রজনীগন্ধা

রজনীগন্ধা। প্রতীকী ছবি
রজনীগন্ধা। প্রতীকী ছবি

ফেসবুকে লিখছি মাত্র চার বছর হলো। এখনো হাঁটি হাঁটি পা। টলি টলি গা। চল্লিশ বছর আগে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলাম। থাকি জার্মানির এক অজপাড়াগাঁয়ে। তাই বাংলা ভাষার চর্চা আর তেমন একটা করা হয়ে ওঠেনি।

মাঝেমধ্যে জার্মান পত্রিকায় মোটিভেশনের ওপর লিখে হাততালি পাই। মন পড়ে থাকে কিন্তু বাংলাদেশে কাদামাটির সোঁদা গন্ধে। কলমিলতা আর বেত ফুলের নিবিড় আলিঙ্গনে।

ফেসবুকে আমার লেখাগুলোয় যত লাইক পাই, তার চেয়ে বেশি কড়া নাড়ে আমার মেসেঞ্জারে। আমার ফেসবুকের বন্ধুবান্ধবীরা তাঁদের মানসিক যাতনা আমার কাছে প্রকাশ করেন উপশমের আশায়। আর আমিও চেষ্টা করি মনোবিজ্ঞানে আমার এত দিনকার অভিজ্ঞতা দিয়ে তাঁদের ক্ষততে প্রলেপ দিতে।

কয়েক দিন আগে ঢাকার সময় রাত তিনটার দিকে হঠাৎ একটি মেসেজ পেলাম এক অচেনা ভদ্রমহিলার কাছ থেকে। ‘আপনার কি পাঁচ মিনিট সময় হবে কথা বলার জন্য?’

ঘড়ি দেখে অবাক হলাম। মনে মনে বললাম, বাংলাদেশে কি রাতে কেউ ঘুমায় না!

যা হোক, ওনার আইডিতে গিয়ে দেখলাম তিনি কে। একটু বয়স্কা ভদ্রমহিলা। তিনি যখন যুবতী ছিলেন, অনিন্দ্যসুন্দরী ছিলেন দেখেই বোঝা যায়। ভদ্রতার খাতিরে বললাম, ‘বলুন।’

উনি লিখলেন: আচ্ছা, আপনি আপনার একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন, কাউকে ভুলে যেতে চাইলে বিকল্প বের করতে হয়। তাহলেই তাকে ভোলা যায়। কিন্তু কই, আমি তো ভুলতে পারছি না আমার প্রথম ভালোবাসাকে। আমি আমার সবকিছু নিয়েই ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু নিজের একান্ত সময়টুকুতে তাকে মনে পড়ে ভীষণ।

আমি লিখলাম: আপনি একটু খোলাসা করে বলুন না। যাতে আমি বুঝতে পারি।

: জানেন, আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম রসায়ন বিভাগে। কার্জন হলে ওর সঙ্গে দেখা হতো। ও ছিল পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র। অপশনাল ছিল ওর রসায়ন। তাই রসায়ন ক্লাস করতে এলেই ওকে দেখতাম। ওকে দেখার জন্য সব সময় পেছনের বেঞ্চ বেছে নিতাম আমি। খুব ঘন কালো চুল ছিল ছেলেটির। খুব ভালো লাগত আমার ওকে। তারপর কেন জানি ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।

আমি বললাম, আপনি কি তাকে জানিয়েছিলেন যে আপনি তাকে ভালোবাসেন?

: না, কীভাবে জানাব বলুন? ওর সঙ্গে আমার কখনো কথা পর্যন্ত হয়নি। আর সে সময় তো মেয়েদের ভালো লাগার কথা নিজে জানানোর চল ছিল না। তাই না? তা ছাড়া এখনকার মতো তো আর স্মার্টফোন ছিল না, ফেসবুকও ছিল না।

: কোন সালের ঘটনা এটা? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

তিনি সালটি বললেন। আমি চিন্তা করে দেখলাম, ওই সময়তো আমিও ছিলাম কার্জন হলে। কই, কোনো উত্তমকুমারের মতো ঘন কালো চুলের সুদর্শন কাউকে তো মনে পড়ছে না।

বললাম, আপনি কি আকারে–ইঙ্গিতেও তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেননি যে আপনি তাকে ভালোবাসেন?

: করেছিলাম কয়েকবার। কিন্তু সে খুব একটা পেছন ফিরে তাকাত না। তাই একবার সাহস করে ফাইনাল পরীক্ষার আগে তার পাশেও বসেছিলাম। কিছু বলতেও চেয়েছিলাম। কিন্তু...।

: কিন্তু কী?

: সে সারাটি ক্লাস মুখে বই গুঁজে বসে ছিল। আমি আজও জানি না সে আমাকে খেয়াল পর্যন্ত করেছিল কি না!

আমি মনে মনে বললাম, নিশ্চয়ই কোনো গর্দভ ছেলে, সারা দিন বই মুখস্থ করত। এত সুন্দরী একটি মেয়ে তাকে ভালোবাসত, অথচ অপদার্থটি কিছুই বুঝলও না। আবার পদার্থবিজ্ঞানে পড়ত? গাধা একটা!

এরপর বললাম: আচ্ছা, তারপর কী হলো?

