তুরস্কে সাড়ে তেরো দিন

লেখক
লেখক

জার্মানির ডুসেলডর্ফ থেকে বেড়াতে গিয়েছিলাম তুরস্কের আন্তালিয়াতে। ৩ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের ফ্লাইট। ডুসেলডর্ফের তাপমাত্রা ছিল ১৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। তুরস্ক দিল উষ্ণ চুম্বন, ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।

আন্তালিয়ার ইমিগ্রেশনে দাঁড়িয়ে আছি। সঙ্গে আমার স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউ আর নাতনি। ওদের ইমিগ্রেশন কয়েক সেকেন্ডে হয়ে গেল। আমার পাসপোর্ট নিয়ে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর প্রতিটি পাতা ফটোকপি করলেন।

আমি ধৈর্য হারিয়ে বললাম, আপনি কি আমার পাসপোর্ট নিয়ে জার্মান ভাষা শিখছেন?

আর যায় কোথায়? তুর্কি মেজাজ। অস্ফুট স্বরে রাশিয়ান ভাষায় কী যেন বললেন। আমার কানে লাগল অতিপরিচিত রাশিয়ান একটি অশ্লীল শব্দ।

যা হোক, বিমানবন্দরের ঘোষণা তিনটি ভাষায় শোনা যাচ্ছে। তুর্কি, ইংরেজি আর রাশিয়ান ভাষায়।

আমি একটু হেসে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাকে বললাম, আপনি তো খুব সুন্দর রাশিয়ান বলেন!

তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার জন্ম কোথায়?

আমি বললাম, বাংলাদেশে।

এবার ভদ্রলোকের চোখ রসগোল্লার মতো গোল হয়ে গেল।

বললেন, জার্মান পাসপোর্ট, রাশিয়ান বলেন, জন্ম বাংলাদেশে। জাস্ট এ মোমেন্ট।

ভদ্রলোক কোথায় যেন ফোন করলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে জেমস বন্ড চেহারার কয়েকজন ভদ্রলোক আমাকে ঘিরে ধরলেন। দুই–একটি প্রশ্ন করেই এ যাত্রায় তাঁরা আমাকে ছেড়ে দিলেন। জার্মান পাসপোর্টধারীদের তুরস্কে কোনো ভিসা লাগে না। সুতরাং...।

বাইরে বেরোতেই আমার ছেলে বলল, আমি তোমাকে কতবার বলেছি তোমার জোকগুলো ফেসবুকে করো, অন্য জায়গায় নয়।

আমি আর উত্তর দিলাম না। জোক বোঝার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা সবাইকে দেননি।

হোটেলে এসে আমার মুড ভালো হয়ে গেল। জঙ্গলের মধ্যে হোটেল। সারাক্ষণ ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। ২৪ ঘণ্টা। ‘তুমি এসো ঝিঁঝি ডাকা দুপুরে এই আমারই দুঃখ ব্যস্ত অন্তরে, তুমি এসো পাখি আবছা ভোরে ডেকো আমায় মিহি মিহি সুরে’।

সমুদ্রে গেলাম। ভীষণ সুন্দর। নোনতা পানি। নোনতা না হলে সব সাগরের পানি গলাধঃকরণ করতাম।

চারদিকে রাশান ভর্তি। ইদানীং রাশিয়ার পুতিন গ্যাস বিক্রি করছেন এরদোয়ানের কাছে। এরদোয়ান বলছেন, ভিসা লাগবে না, এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে।

গেলাম রেস্টুরেন্টে। চমৎকার। ঢ্যাঁড়স ভাজি থেকে শুরু করে কচি পাঁঠার ঝোল। আমার খুব স্যামন মাছ খেতে ইচ্ছে করছিল।

ওয়েটারকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাদের স্যামন মাছ নেই?

