রক্ত দিয়ে কেনা স্বাধীনতা

প্রতীকী ছবি। ফাইল ছবি
প্রতীকী ছবি। ফাইল ছবি

টিনএজ কন্যা নিয়ে মহাসমস্যায় আছে মুক্তি। মেয়ের মন আষাঢ়ের মেঘের মতো পরিবর্তনশীল। এই রোদ তো এই বৃষ্টি।

দিন কয়েক ধরে মুক্তি লক্ষ করছে, ওর মেয়ে কনক কেন যেন খুব গম্ভীর। ওর উচ্ছলতা কোথায় হারিয়ে গেছে। এক পশলা বৃষ্টির পর চাঁদ উঠেছে। আজ পূর্ণিমা। মেয়েকে নিয়ে চাঁদ দেখবে বলে ছাদে চলে গেল মুক্তি।

দোলনায় বসে মা-মেয়ে গায়ে জড়াল নরম কম্বল। হাতে ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে নেওয়া ধোঁয়া ওঠা চা।

মুক্তি বলল, মামনি কনক, মনটা তোমার এত খারাপ কেন, বলবে?

কনক বলল, ওর বন্ধু মিশার বাবার ক্যানসার। মারা যাবেন তিনি। মিশা কীভাবে বেঁচে থাকবে, পড়বে। এতে ভেঙে পড়েছে সে।

মুক্তি মেয়ের চোখের পানি মুছিয়ে বলল, মামনি, আর দুদিন পর ১৬ ডিসেম্বর। তোমার নানুর কাছে শোনা সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা একটু বলি, শোনো।

মুক্তির জন্ম একাত্তরের অনেক পরে। ওর মা-বাবা আর বড় বোন, যাঁর বয়স তখন ছিল দুই, খুলনা শহরে থাকতেন। বাবা চাকরি করতেন খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলে। পাশেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোয়ার্টার।

২৬ মার্চের পর প্রায়ই মিলের ওপর দিয়ে প্লেন উড়ে যেত। বোমা ফেলার আশঙ্কায় দূর থেকে প্লেনের শব্দ পেলেই একটা সাইরেন বেজে উঠত। সাইরেনের শব্দ পেলেই মাটির নিচে ট্রেঞ্চে চলে যেতে হতো আশপাশের সবাইকে কয়েক ঘণ্টার জন্য। আবার অন্য রকম সাইরেন বাজলে সবাই বুঝে নিত বিপদ কেটে গেছে।

আর্মি রেড করতে আসছে শুনলে ভৈরব নদ পার হয়ে মিলের অনেকের সঙ্গে গ্রামেও আশ্রয় নিয়েছেন কনকের নানা-নানি আর দুই বছরের খালা। মিলে তখন অনেক বিহারি কাজ করতেন। এত বছর একসঙ্গে কাজ করেছেন সবাই। কিন্তু তখন প্রতিদিন বাসার পুরুষ লোকগুলো কাজে গেলে মেয়েরা মনে করতেন, আর বুঝি দেখা হবে না।

লেখিকা
লেখিকা

মাঝেমধ্যে আর্মি মার্চ করে যেত কলোনিতে। ডিসেম্বরে ওদের তৎপরতা অতিরিক্ত বেড়ে গেল। তারপর এসে গেল ভয়াল ১২ ডিসেম্বরে রাত। সব বাঙালি ট্রেঞ্চে বসে খবর পেলেন, পরদিন তাঁদের ওপর আক্রমণ হতে পারে। পুরুষেরা সবাই যাঁর কাছে যা আছে, সবকিছু নিয়ে গেটে বাধা দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। মুক্তির চাচা একসময় আর্মিতে ছিলেন। অনেক আগে অবসর নিয়েছেন। তিনি সবাইকে বলে দিলেন, অটোমেটিক রাইফেলের কাছে গাদাবন্দুক নিয়ে এসব চেষ্টা করা ঠিক হবে না। ভাগ্যের ওপর বাঁচামরা ছেড়ে দিতে হবে।

পরদিন ভোরে মিলের কয়েকজন বাঙালি কর্মকর্তা কলোনিতে ‘যার যা আছে নিয়ে বেরিয়ে এসে প্রতিরোধ করুন হানাদার বাহিনীকে’ বলে চেঁচাতে লাগলেন। তাঁরা গেলেন সবার বাসার সামনে। মুক্তির মা-বাবার সামনে রতনের বাবা নেমে গেলেন পাশের বাসা থেকে একটা বন্দুক নিয়ে। মুক্তির বাবাকে ওর মা যেতে দেননি। আধা ঘণ্টা অনেক গোলাগুলি শুনলেন সবাই। তারপর দেখলেন, প্রায় ছয় ফুট লম্বা রতনের বাবা লাশ হয়ে ফিরে এলেন। ছোট্ট রতনের বয়স তখন চার।

এতক্ষণ কনক প্রায় চোখের পলক না ফেলে মায়ের কথা শুনছিল। হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠে বলল, মা রতন? সে কি বেঁচে আছে?

মুক্তি একটু হাসলেন। বললেন, তোর যে এত বিখ্যাত ডাক্তার চাচা, ওনার ডাকনাম রতন, মা। আর তিনি সেই চার বছরের ছেলে। তাঁর মা অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছেন ছেলেকে। তিনি যে একজন মুক্তিযোদ্ধার ছেলে।

তারপর মুক্তি বললেন, এ দুনিয়ায় সৃষ্টিকর্তা সবার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। বন্ধুর বাবার অসুখ শুনে তোমার মন খারাপ জানি। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে ডা. রতনের মতো তোমার বন্ধুও মানুষ হবে। একাত্তরে পেরেছে, এখন পারবে না কেন?