জলবায়ু পরিবর্তন ও পুঁজিবাদ

প্রথম আলোর ফাইল ছবি
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে পুঁজিবাদ নিয়ে হাজারো কিছু লেখা যেতে পারে। তত্ত্বকথায় না গিয়ে এ লেখা কিছু সাদামাটা উদাহরণ দিয়ে লেখার চেষ্টা করেছি। বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম, লিখব জলবায়ু পরিবর্তন ও পুঁজিবাদ নিয়ে।

গত এক বছরে এ বিষয়ে অনেক লেখালেখি দেখলাম পত্রপত্রিকায়। IPCC agreement ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে (১.৫-২ ডিগ্রি) আমরা সবাই জানি।

ক্ষমতাবান দেশগুলোর কেউ এগুলোতে স্বাক্ষর করবে না বা অনেক বিষয়ে এক্সপার্ট ও বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সরকারের পলিসির দ্বিমত আছে।

অস্ট্রেলিয়াতে লেবার পার্টিও এটাকে একটা ইস্যু হিসেবে দেখিয়েও নির্বাচনে জিততে পারেনি। আবার গত সেপ্টেম্বরজুড়ে সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কম প্রতিবাদ হলো না। আরও হবে। তবে এত কিছুর পরেও কেন ব্যবসায়ী এবং বেশির ভাগ দেশগুলোর সরকার চুপচাপ কেন?

নিচের কতগুলো বিষয় অনেকই যুক্তিযুক্ত বলে ভাবেন।

১. ৩০-৪০ বছর ধরে রিনিউয়েবল এনার্জি (Solar, Hydro, Wind, no/zero carbon emission based technology) ফসিল ফুয়েল বেজড এনার্জিকে (high carbon emissions) বিট করতে পারেনি। টেকনোলজি ও সাপোর্টের দিক থেকে তা বহু পিছিয়ে।

চীন, ভারত, জাপান আর ইউরোপের মতো কয়েকটি দেশ একটু এগোতে পারলেও মাস প্রোডাকশন ও ডিমান্ড মিটের দিক থেকে রিনিউয়েবল এনার্জি বহু পিছিয়ে ফসিল ফুয়েল বেজড এনার্জি প্রোডাকশনকে বিট করার জন্য।

একদল এক্সপার্ট যুক্তি দেখিয়েছেন, এখনো এসব প্রযুক্তি শক্ত ইকোনমিক মডেলের ওপর দাঁড়িয়ে নেই। আবার গ্রিন টেকনোলজিগুলোর এখনো অনেক বেশ দামি বা এখনো সহজলভ্য হয়ে উঠতে পারেনি।

যেমন ধরুন অস্ট্রেলিয়াতে কয়েক হাজার ইলেকট্রিক গাড়ি (ব্যক্তিগত কনভারশন বা ব্যাটারিচালিত) আছে। তেলের রিকন্ডিশন্ড গাড়ির তুলনায় ভালো ব্র্যান্ডের ইলেকট্রিক কার ১০-১৫ গুণ দামি। এভারেজ ব্র্যান্ডের তৈলের গাড়ির তুলনায় ভালো ব্র্যান্ডের ইলেকট্রিক কার ৩-৫ গুণ দামি। ভালো ব্র্যান্ডের তেলের গাড়ির তুলনায় ভালো ব্র্যান্ডের ইলেকট্রিক গাড়ি ২-৩ গুণ দামি। ব্যাটারির দামটাও বেশি। এরপরও থাকে লং ডিসটেন্সে রিচার্জ করার টেকনোলজি বা ফ্যাসিলিটি থাকা বা না থাকা।

এবার সোলারের উদাহরণ দিই। সামারে সোলার বেশ ভালো সাপোর্ট দিলেও শীতের তিন মাস পারফরম্যান্স তলাতে গিয়ে ঠেকে। একটি ১০ কিলোওয়াট সিস্টেম ২ কিলোওয়াট দিতে পারে না শীতের সময়। তাই সব সিটিতে সূর্যের আলো বেশি সময় না থাকলে এনার্জি ডিমান্ড মিট করে না। ভাবুন ব্রিসবেন ও মেলবোর্নের কথা। তাই ঘুরে ফিরে সেই ফসিল ফুয়েল বেজড এনার্জির ওপর নির্ভর করতে হয়।

যদি ব্যাটারি দিয়ে স্টোর করা যায়, আর বাসায় যদি ইলেকট্রিক গাড়ি থাকে, তবে তা রিচার্জ করতে ব্যাকআপ হিসেবে কাজ করবে।

আরও একটা সমস্যা হলো প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শহর এলাকায় রিনিউয়েবল এনার্জি ডিস্ট্রিবিউশন। এগুলোর জন্য বেশি বিনিয়োগ কেউ করতে চায় না।

