নাটক জীবনের কথা বলে

‘ফিরে এসো’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: লেখক
‘ফিরে এসো’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: লেখক

নাটকের মণিকা চরিত্রে রূপদান করেন অবন্তি সেনগুপ্ত। নারী পেতে চান তাঁর প্রিয়জনকে। বিয়ের রাত্রেই উধাও হয়ে যান। অন্তর্জ্বালা কিংবা দ্বান্দ্বিক অভিঘাতে ফিরেও আসেন। কিন্তু সংঘমিত্র দত্ত মানতে পারেন না। কী দুঃসহ দুঃখ! ছোট সন্তান তার বাবাকে দেখেনি। ওই পাইনগাছের তলায় ঘুমিয়ে তাঁর স্বামী। সঙ্গে তাঁর বড় সন্তান।

অবন্তি বলেন, পাগল হতে পারি, প্রতারক নই। দৃঢ়তা নিয়ে বলেন, কেউ তাঁকে স্পর্শ করেনি। ছেলের মা কি তা মানতে পারেন? সত্যের মন্ত্রকে অপমান করেছে, তেজি সে উচ্চারণ।

বিপরীতে যুবতী তাঁকে ব্যাখ্যা করেন, পরপুরুষের হাত ধরে গিয়েছিলাম। তারপরও নিষ্পাপ বলার মতো সাহস আছে।...খুন করো...আগুনে পোড়াও। জ্বলে ওঠেন।

এর মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে, বিশাল গুড়ুম আর নেই। মায়ের ছোট ছেলেকেও বিদায় নিতে হয়েছে। যেন সবকিছু ভেঙে পড়ে।

‘ফিরে এসো’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: লেখক
‘ফিরে এসো’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: লেখক

আসেন সুনন্দা কুণ্ডু। নাটকে পর্বত পুত্রকে হারিয়েছেন। মা বলেন, এসো কাঁদি সবাই মিলে। আমি আমার সন্তানের জন্য, তুমি তোমার আপনজনের জন্য। এ ক্ষেত্রে সুনন্দার অভিব্যক্তি দর্শককে নাড়া দিতে পেরেছে।

সংঘমিত্র দত্ত নিজে কাঁদলেন, দর্শকদের কাঁদালেন। এই পরিবারের প্রতিবেশী অদিতি চক্রবর্তী। সুখে-দুঃখে পাশে থেকেছেন। ভালোবাসা পেয়েছেন দর্শকের। অবন্তির কথা। নারী ন্যায় কি অন্যায় করেছেন, দর্শক সে বিবেচনায় যাননি। অভিনয়ের পারঙ্গমতা তাঁকে সবার মনে জায়গা করে দিয়েছে। তাঁর ছায়াসখী রুনি আচার্যও অভিনয়ে মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন।

মূল লেখা ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার গল্প ‘ব্লাড ওয়েডিং’। এখানে দর্শনকে উপস্থাপন কত মুনশিয়ানায়! কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে বরফ সরে গেলে সে জায়গা অপূর্ণ থাকে না। মনিকার জীবনই বুঝি এর দৃষ্টান্ত। নাট্যরূপ দিয়ে চন্দন সেন সার্থক। নদীর খাড়ির পাশ দিয়ে চলার সাহস নেই। বলছিলেন পাহাড়ি যুবক বিশাল গুড়ুম সম্পর্কে। এ চরিত্রে অতনু বাগ অভিনয়, উচ্চারণে নিজেকে দেদীপ্যমান করে তুলেছেন।

‘রক্তিম বন্ধন’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: লেখক
‘রক্তিম বন্ধন’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: লেখক

একই সন্ধ্যায় আরেকটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। একই নাট্যকার। নাটকের নাম ‘ফিরে এসো’। মোহনীয় আয়োজনে শুরুর আগে থাকে কিছু করণীয়। শর্মিষ্ঠা পাঞ্জাবি সেই কাজই করলেন। সঙ্গে দিশা মুখোপাধ্যায়। মঞ্চে আহ্বান করলেন অধ্যক্ষ মীর আনিসুল হাসানকে। গুণীর হাতে দুই শিশু তুলে দিল ভালোবাসার ফুল। অনুষ্ঠান ঝলমল করে উঠল।

মা-বাবার স্বপ্ন, সন্তান হবে ভুবনবিজয়ী। মেধাবী সন্তান যায় বিদেশে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের জীবনে। এদিকে অর্পিতা রাহার দীর্ঘশ্বাস কে দেখে! সন্তান থেকেও না থাকার কষ্ট। ওরা এত মেধাবী কেন হলো! হাহাকার নারীর। তাঁর খুসখুসে কাশি জীবন্ত একটি বাতাবরণ তৈরি করে। এর আগেও তিনি মায়ের ভূমিকায় রূপ দিয়েছেন। এবারও মা কিংবা মামির চরিত্রে। নারী পেশাজীবী শিল্পীদের মতোই মুনশিয়ানার স্বাক্ষর রাখলেন।

এ বাড়ির সুহৃদ ইন্দ্রজিৎ দত্ত। সাদা জামা ও ডাক্তারি ব্যাগে প্রশংসনীয় অভিনয় করেছেন। বাড়ির কাজের লোক হিসেবে সোহম পাঞ্জাবির সংলাপও ছিল চোখে পড়ার মতো। নাটকে শিপ্রা হালদার বিয়ে করবেন, কানাডায় যাবেন। এ বিয়েতে সায় দিতে পারেন না অর্পিতা। কারণ, এই বিদেশ বিদেশ কি ভালো লাগার? এ বেলায় রেশমির ভূমিকায় তরুণী নিজের জায়গাটাকে শিল্পের ঔজ্জ্বল্যে দেখাতে পেরেছেন।

‘রক্তিম বন্ধন’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: লেখক
‘রক্তিম বন্ধন’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: লেখক

মামা-মামির বাড়িতে ভাগনে ও ভাগনেবউ ওঠে ছেলের চোখের চিকিৎসা নিতে। জয়দীপ চক্রবর্তীর কাছে মামাবাড়ি মানে বিশাল বাড়ি। অমাপা সুযোগ নিয়ে দোর্দণ্ড হাসি-খুশির জীবন তাঁর। তবে ছেলের জন্য ভেতরে রক্তক্ষরণ যে হয় না, তা নয়। ভাগনেবউ ঝুমা বিশ্বাসের কথা বা অনুভবে এ কষ্ট সমানভাবে প্রতিফলিত। বাঁকুড়াতে খরা হলেও তরুণী মায়ের চোখে অঝোর ধারা। দারুণ এক আবেগময় মুহূর্ত তুলে আনেন। শ্রোতারা বিমুগ্ধ হন। সমীর বিশ্বাস সন্তান কাছে না থাকার বেদনাকে ঢাকতে পারেন না। বুকের ব্যথা কষ্টে সংবরণ করার চেষ্টা করেন। দর্শকের আনুকূল্য পান। জাত শিল্পী বলে কথা! গোটা হল যেন প্রতিটি সন্তানকে দারুণ কোরাসে বলে ওঠে, ফিরে এসো ভালোবাসার বন্ধনে।

নাটক জীবনের কথা বলে। ব্যক্তির মনোজগৎ ও সমাজ জীবনের চিত্র নাটকে দেখানো হয়। এই নাটকই দুই বাংলার সংস্কৃতির মেলবন্ধনের কাজটি করতে পারে। বোধ করি, সে কারণেই আয়োজনের জন্য বাংলাদেশ স্কুল অডিটোরিয়ামকে বেছে নেওয়া হয়। ১৮ অক্টোবর মঞ্চস্থ হয় নাটক দুটি।

সন্ধ্যাকালীন আয়োজনের দ্বিতীয় অর্ঘ্য ‘রক্তিম বন্ধন’ এক বিয়োগান্ত আলেখ্য।

অবন্তি ধনীর দুলালি। বাবা চেয়েছিলেন কন্যার সুখময় একটি জীবন। কিন্তু বিয়ের রাতেই উল্টে গেল সব। প্রতিটি পলে–অনুপলে দগ্ধ হন পিতা। অর্ণব দত্ত এসব ফুটিয়ে তুলেছেন নিখুঁতভাবে। শ্রদ্ধা কুড়িয়েছেন সবার।

মঞ্চে কলাকুশলী, অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা। ছবি: লেখক
মঞ্চে কলাকুশলী, অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা। ছবি: লেখক

শুভাশীষ আচার্য এখানে কমলালেবুর বাগানে আপেল চাষ করেছেন। অভিনয়েও সোনা ফলিয়েছেন। পোড় খাওয়া মা শেখান ছেলেকে। চাঁদ দেখে গলে যাওয়া যাবে না। লড়ে জিততে হবে। যত কঠিন সংঘর্ষ, তত সুন্দর জয়। মায়ের শিক্ষায় বলীয়ান হয়ে ওঠেন পুত্র।

বিমূর্ত কিছু চরিত্র কাঠুরিয়া, চাঁদ, সুমি নাটকটিকে দিয়েছে এক অনন্য রূপ। অরিজিৎ শিকদার, সুতনু অধিকারী করেন অরণ্যের বয়ান। ফাঁকে বলেন, ভালোবাসে যদি দেরি করল কেন! শ্রোতা বিনি রায় আর প্রীতিকা রায়ের মুখে শোনেন কাব্যিক প্রার্থনা। তপ্ত হৃদয়ে দাও উত্তাপ সঞ্চারী...।