তিনি উত্তর দিলেন, আমরা শুধু বিকেলে মাছ সার্ভ করি স্যার।

আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বসে পড়লাম। তিন মিনিটও যায়নি। তিনি আমার জন্য স্যামন মাছ নিয়ে এলেন। এতখানি অতিথিপরায়ণতা।

কী করব বলুন, আমার চেহারাটি এই রকম...। আমি ঠিক করলাম ওয়েটারকে আমি ফেসবুকে আমার ফ্রেন্ড লিস্টে অ্যাড করব।

বিকেলে শপিংয়ে গেলাম। জার্মানি থেকে যে শার্ট নিয়ে এসেছিলাম তাতে গরমে সিদ্ধ হচ্ছি। সুন্দর একটি টি-শার্ট পছন্দ হলো। দাম জিজ্ঞেস করলাম। ৬০ ইউরো। আমি বললাম, ৫ ইউরো। এই ট্যাকটিক আমি এবার ঢাকায় গিয়ে শিখে এসেছি। বিক্রেতা অবাক হয়ে বললেন, আপনি কোথা থেকে এসেছেন?

আমি বললাম, বাংলাদেশ থেকে।

তিনি বললেন, ও বুঝেছি! যান ৩০ ইউরো।

শেষমেশ ১৫ ইউরোতে কিনে ফেললাম। মনে মনে বললাম, বাঙালিকে চেনে না!

রাতে লাউঞ্জে এলাম। সবাই দেখলাম মদে ডুবে আছে। নিজের রুমে চলে গেলাম। সকালে ব্রেকফাস্টের সময় আমার ছেলে বলল, লাউঞ্জে এক জার্মানের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। খুবই বর্ণবিদ্বেষী। হিটলারও লজ্জা পাবেন শুনলে। আমার মনে হলো এত দিন আন্তালিয়ার বাতাস বিশুদ্ধ ছিল, আবারও জার্মানদের নিশ্বাসে বিষাক্ত হয়ে গেল।

সমুদ্রে গেলাম আমার নয় বছরের নাতনিকে নিয়ে।

নাতনি সাঁতার কাটতে কাটতে বলল, দাদা তুমি তো লেখ, একটি গল্প বলো না তোমার বই থেকে।

আমি আমার ‘বদলে যান এখনই’ থেকে একটি গল্প বললাম।

নাতনি বলল, তোমার লেখা খারাপ নয়। তবে আরও চেষ্টা করো কেমন।

বুড়ো দাদু হা করে রইল।

পরের দিন গেলাম তাহতালিতে। ২ হাজার ৩৬৫ ফুট উচ্চতায়। লেখা আছে এখান থেকে আলজেরিয়া ১ হাজার ৭৩৮ কিলোমিটার দূরে।

আর আমার বাংলাদেশ?

কীভাবে যেন তুরস্ককে ভালোবেসে ফেললাম। ভূমধ্যসাগরের উষ্ণতা, তুর্কি অতিথিপরায়ণতা?

যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এল। এবার কিন্তু ইমিগ্রেশনে কোনো অসুবিধা হলো না। প্লেনের পাইলট খুব তাড়াতাড়ি প্লেন চালিয়েছিলেন। পনেরো মিনিট আগে পৌঁছলাম।

জার্মান ইমিগ্রেশন পাসপোর্ট চাইল। কয়েক সেকেন্ড পরে ফেরত দিল।

আমি বললাম, ‘Teşekkür ederim’.

এটা তুর্কি ভাষায় ‘ধন্যবাদ’। জার্মানরা বিদেশি ভাষা পছন্দ করে না। ইমিগ্রেশনের ভদ্রমহিলা কটমট করে আমার দিকে তাকালেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে ‘Danke, Danke’ (জার্মান ভাষায় ধন্যবাদ) বললাম।

আমার কী দোষ বলুন? আমার চেহারাটি এই রকম...।

সহিসালামতে ফিরে এলাম আমার ছোট্ট কুঠিতে।