কয়েক বছর আগে এখানে এক সেমিনারে দেখলাম, অস্ট্রেলিয়ায় সাবার্বের (এলাকা) সব বাসায় যদি সোলার থাকে, তাহলে গ্রিড ও সোলার ব্যালান্স করার মতো (ভোল্টেজ টু গ্রিড ও ট্রান্সমিশন) টেকনোলজি অস্ট্রেলিয়ার এনার্জি ডিস্ট্রিবিউশনের নেই বা আপগ্রেড করা প্রয়োজন। ফলে ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে ব্যবসায়ীরা বেশ ভালোই দোটানায় আছেন।

বাণিজ্যিক অনেক ভবন বা সুউচ্চ আবাসিক অনেক ভবন বর্তমানে গ্রিন বিল্ডিং হচ্ছে। অনেক এনার্জি এফিশিয়েন্ট ফিচার, ডে লাইটিং, কনজাম্পশন অ্যানালাইসিস, ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাডাপ্টেশন, এলসিএ অ্যানালাইসিস, থার্মাল কমফোর্ট, ওয়াটার এফিসিয়েন্সি ইত্যাদি করে বিল্ড হচ্ছে।

এসবে ইনভেস্টররা অনেক ইনভেস্ট করেন। তবে একটা দেশের মোট ভবনের সংখ্যার তুলনায় গ্রিন বিল্ডিং কম। ১০-১৫ শতাংশ হতে পারে বড়জোর। আর এসব ভবন ভাড়া বা কিনে নিতে অনেক টাকা দিতে হয় এবং ক্রেতা বা ভাড়াটে কম পান ডেভেলপাররা। রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্টে সময় লাগে আরও বেশি। আর সে জন্যই ইনভেস্টে আপত্তি অনেক ইনভেস্টরদের।

এখানেও ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট বড় ভূমিকা রাখছে। এর সঙ্গে থাকছে বিল্ডিংয়ের স্থায়িত্ব। সাধারণত ৫০ বছর সাস্টেইন করবে বলে ডিজাইন করা হয়। যেখানে ১০০ বছর পরেও বিল্ডিংয়ে জলবায়ুর এক্সট্রিম ইফেক্ট থাকবে বলে মনে করে, সেখানে ২০ বছর পরেই ইফেক্ট দেখা শুরু হয়। আর ৫০ বছরে ওই বিল্ডিং ডিমলিশড হয়। আর এসব চিন্তাভাবনায় ডেভেলপার ও বিল্ডার্সরা কম ক্যাপিটালে জলবায়ু পরিবর্তনের ইফেক্ট বাদ দেন বা কোনো অ্যাকশন নেন না।

৩. এবার আসি HVAC and Refrigeration সেক্টরে। অস্ট্রেলিয়াতে অলরেডি HFC phasedown শুরু হয়ে গেছে। মন্ট্রিয়ল প্রোটোকল অনুযায়ী অনেক দেশ ও অরিজিন ম্যানুফ্যাকচারার HFC phasedown শুরু করে দেবেন। সমস্যা বাধবে পুরোনো চিলার/সেন্ট্রাল এসিতে অথবা যেসব এয়ারকন্ডিশন ব্র্যান্ডের গ্যাসগুলোর GWP (Global Warming Potential) বেশি।

উদাহরণস্বরূপ বাসার স্পিল্ট এসি R410a গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। যদি R32 ব্যবহার হতো, GWP হতো অর্ধেকের কম। তাহলে এখন থেকে পাঁচ-ছয় বছর পরে আপনার গ্যাস রিচার্জ করতে হলে আপনি ঝামেলায় পড়বেন। কারণ, অরিজিন কোম্পানি এই গ্যাস প্রোডাকশন বন্ধ করে দেবে বা ওই এসিতে ব্যবহার করা যায়, এমন অলটারনেটিভ গ্যাস বের করলেও ওই ব্র্যান্ডের সব ইকুইপমেন্টের সঙ্গে কমপেটেবল হবে না বা ফ্লেমেবিলিটি রিস্ক বাড়বে। ফলে আমাদের পুরো এসি পরিবর্তন করে ফেলতে হবে। বাজারে স্পিল্ট এসি কেনার সময় সতর্ক হয়ে যান।

কমার্শিয়াল চিলারগুলোর অবস্থা আরও বিপদে। এখানেও ব্যবসায়ীরা ও টপ কোম্পানিগুলো বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। এই খাতে অনেক ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট দরকার। কার্বন এমিসন কমাতে ও লো GWP Refrigerant কিনতে বা ব্যবহার করতে এবং সঙ্গে কমপেটেবল ইকুইপমেন্টের ব্যবহার বাড়াতে।

৪. গত বছর এবং এ বছরের গবেষণায় এটা প্রমাণিত কাউডাং কার্বন এমিসনের জন্য দায়ী। তার মানে হলো মাংসের প্রয়োজনে অনেক দেশের ফার্মের গরু প্রোডাকশন দায়ী। মানুষ মাংস খায় বেশি। গরু একদিকে ঘাস শেষ করে দিচ্ছে, যা কার্বন অ্যাবজর্বে ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে কাউডাং দিয়ে এমিসন বাড়াচ্ছে।