অন্যদিকে ছোটরা রাজা তাদের রাজার রাজত্বে। আস্থা সাংহাই সে প্রমাণ রেখেছে। আর রাখবে নাইবা কেন! মা যাঁর ছন্দা ভাদুড়ী সাংহাই। নাটক যাঁর জীবন। এখানে তিনি একটা নাটকে প্রম্পট করেছেন। আর ছোটদের অন্য জন আয়ান রাহা। ঠিকই ধরেছেন। গর্বিত অর্পিতা রাহা তার মা।

মঞ্চসজ্জায় ছিলেন সোম দত্ত বাগ। আবহ সংগীতে সংঘমিত্র মিশ্র, আলোকসজ্জায় অরিজিৎ সেনগুপ্ত। নেপথ্যে কাজ করেছেন সুমন চক্রবর্তী। গুণ আর মহাগুণের সমন্বয়। তা না হলে কি এমন সৃষ্টি সম্ভব! একটি পর্যালোচনা লেখার অনুরোধ জানালেন এপার বাংলার এক বিদগ্ধ শ্রোতা। নাসির যোশী। তাঁরই এই বিস্ময়ের প্রকাশ।

মনে পড়ে রানা মুখার্জির কথা। তিনি আবুধাবিতে নাটকে ঝড় তুলেছেন। কথা উঠল, তাঁরই পরিকল্পনায় অডিটোরিয়ামের এই পর্দা। একসময় গৌতম ঘোষ এলেন। তিনি আহ্বান করলেন। আমরা গেলাম। বলা হলো, সাংস্কৃতিক কর্মে নিবেদিত এক প্রাণ।

নাটক দেখার অনুরোধ জানিয়ে ছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বরেণ্য অভিনেত্রী মানসী সিনহা। নাটকের প্রতি দর্শকের ভালোবাসা আশা করেছিলেন। আজ নাটকপাড়ায় প্রাণের বন্যা বয়ে গেল। গৌর ব্যানার্জি, সোনা ব্যানার্জি, মৌসুমী মুখার্জির চোখেমুখে সেই তৃপ্তি, সেই মুগ্ধতা।

কুমার চট্টোপাধ্যায় এসেছেন সপরিবার। দেখা হলো অনেক দিন পর। শুভেচ্ছা বিনিময় হলো চৈতালি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। দ্বিতীয় নাটকের শুরুতে মৌলিমা রায় ঢুকছেন হলে। একরাশ হাসি। প্রকৃতির কন্যা। তাঁরও আনন্দ আনন্দ অনুভূতি।

দর্শকদের একাংশ। ছবি: লেখক
দর্শকদের একাংশ। ছবি: লেখক

পৃথ্বীনাথ মুখার্জি জায়গা বেদখল হতে দেননি। টুপ করে এসে গেছেন মধ্যখানে। ক্লিক! ক্লিক! মধ্যমণিরা মধ্যখানেই থাকেন। আলো ঝলমল পরিবেশ। হাত মেলালাম। টুটুন নন্দী, সোনালি হালদার, চৈতালি চক্রবর্তী তখন একসঙ্গে।

সংঘমিত্র মল্লিক। ইংরেজি সাহিত্য তাঁর বিষয়। মুখে ভালো লাগার চিহ্ন। প্রজ্ঞা পারমিতা আছেন একদল নিয়ে। গল্প হচ্ছে অনবদ্য সময়টি নিয়ে। দেবাশীষ বন্দ্যোপাধ্যায় চলছেন। কথা হয়। অশোক পাঞ্জাবির সঙ্গে আলাপ সেই আসন থেকে। অনুবাদ করেছেন মঞ্চকে। আমি শুনছি মনোযোগে। এক সারি পেছনে ছিলেন রাখী রায়। ছবি তোলার দায়িত্ব নিয়েছেন। সুতরাং সামনের সারিটি তাঁর জন্য জুতসই। আমি আমার কাগজপত্র সরিয়ে নিলাম। বসলেন সেখানে। এক একটা দৃশ্য আসছে আর জ্বলে উঠছে তাঁর ক্যামেরা।

আনিসুল হাসান আমাকে টেনে নিলেন মঞ্চে, আনলেন নাট্যনির্দেশককে। আমরা বন্দী হলাম। সে ছবির কবি প্রহ্লাদ রায়।

একটা নাটক তার দর্শককে কিছু বলতে চায়। নাট্যকার একটি ধারণাকে অবলম্বন করে কাহিনি দাঁড় করেন। আর পরিচালকের কাজ হলো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মাধ্যমে সেই ধারণাকে দর্শকের সামনে তুলে ধরা। উদ্যোগটি ভারতীয় বাঙালি সমাজের। জয়দীপ চক্রবর্তী সেখানে এই দায়িত্ব পালন করেছেন গভীর আন্তরিকতায়। দর্শক দেখলেন সমাজের প্রতিচ্ছবি। শ্রোতা শুনলেন জীবনের কথা। আহ কী ভালো লাগা!