: ইতিমধ্যে আমাদের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এরপর খুব সাহস করে একটি চিঠি লিখেছিলাম তাকে উদ্দেশ্য করে। তাকে প্রথম দেখার ক্ষণটি থেকে শুরু করে আমার প্রতি তার অজ্ঞতা, সেই কারণে আমার মান-অভিমান সমস্ত কিছু লিপিবদ্ধ করেছিলাম ওই চিঠিতে। খুব সুন্দর একটি দিনও ঠিক করেছিলাম সেটি দেওয়ার জন্য। সঙ্গে ছিল বিশেষ একটি জিনিস।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী?

: শুকনো কিছু রজনীগন্ধা। অনার্সে প্রথম বর্ষে তারা যখন প্রথম আমাদের ক্লাসে এসেছিল, পদার্থবিজ্ঞানের সব শিক্ষার্থীকে রজনীগন্ধা উপহার দেওয়া হয়েছিল। ক্লাস শেষে দেখলাম, সে তার ফুলটি রেখে গিয়েছে। আমি চার বছর ধরে সেগুলো আগলে রেখেছি। সেই ফুলগুলোই চিঠির সঙ্গে দিয়েছিলাম।

: কোন দিনটি বেছে নিয়েছিলেন?

: আমাদের মাস্টার্সের প্রথম ক্লাসের দিনটি।

: তো চিঠি পেয়ে সে কী বলেছিল?

: তার বলার কোনো অবসর মেলেনি।

: কেন?

: শুনলাম ও নাকি বিদেশে চলে গেছে।

: তারপর?

: তারপর আর কী? আমার বিয়ে হয়ে গেল আব্বার বন্ধুর ছেলের সঙ্গে। তাকে নিয়ে ঘর করছি। দুই মেয়ে। এত বছর হয়ে গেল, তবু জানেন কী মনে হয় আমার, যদি তার ওই ঘন কালো চুলে একবার হাত বুলাতে পারতাম, শুধু একবার তাকে জিজ্ঞেস করতাম, আমাকে কি কখনো তোমার ওই চোখ দিয়ে দেখেছিলে ভালো করে?

লেখকের পুরোনো দিনের ছবি
লেখকের পুরোনো দিনের ছবি

আমি ভদ্রমহিলাকে কী বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বললাম: এখন তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগ। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম আরও কত–কী আছে! ভদ্রলোক নিশ্চয়ই কোথাও আছেন। আপনার কাছে কি কোনো ছবি আছে তার? আমার ফেসবুক পেজে আমার প্রচুর ভক্ত রয়েছেন। ওনার ছবি পোস্ট করলে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন।

: জানেন, ও বিটিভিতে মাঝেমধ্যে অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করত। আমি অনেক কষ্টে ওই সময় ক্যামেরা জোগাড় করে টিভি স্ক্রিন থেকে ওর ছবি তুলে রেখে ছিলাম আমার ছোট ভাইকে দিয়ে। আমার কাছে ওই চিঠিটি আর নেই কিন্তু ছবিটি আছে। আমি আপনাকে পাঠাচ্ছি, তবে অনেক পুরোনো ছবি আর মুখটিও তেমন ভালো দেখা যায় না।

আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, কেউ কাউকে না পেয়েও এতগুলো বছর ভালোবেসে পার করে দিতে পারে?

কয়েক মিনিট পরে ছবি চলে এল। ছবি দেখে আমার চোখের পলক পড়ছে না।

কোনোভাবে ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ আর শুভরাত্রি জানিয়ে ফেসবুক থেকে বেরিয়ে এলাম।

আমার পুরোনো ফটো অ্যালবামটি খুললাম। পেয়ে গেলাম পুরোনো দিনের কিছু ছবি।

আমি যখন বিটিভিতে একটি অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিচ্ছিলাম, সেই সময়ে তোলা।

ছবিটির পেছনে প্রযোজকের মন্তব্য, ক্যামেরা চালু হয়ে গেলে কখনো হাত দিয়ে টাই নাড়াচাড়া করতে হয় না, খুবই দৃষ্টিকটু, বুঝলে পদার্থবিদ?

রাত গভীর হলো। আমি জানালা খুলে দিলাম, বাইরে শীতের শুভ্র তুষার নেমে আসছে ধরণিতে। গানের সুরে সুরে শুভ্র তুষারগুলোকে মনে হলো অজস্র রজনীগন্ধা।

ইউটিউবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গান বাজতে থাকল—

‘এক গোছা রজনীগন্ধা হাতে দিয়ে বললাম, চললাম।।
বেশ কিছু সময় তো থাকলাম, ডাকলাম, মন রাখলাম
দেখলাম দুটি চোখে বৃষ্টি, বৃষ্টি ভেজা দৃষ্টি
মনে কর আমি এক মৃত কোনো জোনাকি
সারা রাত আলো দিয়ে জ্বললাম।।
এখানেই সবকিছু শেষ নয় বেশ নয় যদি মনে হয়
লিখে নিয়ো গল্পের শেষটা, থাক না তবু রেশটা
দেখো না গো চেয়ে তুমি আনমনা চরণে
কোন ফুল ভুল করে দললাম।।