মায়ের আদরে গড়া বেণি

প্রতীকী ছবি। ছবি: প্রথম আলো
প্রতীকী ছবি। ছবি: প্রথম আলো

আমি মেয়েমানুষ যেহেতু, সাজগোজের একটু শখ থাকা খুব স্বাভাবিক। তবে আমাকে লাখ টাকা দিলেও মেকআপ আমি করব না বাবা। যে যত যা খুশি বলুন। আমার মেকআপ মানে চোখের ওপরের পাতায় একটা কাজলের টান, ব্যস।

একসময় লিপস্টিক পরতাম। এখন আর পছন্দের রং পাই না। তাই ওটাও বাদ। এ ব্যাপারটা নিয়েও মায়ের সঙ্গে বাধে—কী রে মেয়ে, সাজিস না কেন? এত সাধারণ চলতে হয়?

আম্মু মাঝেমধ্যে খেপান আমাকে। এমন থাকলে কেউ পছন্দ করবে না!

মহাবিরক্ত হয়ে উত্তর দিই, ধুত্তরি যন্ত্রণা, কারও পছন্দ হলে এমনই হতে হবে, আমি অত পারব না যাও।

আম্মু সাজতে খুব ভালোবাসেন। পুরোনো ছবি দেখলে বুঝি। একসময় বেশ দেখতে ছিলেন তিনি। আম্মু-আব্বুর বিয়ে হয় ষাটের দশকে। আর আমি জন্মেছি আশির দশকের মাঝে। অতএব, আমার সুন্দরী মায়ের চেহারা বড় ভাইবোনেরা ভালো চেনেন। আমি আম্মুকে ছোটবেলায় শাড়িতে দেখেছি। খুব সাধারণ। তবে উজ্জ্বল রঙের শাড়ি পরিপাটি করে পরা। একটু লিপস্টিক, কানে আর হাতে হালকা গয়না। এ টুকুতেই অতুলনীয় মা আমার।

মেকআপ ভালো লাগে না। তবে আম্মুর মতোই হালকা গয়না খুব ভালোবাসি আমি। হাতে–গলায় অন্য ধাতুর সাধারণ গয়না পরলেও, এমনই আমার কান, সোনা ছাড়া অন্য কিছু ঢোকাব? বাপরে, কানের যন্ত্রণায় ওষুধের গোটা দোকান গিলতে হবে। তা–ও একটা নির্দিষ্ট নকশা, অন্য কিচ্ছু ঢুকবে না সরু ছিদ্রে। আর দুলগুলো হতে হবে ছোট। বড় গয়না দেখলেই পালাই আমি।

আমার গয়না প্রীতিতে আম্মু খুশি। যখন মনে চায়, আমার জন্য দুল গড়তে পরিচিত স্বর্ণকারের কাছে যান আম্মু। ইচ্ছামতো ছোট্ট ছোট্ট দুল গড়ে আনেন। বাধা দিই না আমি। পুঁতির গয়না বানাতে ভালো লাগে আমার। দেশে থাকলে আম্মু রাতদিনই বায়না ধরেন, দুল বানাও, মালা বানাও, চুড়ি বানাও...আমি বানাই, আর তিনি পরে সারা পাড়া বেড়ান—‘আমার মেয়ে বানিয়ে দিয়েছে।’

সেই ছোট্টবেলা থেকেই আম্মুর প্রিয় খেলনা আমার চুল। আমার প্রতি সন্ধ্যায় মায়ের সঙ্গে সময় কাটানোর মাধ্যমও আমার চুল। তিনি টিভি খুলে বসেন নারকেল তেলের বাটি আর মোটা মোটা দুটো লাল ফিতা নিয়ে। টিভিতে নাটক চলে, আমাদের মা–মেয়ের গল্প চলে, আর চলে কেশচর্চা। আম্মু একটা একটা করে চুলে আঙুল বোলান। এই বোলানোর লোভে আমি ইচ্ছা করে একটু জট বাঁধাই চুলে। দেড়–দুই ঘণ্টা পরে তেল চকচকে দুই বেণির মাথায় লাল ফিতার ফুল নিয়ে বের হই আম্মুর ঘর থেকে। দুপাশের অবাধ্য চুল চিকন কালো ক্লিপ দিয়ে আটকানো।

এখন এত যত্ন করে চুল বাঁধার সময় কই? কোনোমতে একটা ব্যান্ড আটকে কলেজ দৌড়াই। আর ক্লাসে অনেক মেয়ে তো চুল আঁচড়ায়ও না। আম্মু প্রায়ই ফোন করলে প্রথমেই প্রশ্ন, চুল আঁচড়েছ?

আছি অপেক্ষায়, কবে দেশে যাব। আবার সেই তেল চকচক বেণির মাথায় ফিতার ফুল পরতে পাব। আজকের আধুনিক মেয়েদের কাছে এমন বেণি হয়তো বেমানান। তবে আমার সেকেলে মায়ের আদরে গড়া বেণি আমার সব থেকে প্রিয়।