কাতারে অন্য রকম স্বপ্ন

একটি দেশের পর্যটন, সংস্কৃতি, শাসনব্যবস্থা, রপ্তানি, জনশক্তি ও বিনিয়োগ—এই ছয়টি ক্ষেত্র বিবেচনা করে প্রতিবছর ‘নেশন ব্র্যান্ড ইনডেক্স’ শীর্ষক তালিকা প্রকাশ করে ‘এনহল্ট-জিএফকে রোপার’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান। চলতি বছর তালিকার শীর্ষে রয়েছে জার্মানি। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর পরাশক্তি আমেরিকা নেমে গেছে ষষ্ঠ স্থানে। তবে আশার কথা, শীর্ষ ৫০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম এসেছে।

বাংলাদেশে তৈরি উন্নত মানের পোশাকশিল্পের চমকপ্রদ সাফল্যই এর কারণ বলে মনে করছেন সবাই। এখন বড় বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোরের নামীদামি ব্র্যান্ডের জামাকাপড় বহন করছে ‘মেড ইন বাংলাদেশে’ ট্যাগ, যা দেখে দেশ নিয়ে গর্ব হয়। শুধু পোশাকশিল্প কেন, আরও অনেক কিছুতেই ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডিং সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিবাচক দিক যে নেই, তা নয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনামে বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক খবরই বেশি প্রাধান্য পায়। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশ শ্রমিক ও গৃহপরিচারিকা (খাদ্দামা) সরবরাহকারী দেশ হিসেবে পরিচিত। অথচ আমাদের দেশে প্রচুর দক্ষ জনশক্তি থাকলেও ইতিবাচক প্রচারণার অভাবে মধ্যপ্রাচ্যের নীতিনির্ধারকদের কাছে সেই খবর যাচ্ছে না। উপসাগরীয় অঞ্চলের ধনী দেশ কাতারে বসবাসরত অভিবাসী জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশি কমিউনিটি দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন কমিউনিটির তুলনায় আমরা দেশের ভাবমূর্তিকে সেভাবে তুলে ধরতে পারছি না। বরং কিছু মানুষ নানা বেআইনি কাজে জড়িয়ে পড়ার ফলে বাংলাদেশ কমিউনটির সুনাম এখন চরম ক্ষতিগ্রস্ত। তাই একটি দেশ ও জাতি হিসেবে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড তৈরির এখনই সময়।

আমদানি ও জ্বালানিনির্ভর অর্থনীতি থেকে সরে এসে বহুমুখী অর্থনীতি গড়ে তুলতে কাতার জরুরি ভিত্তিতে ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে কাতার। আগামী ৩–৪ বছরের মধ্যে কাতারে প্রায় চার হাজার গ্রিনহাউস নির্মাণ করা হবে। শুধু কৃষি খাতে গত বছর প্রায় ২৩ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে শ্রমশক্তি আমদানি কমিয়ে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিল্প–কারখানা চালুর পরিকল্পনা করছে কাতার। তাই কাতারের কৃষি ও শিল্প খাতে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি ও বিনিয়োগের উপযুক্ত ক্ষেত্র হতে পারে।

সড়ক যোগাযোগ, বিমানবন্দর, নদী খনন ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নে কাতার ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে আমেরিকা ও ইউরোপের প্রধান প্রধান শহরে আবাসন খাতে কাতার এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। কাতারের বিনিয়োগ সংস্থা সম্প্রতি ভারতে আবাসন খাতে ২০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশের অবকাঠামো খাত ও প্রধান প্রধান শহরে বাসস্থানের চাহিদা মেটাতে কাতারের বিনিয়োগ বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া শিক্ষা, প্রযুক্তি ও ক্রীড়া খাতে কাতারে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে।

