেগে সদ্যঃস্নাত সূর্যের আলোয় চারপাশ অভাবনীয় সুন্দর সাজে সেজেছে।

প্রথমেই যাওয়ার পালা থ্রি সিস্টার লুক আউট পয়েন্টে। গাড়ি থেকে নেমে আরেকবার মুগ্ধ হওয়ার পালা। তিনটা পাহাড় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। সময়ের সঙ্গে অনেকটা ক্ষয়ে গেছে। কিন্তু একে অন্যকে জড়িয়ে এখনো স্থির দাঁড়িয়ে। বিষাদ আর মমতার এক কোমল আলিঙ্গন।

ব্লু মাউন্টেন ভিলেজ। ছবি: এহতেশাম ফেরদউসের মাধ্যমে প্রাপ্ত
ব্লু মাউন্টেন ভিলেজ। ছবি: এহতেশাম ফেরদউসের মাধ্যমে প্রাপ্ত

এই থ্রি সিস্টারের ব্যাপারে স্থানীয় আদিবাসীদের একটা গল্প আছে। অনেক আগে এখানে তিন বোন থাকত। তাদের নাম ছিল মেহেনি, ওয়িম্লা ও গানেদু। ভীষণ সুন্দর এই তিন বোনের প্রেমে পড়েছিল দূর দেশের তিন রাজপুত্র। কিন্তু তখনকার সমাজ তা মেনে নেয়নি। তখন তিন রাজপুত্র সেই আদিবাসী গোত্রের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাদের কাছ থেকে সেই তিন বোনকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তখন আদিবাসীদের মধ্যে থেকে একজন ওয়িচ বা জাদুকরি সেই তিন বোনকে রক্ষার জন্য তাদের পাথর বানিয়ে দেয়, যেন রাজপুত্ররা কোনোভাবে তাদের কবজা করতে না পারে। এই হচ্ছে থ্রি সিস্টারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

থ্রি সিস্টার লুক আউট পয়েন্ট থেকে হাঁটা রাস্তা নেমে গেছে। সেখান দিয়ে ট্র্যাকিং করে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যাওয়া যায়। নিরাপত্তার জন্য প্রথমে ব্যক্তিগত তথ্য জমা রাখতে হয়। কখনো সঙ্গে গাইড থাকে। এই ট্র্যাকিংয়ের দুই পাশে গহিন অরণ্য আর মনোমুগ্ধকর ঝরনা।

ট্রেন। ছবি: এহতেশাম ফেরদউসের মাধ্যমে প্রাপ্ত
ট্রেন। ছবি: এহতেশাম ফেরদউসের মাধ্যমে প্রাপ্ত

এত সতর্কতার পরও প্রায় অনেকে ট্র্যাকিংয়ে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেন। যাঁরা ভাগ্যবান, তাঁদের ফিরিয়ে আনে রেসকিউ হেলিকপ্টার বা রেসকিউ দল। এ রকম বৈরী পরিবেশ থেকে যাঁরা ফিরে আসেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। আমাদের ট্র্যাকিং করার ইচ্ছা থাকলেও কিছুটা ভয় আর বাচ্চাদের কথা ভেবে লুক আউট পয়েন্ট থেকে সৌন্দর্যগুলো মনে গেঁথে নিয়ে ফিরে চললাম বিভিন্ন রাইডের দিকে।

ঝটপট বাচ্চাদের কিছু খাইয়ে নিজেরাও খেয়ে নিলাম। কোথাও ঘুরতে গেলে অন্য সময়ের চেয়ে ক্ষুধা বোধ হয় একটু বেশি লাগে। এরপর টিকিট কেটে রাইডে চড়ে বসার পালা। রাইডগুলো বেশ লোমহর্ষক। খাড়া পাহাড়ের ওপর থেকে ট্রেন নেমে গেছে একদম নিচে। এরপর ঘটঘট করে ওপরে উঠে আসা কিংবা কেবল কারে করে ঝুলতে ঝুলতে এক পাহাড়ের চূড়া থেকে অন্য পাহাড়ের চূড়ায় যাওয়া। নিচে তাকালে গভীর বন আর ছোট ছোট পাহাড়। ভয় আর আনন্দ মেশানো দারুণ এক অভিজ্ঞতা। ট্র্যাকিং করতে না পারলেও এখানে অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো হলো।

দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে গেছে। যদিও সন্ধ্যা হতে অনেক বাকি; চারপাশ থেকে ঝিঁঝি পোকারা তাদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ছে। সুন্দর এক দিন কাটিয়ে স্বপ্নিল নীল পাহাড়ের স্বপ্ন নিয়ে আমাদের ঘরে ফেরার পালা।

কেবল কার। ছবি: এহতেশাম ফেরদউসের মাধ্যমে প্রাপ্ত
কেবল কার। ছবি: এহতেশাম ফেরদউসের মাধ্যমে প্রাপ্ত