টরন্টোয় কবিতাসন্ধ্যা মানুষ জাগবে ফের

বাচিকশিল্পীরা কবিতা পাঠ করছেন। ছবি: লেখক
বাচিকশিল্পীরা কবিতা পাঠ করছেন। ছবি: লেখক

অবক্ষয়। হ্যাঁ, আদর্শের অবক্ষয় ও মূল্যবোধের অবক্ষয় এখন সর্বত্র। শুধু অবক্ষয় বললে ভুল হবে। বিশ্বজুড়ে এখন অনৌচিত্য। ন্যায় ও নীতির প্রসঙ্গে বর্তমান সমাজ, রাষ্ট্র, সংসার কিংবা আইন-আদালত—এগুলোর কোনো কিছুর ওপরই সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হওয়া যায় না আর।

অন্যায় ও অবিচার এমনভাবে বেড়ে চলছে যে ন্যায়বোধ ধীরে ধীরে নীরব হয়ে পড়ছে। ভয়ে নির্বাক হয়ে পড়ছে মানুষ। জীবনের মায়া নতুবা স্বার্থের লোভে সবাই একপ্রকার স্বেচ্ছায় অন্ধত্ব গ্রহণ করছে যেন। সুযোগে হত্যা, খুন ও ধর্ষণের মতো নিকৃষ্টতর অপরাধগুলো হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তে, ওই অপরাধগুলোতে ছেয়ে যাচ্ছে পৃথিবী।

এর মধ্যেও কিছু সচেতন মানুষ ন্যায়ের পক্ষে হাল ধরে থাকেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে অন্যকে অনুপ্রাণিত করেন। আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। স্বপ্ন দেখেন শান্তির এবং অন্যকেও একই স্বপ্ন দেখতে সহায়তা করেন।

সম্মাননা পর্বের দৃশ্য। ছবি: লেখক
সম্মাননা পর্বের দৃশ্য। ছবি: লেখক

হ্যাঁ, টরন্টোর বাচিকশিল্পীদের সংগঠন বাচনিক ওই সচেতন মানুষদেরই প্রতিকৃতি। একগুচ্ছ স্বপ্ন নিয়ে এ বছর ‘মানুষ জাগবে ফের’ স্লোগানে তারা তাদের ষষ্ঠ বার্ষিক আবৃত্তিসন্ধ্যা আয়োজন করে। অনুষ্ঠিত হয় গতকাল শনিবার (২ নভেম্বর) ব্লেসড কার্ডিনাল নিউম্যান ক্যাথলিক হাইস্কুলের অডিটরিয়ামে।

প্রথমেই ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ত্রাণ’ কবিতা সমবেত উপস্থাপনা। এর পরপরই বাচনিকের কান্ডারি মেরী রাশেদীনের সঞ্চালনায় প্রদীপ প্রজ্বালন করে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন টরন্টোর বিভিন্ন পেশার গুণীজন। তাঁরা প্রদীপগুলো হস্তান্তর করেন নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের হাতে।

বাচনিক উপদেষ্টা রাশেদা মুনিরের সঞ্চালনায় কবি আসাদ চৌধুরী কবি মাসুদ খানের হাতে তুলে দেন বাচনিক সম্মাননা ২০১৯। সম্মাননা পর্বে মঞ্চে উপস্থিত থেকে বিভিন্নভাবে মাসুদ খানকে সম্মান জানান ওন্টারিও প্রদেশের সংসদ সদস্য ডলি বেগম, টরন্টোর বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল নাইমউদ্দিন আহমেদ, বাচনিক উপদেষ্টা দেলওয়ার এলাহি ও হাসান মাহমুদ।

কবি মাসুদ খানের হাতে সম্মাননা তুলে দেন কবি আসাদ চৌধুরী। ছবি: লেখক
কবি মাসুদ খানের হাতে সম্মাননা তুলে দেন কবি আসাদ চৌধুরী। ছবি: লেখক

শিল্পীরা উত্থিত কণ্ঠে এক এক করে পাঠ করেন আসাদ চৌধুরী রচিত ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’, হুমায়ুন আজাদ রচিত ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’, নাজিম হিকমত রচিত ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় অনূদিত ‘জেলখানার চিঠি’, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ রচিত ‘মাংসভুক পাখি’, আনিসুল হক রচিত ‘মানুষ জাগবে ফের’, শক্তি চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘দাঁড়াও’, নির্মলেন্দু গুণ রচিত ‘রাজদণ্ড’, কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘কান্ডারি হুঁশিয়ার’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘কোথায় আলো’, সৈয়দ শামসুল হক রচিত ‘পরানের গহীন ভিতর’ ও কেষ্ট মণ্ডল রচিত ‘গান্ধারী’ কবিতাসহ আরও অনেক শক্তিশালী, দৃঢ়চেতা কবিতা।