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

উপায়? মাংস কম খাওয়া। মাংসজাত প্রোডাক্ট আর ফার্মগুলোর কি অবস্থা হবে ভেবেছেন? তাহলে মাংসের বিজনেস আর ফার্মের বিজনেস গেল। কনজুমাররা কী করবেন? হেলদি ফুড খাবেন। খরচ পড়বে আরও তিন গুণ। এক কেজি মাংসের দাম ১০ ডলার হলে, একটা ছোট হেলদি ভেজি স্ন্যাক্সের দাম ১৫ ডলার। যা খেয়ে পেট ভরে না। আপনার খাওয়াদাওয়ার ওপর বেশ ইমপ্যাক্ট পড়বে। আপনার দৈনন্দিন খরচের ওপর প্রভাবটা অনেক বেশি থাকবে। তাহলে বিজনেসগুলোর হেলদি প্রোডাক্ট বের করতে খরচ বেশি করতে গেলে তাদের ক্যাপিটাল ইনভেস্ট করতে হবে বেশি। আর আপনার খরচ তো আছেই।

৫. জলবায়ু পরিবর্তনের অ্যাকশন হিসেবে অনেক দেশই কমবেশি পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে। জাপানে সোলার ফার্ম পুকুরে করছে। ইউরোপের কয়েকটা দেশ রিনিউয়েবল পাওয়ারে বেশ উন্নতি করেছে।

সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরাকে ১০০ শতাংশ রিনিউয়েবল এনার্জি ডিপেন্ডেড করা হবে বলে ঘোষণা এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবিলা করতে। তবে সব বড় শহর বা রাজ্যে সম্ভব কি না, ভাববার বিষয়। বেশ দুরূহ বলতে হবে। ছোট কোনো শহর বা দেশে এনার্জি আইন প্রয়োগ করে ইমপ্লিমেন্ট করা যত সহজ, বড় দেশে তত কঠিন।

অস্ট্রেলিয়াতে ‘কার্বন অফসেট প্রোগ্রাম’ আছে, যা এমিসনের ভিত্তিতে কার্বন নিউট্রাল সার্টিফিকেশন দেয়। এমিসন কমানোর স্টেপ নিয়ে বাকি এমিসন কমানোর জন্য রিনিউয়েবল ফান্ড দেওয়া, ইকুইপমেন্ট কেনা বা গাছ লাগানোতে ইনভেস্ট করা ইত্যাদি এই প্রোগ্রামের অংশ; যা অন্য দেশের জন্য এমিসন রিডাকশন মডেল হতে পারে।

অনেক যুক্তিতর্ক করা যাবে ওপরের বিষয়গুলো এবং অন্য জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুর সঙ্গে পুঁজিবাদ মিশিয়ে। বেশ কজন এক্সপার্ট মন্তব্য করেছেন, পুঁজিবাদ জলবায়ু পরিবর্তনকে বিট করতে পারবে, যদি ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করেন। অন্য দল বলছে, ব্যবসায়ীরা শুধু একা পারবেন না। এর সমাধান সস্তা টেকনোলজি, শক্ত ইকোনমিক মডেল ও রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্টের ওপর।

মজার ব্যাপার হলো একটা আইফোনের মডেল বছর বছর পরিবর্তন করা গেলেও জ্বালানি উৎপাদন টেকনোলজির ট্রান্সফরমেশন এবং তার সঙ্গে জিরো এমিসন বা বেশ কম এমিসনের টেকনোলজি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে বিশ্বের ৯০-৯৫ ভাগ দেশের ও জনসাধারণের।

তাহলে কি জলবায়ু পরিবর্তন আজীবন গ্লোবাল ইস্যু হয়ে থাকবে। বেশির ভাগ অস্ট্রেলিয়ান, আমেরিকান, ব্রিটিশ, ইউরোপিয়ানদের একই রকম মতামত। শুধু বলেন, ‘খেয়ে বাঁচি, ক্লাইমেট ইজ নান অব মাই বিজনেস।’ পরিবর্তন আনতে গেলে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন অনেক জরুরি আর ক্ষমতাবান দেশগুলোর একযোগে কাজ করা ও পুঁজি বিনিয়োগ করা। আর তা যদি না হয়, তাহলে মানুষ নিজেই নিজেদের প্ল্যানেট ধ্বংস করে দেবে।

পুনশ্চ: পুরো লেখাটা পড়ার পর অনেক সমালোচনা হতে পারে। কোনো দেশ, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ছোট বা অসম্মান করে লেখা হয়নি। আমি ক্ষমাপ্রার্থী; যদি কেউ এমন ভাবেন। আমি জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে যেকোনো ফিজিবল অ্যাকশন নেওয়ার পক্ষে। জলবায়ুর পরিবর্তনের অনেকগুলো কারণের মধ্যে কার্বন এমিসন একটি বড় কারণ।