কাতারের সঙ্গে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ আনুমানিক ১২ কোটি ডলার। কাতার থেকে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৪০ লাখ টন ইউরিয়া সার আমদানি করে থাকে। সম্প্রতি কুতুবদিয়ার মাতারবাড়ীতে প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল নির্মাণের জন্য দরপত্র জমা দিয়েছে কাতার। বাংলাদেশের সঙ্গে কাতারের বাণিজ্য মূলত জ্বালানি খাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হলেও অন্যান্য খাতে দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ২০১৭ সালে প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের আরোপিত অবরোধের পর কাতারে বাণিজ্যের নতুন দ্বার খুলে গেছে। কাতার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গেও বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূচনা করেছে। ফলে এখন কাতারের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশের অনুকূল পরিবেশে সৃষ্টি হয়েছে।

কাতারের নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের জনশক্তি, পর্যটন, দেশে তৈরি পণ্য, বিনিয়োগ ও অন্যান্য সেবা তুলে ধরার জন্য ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের একটি বাণিজ্য মেলার আয়োজন করছে কাতার প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন বাংলাদেশ ফোরাম কাতার। কাতারের বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যৌথভাবে আয়োজিত এই প্রদর্শনী আগামী বছরের ২৮ থেকে ৩০ জানুয়ারি দোহা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত দোহা এক্সিবিশন অ্যান্ড কনভেনশন সেন্টারে (ডিইসিসি) অনুষ্ঠিত হবে।

৬০ হাজার বর্গমিটারের এই প্রদর্শনী কেন্দ্রে ১০০টি স্টল বসবে। প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের কৃষি, ব্যাটারি, তার ও বিদ্যুৎ, সিমেন্ট, সিরামিক, তৈরি পোশাক, তথ্যপ্রযুক্তি, খাদ্য ও পানীয়, মত্স্য ও মাংস, আসবাব, চামড়া, আবাসন, প্লাস্টিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, জাহাজনির্মাণ, বস্ত্র ও পাট, প্রসাধন এবং পর্যটনসহ ১৮টি খাতের সেবাদাতা কোম্পানি যোগ দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। কাতারে বাংলাদেশি গ্রোসারির দোকান ছাড়া অন্যান্য বড় বড় শপিং মলে বাংলাদেশি পণ্য খুব একটা চোখে পড়ে না। তবে সুযোগ পেলে গুণগত মান বিচারে কাতারের বাজারে ঢোকার সক্ষমতা বাংলাদেশি পণ্যের রয়েছে। আশা করা হচ্ছে, বিএফকিউ আয়োজিত এই প্রদর্শনী কাতারে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার তৈরি করতে সাহায্য করবে।

মেড ইন বাংলাদেশ প্রদর্শনী আয়োজনে কাতারের বাংলাদেশ দূতাবাস ছাড়াও সহায়তা করছে কাতার সরকার। প্রদর্শনী চলাকালে বাংলাদেশ এবং কাতারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের ব্যবস্থা করা হবে। এই প্রদর্শনীর সঙ্গে কাতারের ব্যবসায়ীদের সংগঠন কাতার চেম্বারও জড়িত থাকবে। ফলে কাতারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী থেকে ভালো সাড়া পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রদর্শনীর পাশাপাশি কয়েকটি আলোচনা সভা আয়োজন, বাংলাদেশি খাবার উপস্থাপন, ফ্যাশন শো ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকবে।

কাতারে ডিসিসির মতো বিশ্বমানের একটি প্রদর্শনী কেন্দ্রে এত বড় আঙ্গিকে বাণিজ্য মেলার আয়োজন চাট্টিখানি কথা। এ জন্য যেমন প্রয়োজন অর্থের, তেমনি কাতার ও বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি ও নিরাপত্তা বিভাগের অনুমতি নিয়ে তাদের সহযোগিতা আদায় করার মতো জটিল প্রক্রিয়াও জড়িত। প্রবাসে এমন একটি আয়োজন দেশকে নিয়ে কাতার তথা বিশ্বের কাছে একটি সুন্দর বার্তা পৌঁছে দেবে এবং বাংলাদেশকে নিয়ে প্রচলিত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে সাহায্য করবে।

কাতারে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তি তৈরি করার এমন এক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ফোরাম কাতারকে সাধুবাদ জানাতে হয়। তবে এই আয়োজন সফল করতে কাতারে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটির সবাইকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

লেখক: নগর পরিকল্পনাবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