অনুষ্ঠানের শিরোনামের সঙ্গে মিল রেখে কবিতা নির্বাচনে শিল্পীরা তাঁদের মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। নির্বাচিত প্রতিটি কবিতাই বলিষ্ঠ বার্তাবাহক। শিল্পীদের পরিবেশনাও ছিল সাবলীল ও নান্দনিক।

বাচনিকের বার্ষিক আবৃত্তিসন্ধ্যার অন্যতম আকর্ষণ, প্রবাসে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের বাচিক শিল্পীদের পরিবেশনা। বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা। নতুন প্রজন্মের যারা কবিতা পাঠ করেছেন, তাঁরা হচ্ছেন সম্পূর্ণ সাহা, নাজিয়া হক, তানিয়া হক ও অনুভা নাথ।

নতুন প্রজন্মের কবিতা পাঠ। ছবি: লেখক
নতুন প্রজন্মের কবিতা পাঠ। ছবি: লেখক

উপস্থিত দর্শক–শ্রোতা পিনপতন নীরবতায় উপভোগ করেন পুরো অনুষ্ঠান। মেরী রাশেদীনের কণ্ঠে ‘গান্ধারী’ কবিতা উপস্থিত সবার মধ্যে একপ্রকার আলোড়ন সৃষ্টি করে। তাঁরা শিল্পীর কণ্ঠে গান্ধার রাজকন্যার আহ্বান শুনতে পান, ‘গৃহে গৃহে প্রজ্বলিত হবে লাখ লাখ গান্ধারী, যারা প্রিয়তম প্রেমে স্বেচ্ছা নিবেদনে কুণ্ঠিত হবে না। কিন্তু আর গান্ধারীর অন্ধতা নয়। পতি অন্ধ হলে নিজের দৃষ্টির তীক্ষ্ণ আলোতে পথ দেখাবে তাকে, পথ দেখাবে সন্তানের শিক্ষা। তার সহস্র সূর্যের জ্যোতিঃপুঞ্জে উদ্ভাসিত হবে সংসার। আলোকিত হবে ভুবন। রক্ষা পাবে আরও সহস্র কুরুক্ষেত্র।’

আবার সমবেত কণ্ঠে মহাদেব সাহা রচিত ‘শান্তির গান’ কবিতা পাঠ করে শিল্পীরা তাঁদের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের বীজ বপন করেন দর্শক-শ্রোতাদের হৃদয়ে, ‘এই পৃথিবীতে আমরা শান্তি চাই’।

কবিতার সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: লেখক
কবিতার সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: লেখক

আশাবাদী একঝাঁক শিল্পীদের ইতিবাচক পরিবেশনায় উদ্দীপ্ত হয়ে যদি একজন মানুষও নিজের দুর্বলতা ও ভুল নির্ণয় করতে পারেন এবং স্বেচ্ছা-অন্ধতা থেকে মুক্তি লাভ করতে সক্ষম হন, তবেই হবে শিল্পীদের এমন আয়োজনের সার্থকতা। প্রতিটি সচেতন মানুষের কামনা তো এটাই—স্বপ্নের বীজ অবচেতন মনেও অঙ্কুরিত হবে, বড় হয়ে ছড়িয়ে যাবে ধীরে ধীরে।

কবিতার সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: লেখক
কবিতার সঙ্গে নৃত্য পরিবেশনা। ছবি: লেখক

অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেছেন অরুণা হায়দার, আসমা হক, ইরা নাসরিন, কাজী আবদুল বাসিত, কাজী হেলাল, ফারহানা আহমদ, ফ্লোরা নাসরিন, ম্যাক আজাদ, মেরী রাশেদীন, রাশেদা মুনির, সাবরিনা নুর, সুমি রহমান ও হোসনে আরা জেমী।

বিভিন্ন কবিতার সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেছেন তাসনীম আহমেদ, রায়না রাকিব, হৃদা রহমান ও রচনা খন্দকার।

প্রদীপ হাতে নতুন প্রজন্ম। ছবি: লেখক
প্রদীপ হাতে নতুন প্রজন্ম। ছবি: লেখক

তবলায় সংগত করেছেন রনি পালমার, কি–বোর্ডে আকিব আক্তার ও গিটারে আজিম অপূর্ব। শব্দ ও আলোক সংযোজন করেছেন হাসান ইমাম ও কে এম আনিসুর রহমান। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গেয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান।